ধনীর সংখ্যা বাড়ার দিক থেকে বিশ্বে এক নম্বর বাংলাদেশ

|| বার্তা সারাবেলা ||

করোনাদুর্যোগে বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের অনিশ্চিত এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ধনীদের জন্য সুখবর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্থিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স। গেল বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত ‘আ ডিকেড অব ওয়েলথ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গেল দশ বছরে বিত্তবান মানুষের সংখ্যা বাড়ার দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতিগুলোকেও পেছনে ফেলে এখন এক নম্বরে বাংলাদেশ।

গত এক দশকে বিশ্বের ধনী জনগোষ্ঠির সম্পদ ও অর্থবিত্ত বাড়ার হার পর্যালোচনা এবং আগামী ১০ বছরে তাদের সম্পদ ও অর্থবিত্ত কোন গতিতে বাড়বে কিংবা সেগুলোর বন্টনইটা কেমন হবে এগুলো নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা চালিয়েছে ওয়েলথ এক্স।

প্রতিষ্ঠানটির এই গবেষণা বলছে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গেল ১০ বছরে বাংলাদেশে ৫০ লাখ ডলারের বেশী সম্পদ গড়েছেন এমন ধনীর সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৪ দশমিক তিন শতাংশ হারে। ওয়েলস এমনসব ধনীদেরকে বলছে ‘আলট্রা-হাই নেট ওয়র্থ’ গ্রুপ।

অথচ গেল ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। নানাভাবে চেষ্টা করেও ঋণের এই অর্থ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে জনগণের ওপর পরোক্ষ করের চাপ বাড়িয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যেখানে মোট বাজেটব্যয় হচ্ছে ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি ১৯০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট বাজেটের অর্ধেকেরও বেশী অর্থের যোগানটাই নেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের নানাস্তরে দেওয়া কর ও অন্যান শুল্ক থেকে।

এ ধরণের একটি আর্থিক পরিস্থিতিতে দেশ থেকে আবার প্রতিবছর পাচার হয়ে যায় প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। চলতি বছরের ৩রা মার্চ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যা ৯৮ হাজার কোটি টাকা। ২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদশে সরকার জাতিসংঘে রাষ্ট্রের আর্থিক কোন পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্ত না দেওয়ায় পাচারের সবশেষ হিসাব হালনাগাদ করা যায়নি বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র ইকোনমিস্ট রিক রাউডেন।

জিএফআই’র তথ্যমতে, গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। যা দেশের চলতি বছরের (২০১৯-২০২০) জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারের এই জনবিরুদ্ধ কাজে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। দক্ষিণ এশিয়ার এসংক্রান্ত তালিকায় ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৯ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা, টাকা পাচার করার এমন ভয়াবহ তথ্যে সহজেই অনুমেয় এদেশে ধনী হওয়ার অন্যতম উপায়টা কি।
এদিকে বৈশ্বিক করোনা সংক্রমণের অভিঘাতে বাংলাদেশও বন্ধ হয়ে যায় অর্থনীতির সব চাকা। করোনা বিপর্যয়ে দেশটিতে ইতোমধ্যে লাখের বেশী প্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত মানুষ হারিয়েছেন কাজ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র পরিসংখ্যান বলছে, দেশটির কোন না কোন কাজে সম্পৃক্ত ছিল এমন যুবগোষ্ঠির প্রতি ছয় জনে একজন এখন বেকার।

উৎপাদিত শষ্য সবজি আর খাদ্যপণ্য বিক্রি করতে না পারায় দেশের অন্যতম আর্থিক খাত কৃষিতে বিপর্যস্ত অবস্থা। করোনাঅভিঘাত সামলে কি করে আবার চাষাবাদে ফিরবে সে চিন্তায় দিশেহারা কৃষক।

করোনাসংক্রমণের মধ্যেই শিল্প চালু করা হলেও মালিকদের রাষ্ট্রিয় অর্থ লুটপাটের সংস্কৃতি, যথেচ্ছাচার আর শ্রমিকবিরুদ্ধ মানসিকতায় সবথেকে বেশী বিপদে পড়েছেন এই খাতে কর্মরত মানুষ। বেশীর ভাগ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অনিয়মিত হয়ে পড়েছে বেতনভাতা। যাওবা দেওয়া হচ্ছে তা পাওনা বেতনের অর্ধেক। এই ঈদে বেশীর ভাগ প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয়নি ঈদের বোনাস।

এদিকে বিশ্বপ্রেক্ষাপট মূল্যায়ণ করতে গিয়ে ওয়েলস গবেষণা বলছে, প্রকৃত অর্থে অর্থবিত্ত অর্জনের দিক থেকে গত দশকটা ছিল ধনীদেরই। গেল দশকে বিশ্বে ধনী মানুষ ও তাদের সম্পদের পরিমাণ দুটোই বেড়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে। শতাংশের দিক থেকে যা ৫০ শতাংশের বেশী। আর ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই দেড় দশকে বিশ্বজুড়ে মিলিয়নিয়রের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে আড়াই কোটিতে পৌঁছেছে।

এই সময়ে বিশ্বের মোট ধনীর ১৮ দশমিক ছয় শতাংশই ছিল এশিয়াতে। ২০১৯ সালে এসে সেই সংখ্যাটা পৌঁছেছে ২৭ শতাংশে। ওয়েলথ এক্সের এই গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, শুধু এশিয়াতেই ৫০ লাখ ডলারের বেশী সম্পদ ও অর্থবিত্ত রয়েছে এমন ধনীর মানুষের সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক দশকে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে ছোট-বড় অর্থনীতির মিশ্রণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী দেশ রয়েছে এশিয়াতে। প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে ৬টিই এশিয়াতে। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। দুটি দেশেই তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠি ও আঞ্চলিক উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক প্রসার ঘটেছে।

যারা ৫০ লাখ ডলারের বেশী সম্পদের অধিকারী তাদের ধনকুবের বলা হয়েছে সমীক্ষায়। এই হিসাবে ভিয়েতনামে ৫০ লাখ ডলারের বেশী সম্পদের অধিকারী ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে গত ১০ বছরে গড়ে ১৩ দশমিক নয় শতাংশ হারে। চীনে ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩ দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে। আফ্রিকার দেশে কেনিয়ায় এই হার ১৩ দশমিক এক শতাংশ।

ফিলিপিন্সে ১১ দশমিক নয়, থাইল্যান্ডে ১০ দশমিক ছয়, নিউজিল্যান্ডে ৮ দশমিক সাত শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন সম্পদের অধিকারী ধনকুবেরের বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক দুই শতাংশ। ধনী বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রথম দশটি দেশের তালিকাতে রয়েছে পাকিস্তানও। দেশটিতে ৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে ধনকুবেরের সংখ্যা। এর পরেই রয়েছে আয়ারল্যান্ড, দেশটিতে বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক এক শতাংশ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন