|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||
করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে অন্য অনেক রাষ্ট্রের মতই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের নানা খামতি ও দূর্বলতা। মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে তাদের করের টাকায় গড়ে ওঠা রাষ্ট্রিয় এই খাতটির কতটা বেহাল দশা। তারপরও ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ৫ দশমিক ৮ শতাংশ অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে স্বাস্থ্যখাতে। অঙ্কের হিসাবে এই পরিমাণ ১২ হাজার ৪৭২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ থাকা উচিত মোট বাজেটের ১০ শতাংশ।
তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সংক্রান্ত কার্যক্রম অন্য ১৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অংশগ্রহণে বাস্তবায়ন করা হয় তাই ঐসব মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া অর্থ মিলিয়ে এই খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে শুধু কোভিড-১৯ মোকাবেলায় যে কোনো জরুরি চাহিদা মেটাতে থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেন, “প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসকে ‘সঠিকভাবে মোকাবেলা ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব দৃঢ়তার সাথে কাটিয়ে ওঠার’ স্বার্থে এবার গতানুগতিক বাজেটের ধারা থেকে কিছুটা সরে এসেছেন তিনি। কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে সরকারের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে। স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ, প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণের মত ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।”
এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের মূল বাজেটে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে তা ২৩ হাজার ৬৯২ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। এই হিসাবে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বরাদ্দ বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৩ শতাংশ বেড়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ মোকাবেলায় গৃহীত কার্যক্রম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতের জন্য এ বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সরকার বিদায়ী অর্থবছরে ৫২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে জরুরি ভিত্তিতে। করোনা মোকাবেলায় দায়িত্ব পালনকালে আক্রান্ত ও মৃত্যুজনিত কারণে ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মানী দিতে ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
কোভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতায় ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “এ মহামারী মোকাবেলায় যা করণীয় তার সবকিছু সরকার করবে।”
গত বছরের শেষে চীন থেকে শুরু হওয়া নতুন করোনাভাইরাসের মহামারী পুরো বিশ্বকেই এখন নাজুক অবস্থায় ফেলেছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৮ হাজার ৫২ জন। মারা গেছেন ১ হাজার ৪৯ জন। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।
স্বাস্থ্যসম্পর্কিত অন্যান্য খাতে বরাদ্দ
স্বাস্থ্য–শিক্ষা ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি খাতের গবেষণা উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকার একটি সমন্বিত স্বাস্থ্য বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল গঠনের প্রস্তাব রয়েছে এবারের বাজেটে। অর্থমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, “এ গবেষণা তহবিল দক্ষ, কার্যকরভাবে পরিচালনা করার জন্য স্বাস্থ্য খাতে অভিজ্ঞ গবেষক, পুষ্টি বিজ্ঞানী, জনস্বাস্থ্য ও সমাজ বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ,পরিবেশবিদ ও সুশীল সমাজ ও অন্যান্য উপযুক্ত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হবে।”
অর্থমন্ত্রী এও বলেন, “করোনার মত ভবিষ্যতে অন্য মহামারী দেখা দিলে তা মোকাবেলার জন্য টেকসই আবিস্কার, রোগতত্ত্ব-রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে যথাযথ গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও গবেষণার কাজে আমাদের জোরালোভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। দেশ হিসেবে আমরা যদি উন্নত বিশ্বের পর্যায়ে পৌঁছাতে চাই, সমন্বিত স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণা নীতিমালা প্রণয়ন, তহবিল গঠন করা ও এ খাতে ব্যয় বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।”
বাড়বে স্বাস্থ্য চিকিৎসা সুবিধার আওতা
হৃদরোগ, ক্যান্সার ও কিডনি চিকিৎসা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য বিভাগীয় শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার চিকিৎসা ইউনিট স্থাপন, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে ১৫০ শয্যার কার্ডিওভাস্কুলার ইউনিট স্থাপন, বিদ্যমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার বাড়ানো ও সেগুলোর সংহত করা এবং সকল জেলা সদর হাসপাতালে নেফ্রোলজি ইউনিট ও কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন করার প্রস্তাব করা হয়েছে এবারের বাজেটে।
অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় জানান, চলতি অর্থবছরে ৪০টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ২৫টি দশ শয্যার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, ৩টি বিশ শয্যার হাসপাতাল, ৫০ শয্যার ৩টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুমিল্লায় ১টি ১০০ শয্যার শিশু হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে।
এছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে ইউনিয়ন পর্যায়ে নতুন ১০০ শয্যার ৭০টি এমসিডব্লিউসি নির্মাণ ও আরও ২৫০টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ (পুনর্নির্মাণসহ), পুরাতন ২ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আধুনিকায়ন এবং নতুন ১ হাজার ২৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করার কথা জানান অর্থমন্ত্রী।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, “সরকারের নানা বিভাগের সমন্বয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য-শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও এর গবেষণার জন্য একটি সমন্বিত বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন পলিসি তৈরি করা প্রয়োজন। এই পলিসি বা নীতিমালার লক্ষ্য হবে, স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণায় দেশকে ধীরে ধীরে উন্নত বিশ্বের সমকক্ষ করে তোলা।”
তবে এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে এতোসব কিছু করবার কথা জানানোর পাশাপাশি অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানোর কথা জানালেও সেই টাকা কীভাবে কোথায় খরচ হবে, তার বিশদ পরিকল্পনা বাজেট বক্তৃতায় দেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
যদিও বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি বরাদ্দ বাস্তবায়নের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানোর কথাও জোর দিয়ে বলে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই।