প্রতারণায় পড়ে কুড়িগ্রামের ৪ দিনমজুর এখন গাজীপুর কারাগারে

তারা গাজীপুর ও শ্রীপুর কোনদিন যাননি। তানভীর ইসলাম স্বপনই তাদের নিয়ে গেছেন। তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে প্রণোদনা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলছিলেন তিনি। তারা প্রণোদনার টাকার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এরমধ্যেই পুলিশ এসে চারজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। 

|| সাইফুর রহমান শামীম কুড়িগ্রাম থেকে ||

করোনা প্রণোদনার নামে কুড়িগ্রামে ৫ দিনমজুরের ব্যাংক হিসাবে আড়াই কোটি পাঠিয়ে হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল একটি প্রতারক চক্র। প্রতারকেরা টাকা তুলতে না পারলেও ফেঁসে গেছেন দিনমজুররা। এদের ৪ জন এখন কারাগারে। আর পালিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রতারক চক্র।

প্রতারণায় পড়া এসব দিনমজুরের বাড়ি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের নওদাবশ গ্রামে। প্রতারকরা না ফাঁসলেও সোনালী ব্যাংক থেকে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ টাকা জালিয়াতির অভিযোগে ওই পাঁচদিনমজুরসহ ৯ জনের নামে মামলা হয়েছে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানায়।

আর এমন প্রতারণার শিকার হয়ে বিধবা ফুলমনি রানী, কমল চদ্র রায়, প্রভাস চন্দ্র রায় ও রনজিত কুমার রায় এখন কারাগারে। তারা রয়েছেন গাজীপুর জেলা কারাগারে। বাড়ি ছাড়া হয়েছেন সুবল চন্দ্র মহন্ত নামের এক দিনমজুর। এসব খেটে খাওয়া দিনমজুরের ভাগ্যে এমন বিপদ নেমে এসেছে সরকারি টাকা আত্মসাৎকারী একটি প্রতারক চক্রের প্রতারনার কারণে। তাদের পরিবারে চলছে কান্না আর আহাজারি।

গত ২রা জুলাই শুক্রবার সকালে ফুলবাড়ী থানা পুলিশের সহযোগিতায় গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার পুলিশের একটি টিম অসহায় চার দিনমজুরকে তাদের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। ১লা জুলাই গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানায় একটি মামলা করেন শ্রীপুর সোনালী ব্যাংকের শাখার ব্যবস্থাপক রেজাউল হক। মামলায়  ৫ দিনমজুর সহ আসামী করা হয়েছে প্রতারক চক্রের সদস্য শ্রীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বজলুর রশিদ, হিসারক্ষন অফিসার অডিটর আরিফুর রহমান, মাস্টাররোল কর্মচারী তানভীর ইসলাম স্বপন ও ঢাকার উত্তরখান জামতলা এলাকার শাহনা আক্তারকে।

শ্রীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসার মাস্টারোল কর্মচারী কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বাসিন্দা তানভীর ইসলাম স্বপন (৩২) করোনায় সরকারি প্রণোদনা পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখান এসব দিনমজুরদের। ১৬ই জুন ৫ দিনমজুরকে নিয়ে যান সোনালী ব্যাংকের নাগেশ্বরী শাখায়। সেখানে তাদের নামে ব্যাংক হিসাব চালু করেন। এসব দিনমজুরদের শ্রীপুর নিয়ে গিয়ে ব্যাংকের চেক বই ও বিভিন্ন কাগজপত্রে সহি ও টিপসহি নেন। তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেন ব্যাংকের সব কাগজপত্র ও চেক বই। ব্যাংক একাউন্টে প্রণোদনার টাকা পাঠানো হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের বাড়ি পাঠিয় দেন। প্রণোদনার টাকা পাওয়ার প্রত্যাশায় দিনমজুররা  প্রতারক চক্রের সদস্য স্বপনের সব কথা বিশ্বাস করেছেন।

বাড়ি ছাড়া দিনমজুর সুবল চন্দ্র মহন্তের সাথে  কথা হলে তিনি  জানান,  তারা গাজীপুর ও শ্রীপুর কোনদিন যাননি। তানভীর ইসলাম স্বপনই তাদের নিয়ে গেছেন। তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে প্রণোদনা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলছিলেন তিনি। তারা প্রণোদনার টাকার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এরমধ্যেই পুলিশ এসে চারজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।

সোনালী ব্যাংক নাগেশ্বরী শাখার ব্যবস্থাপক শরিফুল আজম জানান, ব্যাংক হিসাব চালুর কিছুদিন পর এসব ৫ দিনমজুরের হিসাব নম্বরে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ টাকা চলে আসে। এসব টাকা আসে সোনালী ব্যাংক হেড কোয়ার্টার শাখা থেকে। এর মধ্যে রণজিতের সঞ্চয়ী হিসাবে ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭২০ টাকা, প্রভাসের হিসাব নম্বরে ৬৫ লাখ ৭২ হাজার ১২০ টাকা, সুবলের হিসাব নম্বরে ৪০ লাখ ৭১ হাজার ৭২০ টাকা, কমলের হিসাব নম্বরে ৪২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৮০ টাকা এবং ফুলমণি রানীর হিসাব নম্বরে ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৫২০ টাকা। কয়েকদিন পর অপরিচিত ৩-৪ জন লোক হিসাব নম্বর থেকে টাকা তুলতে আসলে তার সন্দেহ হয় এবং শ্রীপুর হেডকায়ার্টার শাখায় যোগাযোগ করে টাকা উত্তোলন বন্ধ করা হয়। কিন্তু অপরিচিত লোকগুলোকে আটক করার আগেই তারা ব্যাংক থেকে সটকে পড়েন।

প্রভাস ও কমলর মা মালতি বেওয়া দিন রাত কাঁদছেন। ছেলেদের জন্য তিনি কেঁদে কেঁদে পাগল প্রায়। প্রভাসের স্ত্রী অঞ্জলী রানী বলেন, ‘একদিন কাজ না করলে খাবার মেলেনা। স্বামী জেলে যাবার পর আমরা না অনাহারে অর্ধাহারে থাকছি।’

রনজিতের স্ত্রী ভারতী রানী বলেন ‘আমার স্বামীসহ  ৫জনই নির্দোষ। শুধু অভাবের কারনে প্রনোদনার লোভে ব্যাংক হিসাব নম্বর চালু করেন। তারা এসবের কোনকিছুই জানতেন না।’

বিধবা ফুলমনী রানীর ছেলে সোহেল চন্দ্র রায় (২১) বলেন, মা জেলে। তিনি প্রতিবন্ধী ছোট বোন নিয়ে এখন চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তার মা দিনমজুরী করে আয় করতেন এবং সংসার চালাতেন। আমার কাছে টাকা নেই তাই মাকে দেখার জন্য কারাগারও যেতে পারিনি। তার মা সহ সকলকে মুক্তির জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।

বড়ভিটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খয়বর আলী জানান, গ্রেপ্তার দিনমজুররা সম্পূর্ণ নির্দোষ। তাদের সরলতাকে পুঁজি করে প্রতারক চক্র তাদের সর্বনাশ করেছে। তিনি তদন্ত সাপেক্ষে দিনমজুরদের মুক্তি দেয়ার দাবী জানান।

ফুলবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তদন্ত সারওয়ার পারভেজ জানান, শ্রীপুর থানা আমাদের কাছে সহযোগীতা চেয়েছে এবং আসামী আমাদের ফুলবাড়ী উপজেলায় হওয়ায় চার আসামীকে গ্রেফতারে সহযোগিতা করা হয়েছে।

 

সংবাদ সারাদিন