|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে দল-মত নির্বিশেষে দেশব্যাপী চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকে কে কোন দলের সেটা বড় কথা নয়, দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের আমরা ধরে যাচ্ছি। দুর্নীতিবাজ যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি, নেব এবং এটা অব্যাহত থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা শেখ হাসিনা আজ দুপুরে একাদশ জাতীয় সংসদের অষ্টম (বাজেট) অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতির সাথে জড়িত, অনিয়মে জড়িত, আমরা যাকেই পাচ্ছি এবং যেখানেই পাচ্ছি তাকে ধরছি। আর ধরছি বলেই, চোর ধরে যেন চোর হয়ে যাচ্ছি।’
চোরদের ধরলে সরকারকেই উল্টো দোষারোপ করা হয় জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য। এরআগেতো দুর্নীতিটাই নীতি ছিল। অনিয়মটাই নিয়ম ছিল। সেভাবেই রাষ্ট্র চলেছে। তারপরও যতদূর পারি শুদ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এই অনিয়মগুলো আমরা নিশ্চয়ই মানব না।’
এরআগে বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের তার বক্তৃতায় বহুল আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদের দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের কথা তুলে ধরলে কোভিড-১৯ এর মধ্যেও দেশব্যাপী নিজের সরকারের চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রী। ড. শিরীন শারমীন চৌধুরী এসময় স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী রিজেন্ট হাসপাতালের দুর্নীতি, করোনা চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়া বিষয়ে ব্যাপক ব্যয়ের পরিসংখ্যান এবং অন্যান্য অনিয়ম অসংগতির প্রসঙ্গে দেশে ’৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকারগুলোর দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণকে দায়ী করেন। সরকারের একের পর এক বিভিন্ন দুর্নীতিবাজদের পাকড়াও করার দিকে ইঙ্গিত করে সরকার প্রধান বলেন, দুর্নীতির মূল উৎপাটনে আন্তরিকতায় কোন খামতি নেই।
একইসঙ্গে তিনি করোনাভাইরাস মোকাবেলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টিও স্মরণ সকলকে করিয়ে দিয়ে ‘ভয়কে জয় করার’ ও পরামর্শ দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭৫ এর পরে যারা রাতের অন্ধকারে অস্ত্র হাতে নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তারাই বাংলাদেশের মানুষের চরিত্র নষ্ট করে দিয়ে গেছে। কারণ, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে সেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য এরা মানুষকে দুর্নীতি শিখিয়েছে, কালো টাকা, ঋণখেলাপিতা শিখিয়ে এই সমাজটাকে কলুষিত করে দিয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘মানুষ আগে যে একটা আদর্শ নিয়ে চলত, নীতি নিয়ে চলত, দীর্ঘদিন এদেশে এই মিলিটারি ডিক্টেটরশিপ এদেশের মানুষের চরিত্র হরণ করেছে। কারণ, তাদের অবৈধ ক্ষমতাটাকে নিষ্কণ্টক করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। তারা বছরের পর বছর এই দুর্নীতি-অনিয়মের বীজ বপন করেছে। তা মহীরুহ হয়ে গেছে।’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘আপনি যতই কাটেন আবার কোথা থেকে যেন গজিয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে চরিত্রহীনতা একেবারে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত । সেখানে আপনি যতই চেষ্টা করেন এর মূলোৎপাটন করা যথেষ্ট কঠিন।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের সাফল্য এবং দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার পদক্ষেপের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘তারপরও এর মধ্যে যে খবরগুলো পাচ্ছেন, এটা কারা করছেন?’
সরকারের পাশাপাশি পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বর্ডার গার্ড, সশস্ত্রবাহিনী, আনসার ও ভিডিপিসহ আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ এবং শ্রমিক লীগের নেতা-কর্মীরা করোনা মোকাবেলায় দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ত্রাণকার্যক্রমসহ নানাভাবে সহযোগিতা করায় তাদেরকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
পাশাপাশি, করোনা মোকাবেলা এবং অর্থনীতিকে সচল রাখায় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দলের কর্মীদের মাঠে নামিয়েছি এবং তাঁরা নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। তবে, আরো অনেক রাজনৈতিক দল রয়েছে এবং এনজিও রয়েছে তাঁদের কয়জন আজকে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে? তাঁদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে? সেটাই আমার প্রশ্ন।
প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে আরো বলেন, ‘ঘরে বসে সমালোচনা, বাজেটের খুঁত ধরা, কাজের খুঁত ধরা- সেগুলো অনেকেই ধরতে পারেন। কিন্তু মাঠে গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষকে সেবা করার কাজটা আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সৈনিক যারা, তারাই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি এবং অনেকেই অনেক বাধা অতিক্রম করেই কাজ করে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ২ হাজার ডাক্তার এবং ৬ হাজার নার্স নিয়োগের পাশাপাশি আরো ২ হাজার ডাক্তারের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। তাছাড়া, হেলথ টেকনোলজিস্ট, কাডিওগ্রাফার এবং ল্যাব এটেনডেন্টের ৩ হাজার পদ সৃষ্টি করা হয়েছে যেগুলোতে সরকার নিয়োগ দেবে।
সংসদ নেতা বলেন, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং ল্যাব এটেনডেন্টদের সরকারের তরফ থেকে পরিবার থেকে পৃথক করে তাঁদের সরকার থাকা-খাওয়া, হাত খরচসহ হোটেল ভাড়া করে আবাসনের ব্যবস্থা করেছে। যে সব চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী এ সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁদের সকলকে আমাদের দেখতে হবে এবং সে ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
যারা লোকলজ্জার ভয়ে প্রকাশ্যে হাত পাততে পারছে না এমন বহুলোকের বাড়ি-ঘরে গোপনেও ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘সরকারীভাবে যেমন দিচ্ছি তেমনি দলীয় ভাবেও মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সমানভাবে সাহায্য করে যাচ্ছি। কারণ, এটাই আওয়ামী লীগ, যে আওয়ামী লীগ জাতির পিতার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা এনেছে।’
করোনা ভাইরাসের ভয়ে আতঙ্কিত না হয়ে স্বাস্থবিধি মেনে চলার আহ্বানও পুণর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের কথা শুনলেই মানুষ ভয়ে আতঙ্কিত হয়। এত আতঙ্কিত হবো কেন। মরতে তো একদিন হবেই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি তাহলে করোনার সংক্রমণ থেকে মুক্তি পাবো। আমাদের দেশে করোনারোগীর সুস্থ হওয়ারর হার অনেক বেশি। মনে সাহস রাখতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’
তিনি বলেন, করোনার কারণে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছে। কিন্তু জীবন তো আর থেমে থাকবে না। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি। বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, করোনার সংক্রমণ জুলাই মাস পর্যন্ত বাড়তে থাকবে। এরপর আস্তে আস্তে কমে যাবে। সেটাই হচ্ছে। আশা করি, পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
দেশে সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতির উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘করোনাতো আছেই তার সাথে এখন আবার যোগ হয়েছে বন্যা। ইতোমধ্যে রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালননিরহাট, সিলেট, সুনামগঞ্জ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টঙ্গাইল, মাদারীপুরসহ বন্যা দেখা দেওয়া ১২টি জেলায় প্যাকেট ও শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ৬৪টি জেলার জন্য বন্যার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ১০ হাজার ৯শ’ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ এবং ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা নগদ বরাদ্দ দিয়ে দেওয়া রয়েছে। যাতে দুর্যোগ হলে কোন ধরনের অপেক্ষা করতে না হয়। সঙ্গে সঙ্গে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করা যায়।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বন্যা, নদীভাঙ্গন, অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, ঘুর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, অগ্নিকান্ডসহ যেকোন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষকে সহযোগিতা করতে আমরা সবসময় প্রস্তত থাকি এবং আমাদের দেশের প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের জানা আছে এবং সে অনুযায়ীই আমরা ব্যবস্থা নেই। যাতে দেশের মানুষকে আমরা সুরক্ষিত রাখতে পারি এবং তাঁদের কষ্ট কমাতে পারি।’
প্রধানমন্ত্রী এই করোনাকালিন বাজেট প্রণয়নের জন্য অর্থমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগকে তাঁর ভাষণে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। যা অনেক উন্নত দেশও করতে পারেনি। কিন্তু আমরা করেছি।’
এই বাজেটে প্রবাসীদের জন্য প্রণোদনা,সামাজিক সুরক্ষাকে গুরুত্ব প্রদান করে দুঃস্থ ও প্রতিবন্ধীদের ভাতার পরিমান এবং সংখ্যা বৃদ্ধি, আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ সকল শ্রেনী পেশার মানুষের জন্য ১৯টি প্যাকেজে প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি সরকার পরিচালনায় আসার পর বাজেট ঘাটতি কখনও শতকরা ৫ শতাংশের ওপরে উঠতে দেই নাই কিন্তু এবার করোনার জন্য বাজেট ঘাটতি আমরা ৬ ভাগ রেখেছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘টাকা লাগলে আমরা দেব। কিন্তু করোনার কারণে অর্থনীতি যেন স্থবির না হয়।’
উল্লেখ্য, কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গত ১০ই জুন এবারের সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়। ১১ই জুন সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল ২০২০-২১ অর্থ বছরের জন্য প্রায় ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। ৩০শে জুন এই বাজেট সংসদে পাস হয়।
তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)