|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে কোনো বিশেষ শ্রেণি সুবিধা পায় না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেছেন, “বরং সুবিধাটা একেবারে গ্রাম পর্যায়ের মানুষের ঘরের দৌরগোড়ায় পৌঁছে যায়। সেই কারণে তারা আমাদের সমর্থন দেয়, সেই কারণে আমরা তাদের সমর্থন পাই।”
জেলা হত্যা দিবসে মঙ্গলবার (৩রা নভেম্বর) আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় গনভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে একথা বলেন শেখ হাসিনা। বলেন, জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনেই আওয়ামী লীগ একের পর এক ভোটে জিতে ক্ষমতায় থাকছে।
পয়তাল্লিশ মিনিটের দীর্ঘ বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর খুনি ও স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিকে মদদ দেওয়ার জন্য বিএনপিকে অভিযুক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, “পঁচাত্তর ট্রাজেডির পর বাংলাদেশকে পেছন দিকে নিয়ে গিয়েছিল তারা। আওয়ামী লীগই সরকারে এসে দেশকে আবারও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। আওয়ামী লীগের সমালোচনা যারা করছেন, তাদের জনসমর্থনহীনতার কথাও বলেন শেখ হাসিনা।
“আমরা জনগণের সমর্থনটা পাই কেন?” প্রশ্ন রেখে উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা জনগণের জন্য কাজ করি বলেই জনগণ আমাদের সমর্থন করে। তিনি বলেন, “একটার পর একটা নির্বাচনে জয়ী হয়ে আমরা সরকার গঠন করেছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে জনগণের স্বার্থে কাজ করে, জনগণের কল্যাণে কাজ করে, জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করে। এর শুভফলটা জনগণই পায়, জনগণ সেটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করে।”
আওয়ামী লীগকে ‘জনগণের সত্যিকারের দল’ অভিহিত করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের কিছু বাম দল আছে, তারা সাধারণ মানুষকে নিয়ে রাজনীতি করে, কমিউনিস্ট পার্টি আছে সাধারণ মানুষকে নিয়ে রাজনীতি করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে তো আওয়ামী লীগ, যে আওয়ামী লীগ তৃণমূল থেকে গড়ে উঠেছে জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, যেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।”
তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাই আওয়ামী লীগের বড় শক্তি জানিয়ে দলনেত্রী বলেন, “যারা নির্বাচনে জনগণের কাছে যেতেই পারে না, জনগণের কাছে ভোট চাইতে পারে না, যাদের সংগঠনই সেই তৃণমূল থেকে গড়ে উঠেনি, মানুষ তাদের পাশে দাঁড়াবে কেন?”
২০০৮ সালে সরকার গঠনের পর বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতে নানা ষড়যন্ত্রের কথা জানাতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “বিডিআরের ঘটনা ঘটানো হলে, হেফাজতের ঘটনা ঘটানো, নানা ধরনের ঘটনা, বহু রকমের কারসাজি ঘটানোর চেষ্টা, কিন্তু জনসমর্থন না থাকলে, ষড়যন্ত্র করে খুন করে ফেলা যায়, হত্যা করে ফেলা যায়, কিন্তু জনসমর্থন না থাকলে কেউ ক্ষমতায় গিয়ে টিকে থাকতে পারে না, দেশের কল্যাণও করতে পারে না, এ হচ্ছে বাস্তবতা। আওয়ামী লীগ টিকেই আছে শুধু জনগণের জন্য কাজ করার মধ্যে দিয়ে। কারও দয়া ভিক্ষে করে না, কারও করুণা ভিক্ষা করে না।”
তিনি বলেন, “আমাদেরকে সরানোর জন্য যত বেশি নাড়াচাড়া করবে আমাদের আওয়ামী লীগের শিকড়টা তত বেশি মাটিতে শক্ত হবে, পোক্ত হবে।”
জরুরি অবস্থা বিএনপির অপশাসনের ফল দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এক যুগ আগে দেশে যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল, সেজন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসই দায়ী। তাদের দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও তাদের অপকর্মের কারণে এদেশে ইমার্জেন্সি জারি হয়। ২০০৭ এ আসে সেই ১/১১ সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার।”
সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিএনপি তাদের আস্থাভাজনদেরই নিয়েছিল বলে জানিয়ে তিনি বলেন, “তারা খালেদা জিয়ারই পরিচিত এবং তাদেরই হাতে তৈরি। ফখরুদ্দীন সাহেব ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে কাজ করতেন, তাকে নিয়ে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করা হল। সেখান থেকে তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করা হল। সেনাবাহিনীতে ৯ জন জেনারেলকে ডিঙিয়ে জেনারেল মইনকে সেনাপ্রধান করা হয়েছিল। কাজেই সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়ারই ছিল।”
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিজের গ্রেফতার হওয়ার কথা তুলে ধরে তখন বিরাজনীতিকরণের চেষ্টার কথাও বলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। তিনি বলেন, “তারা এসে চেষ্টা করল এক দল গঠন করতে। সেই দল গঠনের ইতিহাস নিশ্চয়ই আপনারা ভুলে যাননি।”
মোবাইল ফোন বাংলাদেশে ছিল না। সেই ব্যবসাটা আমি উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম সকলের কাছে। ড. ইউনূসকেও একটা মোবাইল ফোনের ব্যবসা দিয়েছিলাম। সেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আমাদের ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম এবং গ্রামীণফোনের ড. ইউনূস তারা গেলেন রাজনৈতিক দল করতে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ৭০ জনের তালিকা তৈরি করে দল গঠন করতে গেলেন। জনগণের সাড়াও পেলেন না। দল গঠন করতে পারলে না।”
ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর কিংস পার্টি সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আরেকজন আমাদের ছাত্রনেতা, এক সময় আমাদের সাথেই ছিলেন, তারপরে চলে গেছেন। অনেক দলটল করে আবার ১/১১ এর চলে আসল কিংস পার্টি করতে। সেখানেও জনসমর্থন পেল না।”
বাংলাদেশবিরোধীরাই জেল হত্যার চক্রান্ত করেছিল দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশকে যারা স্বীকার করতে পারে নাই, স্বাধীন বাংলাদেশটাই যারা চায় নাই, তাদের দোসররাই ১৯৭৫ সালের তেসরা নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছে।”
তিনি বলেন, “পনেরই অগাস্টের ঘটনাকে যারা এক সময় শুধু একটা পারিবারিক ঘটনা হিসেবে অপপ্রচার চালাতে চেষ্টা করেছিল, তাদের আসল উদ্দেশ্যটা ধরা পড়ে যায় তেসরা নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডে।”
১৫ই অগাস্ট ও ৩রা নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে ধ্বংসের চক্রান্ত বলে আখ্যায়িত করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “এই সমস্ত সন্ত্রাসী চক্র, খুনি চক্র, স্বাধীনতাবিরোধী চক্র তারা কিন্তু বসে নেই। তাদের চক্রান্ত চলতেই থাকবে। যত ভালো কাজই আমরা করি না কেন, তাদের মুখ থেকে ভালো কথা বের হবে না। কারণ তারা তো বাংলাদেশের মানুষের কথা ভাবে না।”
১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে কারাগারে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রের হেফাজতে হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনাটি বাংলাদেশে পালিত হয়ে আসছে ‘জেল হত্যা দিবস’ হিসেবে।
এই হত্যাকাণ্ডে খোন্দকার মোশতাক আহমেদ ও জিয়াউর রহমানের যোগসাজশের কথা জানাতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “ওই কারাগারে প্রবেশের যেই অনুমতি, রাষ্ট্রপতি তখন মোশতাক আর জিয়াউর রহমান হচ্ছে সেনাপতি। তাদেরই পরিকল্পনা এবং তাদেরই হুকুমে কারাগারের দরজা খুলে খুনিদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। তারাই হত্যাকাণ্ডটা চালায়।”
তারপর জিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের তথ্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “শুধু হত্যাই করেনি, একটা জাতিকে, একটা প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক এইসব দিয়ে প্রত্যেকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে। তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধ করা এবং কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছে।”
প্রবাসে পিতার হত্যার বিচার দাবির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “১৯৮০ সালে আমি লন্ডনে গিয়ে সেখানে সমস্ত জায়গায় ঘুরে ঘুরে এই হত্যার প্রতিবাদ করেছি এবং ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই ইনকোয়ারি কমিশনের স্যার উইলিয়াম টমাস কিউসি এমপি তাকে জিয়াউর রহমান ভিসা দেয় নাই, বাংলাদেশে আসতে দেয় নাই। জিয়া যদি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নাই থাকবে, তাহলে এই তদন্ত কমিশনের যিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একজন সদস্য, তাকে আসতে দেয়নি কেন? বিএনপি নেতাদেরও আমি বলব, তারা একটু চিন্তা করে দেখুক তো যে কেন আসতে দেয়নি।”
খালেদা জিয়ার শাসনকালেও তাদের মদদ দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “খালেদা জিয়া খুনিদেরকে এমপি বানিয়েছে, পার্লামেন্টে বসিয়েছে। কেন করেছে, যদি খুনির সাথে তাদের সম্পর্ক নাই থাকবে? তাহলে কেন তারা করলো?
“এইভাবেই তারা এদেরকে মদদ দিয়েছে। এরশাদ খুনি ফারুককে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হতে দিয়েছে। দল করতে দিয়েছে। কেন দিল?”
জেল হত্যা দিবসের এই সভায় আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, আব্দুল মতিন খসরু, জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ, দীপু মনি, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপসহ কেন্দ্রীয়, মহানগর নেতাকর্মীরা।