করোনাক্রান্ত স্বাস্থ্যসুশ্রষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিতে পারবে না সরকার

|| অর্থবাজার প্রতিবেদন, ঢাকা ||

করোনাভাইরাস সংক্রমণ সামাল দিতে গিয়ে বিশ্বের অন্য অনেক পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল দশা। দাবি উঠেছে এই খাতে রাষ্ট্রিয় বরাদ্দ বাড়ানোর। তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এমন দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, দেশের স্বাস্থ্যখাতে এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ ‘বাস্তবসম্মত’ নয়।

মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভার পর সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান নিজের এই অবস্থান জানান।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “মহামারীর এই সময়ে স্বাস্থ্য খাত আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং আমরা গুরুত্বও দিয়েছি। কিন্তু সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ এ খাতের সক্ষমতা কতটুকু তাও দেখতে হবে। শুধু বরাদ্দ দিলেই তো হবে না। বাস্তবায়ন করতে হবে।”

মন্ত্রী জানান, সক্ষমতা অনুযায়ী আমরা স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ গত অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। গেল বাজেটে যা ছিল ১০ হাজার ১০৮ কোটি টাকা।

তিনি বলেন, “বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মহামারীর এই দিনে এই দুটি খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনও প্রয়োজনে যে কোনও সময় এই দুই খাতের জন্য বিশেষ কোনও বরাদ্দ ও প্রকল্প অনুমোদনের প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে তা অনুমোদন ও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে।”

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যাকে টাকা দেব, সে কোথায় কীভাবে খরচ করবে? তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরে দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, একটা গ্রহণযোগ্য বিশ্বাসযোগ্য ভালো মানের প্রকল্প নিয়ে আসুক। তার (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের) দক্ষতার প্রশ্ন আছে, তার ব্যবহার করার সক্ষমতার প্রশ্ন আছে।”

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা থাকলেও খাওয়ার একটা মাত্রা আছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, “এক বেলায় তিন বেলার ভাত খেতে পারবে না। এসব বিচার করে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা গত অর্থবছরের তুলনায় এক হাজার কোটি টাকা থেকে বেশি মনে হয়, আসলে সেটি প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।”

আগামী অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্য খাতে ১৩ হাজার ৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট এডিপির ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ।যা কিনা বরাদ্দের অবস্থানগত নিরিখে সপ্তম।

মান্নান বলেন, “কৃষির জন্যও একই কথা বলা আছে, তাদের জন্যও দরজা খোলা। আজকেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিন বার বলেছেন, কৃষি এবং স্বাস্থ্য উচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। আমাদেরকেও বলেছেন, আপনার তাদের প্রকল্প আসলে দ্রুত প্রক্রিয়া করবেন।”

উল্ল্যেখ, আগামী অর্থবছরের এডিপিতে কৃষি খাতের জন্য ৮ হাজার ৩৮২ কোটি টাকার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৬ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। এবারে বরাদ্দ বেড়েছে ১ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এই বৈঠকেই আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এসব বরাদ্দ অনুমোদন দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্যখাতের খোলনলচে বদলে ফেলার পরামর্শ
স্বাস্থ্য খাতকে খোলনলচে বদলে ফেলার পরামর্শ দিয়ে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, চলমান করোনাদুর্যোগ মোকবেলা করে জনস্বাস্থ্যপরিস্থিতির উন্নয়ন করতে হলে নতুন বাজেটে সর্বোচ্চ গুরত্ব দিতে হবে এই খাতে।

মঙ্গলবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ’উন্নয়ন সমন্বয়’ আয়োজিত প্রাক-বাজেট আলোচনায় স্বাস্থ্যখাতে দীর্ঘদিনের ‘অবহেলার’ পথে না হেঁটে করোনাদুর্যোগের মধ্যে তৈরি এই বাজেটে স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

বলেছেন, “আমাদের স্বাস্থ্যখাতে আমরা দীর্ঘদিন নজর দিতে পারিনি বা অবহেলিত থেকেছে। তাই এবারের বাজেটকে স্বাস্থ্য বাজেট বানানোর কথা বলেন সাবেক এই গভর্নর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক আতিউর বলেন, “গত বছরগুলোতে আমরা স্বাস্থ্যখাতে যা খরচ করি, তা জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ এবং বাজেটের ৫ শতাংশ। এটা এই বছরই জিডিপির ২-৩ শতাংশ হয়ে যাওয়া উচিত। এবার হয়ত বাজেটের ২০ শতাংশে নেওয়া যাবে না। কিন্তু ১০ শতাংশের কম কোনো অবস্থাতেই যাতে না হয়।”

আসছে বাজেটে এডিপি ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা
করোনাদুর্যোগের এই সময়ে আসছে অর্থবছরে উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে নিতে রাষ্ট্রের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) ভার্চুয়াল সভায় আগামী অর্থবছরের এডিপির চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।এই এডিপির আকার চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি।

চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। তবে গত মার্চ মাসে তা সংশোধন করে ১ লাখ ৯২ হাজার ৯২১ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

মঙ্গলবার দুপুরে গণভবন থেকে এই ভার্চুয়াল সভায় যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান অংশ নেন।

এ সময় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) অগ্রাধিকারভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও এনইসি সদস্যবৃন্দ এবং সংশ্লিষ্ট সচিবরা রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে উপস্থিত থেকে এই ভার্চুয়াল সভায় যোগ দেন।

বৈঠক শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য অনুমোদিত এডিপির অর্থ দিয়ে ১ হাজার ৫৮৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।

এডিপির জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে এক লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা এবং বহিঃসম্পদ থেকে ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকার যোগান দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এছাড়াও বৈঠকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য আরও ৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৫ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ৭০ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা যোগান দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর এই বরাদ্দ দিয়ে আরও ৮৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা জানিয়ে তিনি বলেন, “সে হিসাবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দসহ এডিপির সর্বমোট আকার দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা,” বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

আগামী অর্থবছরের জন্য অনুমোদিত এডিপির মধ্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পরিবহন খাতে। এ খাতের জন্য সর্বোচ্চ ৫২ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ণ খাতের জন্য।এ খাতে প্রায় ২৫ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৫৭ ভাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে, প্রায় ২৪ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা বা মোট বরাদ্দের ১২ দশমিক ০৯ শতাংশ।

চতুর্থ সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শিক্ষা ও ধর্ম খাতে, প্রায় ২৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা বা মোট বরাদ্দের ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ।

পঞ্চম সর্বোচ্চ বরাদ্দ, প্রায় ১৮ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বিজ্ঞান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে। এটি মোট বরাদ্দের প্রায় ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

ষষ্ঠ সর্বোচ্চ প্রায় ১৫ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৫৮ ভাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান খাতে।

সপ্তম সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা বা মোট বরাদ্দের ৪ দশমিক ০৯ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কৃষি খাতে।

অষ্টম সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৫২৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বা মোট বরাদ্দের প্রায় ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রাণি সম্পদ খাতে।
এবং নবম সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৪৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বা ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জনপ্রশাসন খাতে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন