করোনা অভিঘাতে রোজগার নেই দেশের অর্ধেক পরিবারে

|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||

করোনার আর্থিক অভিঘাতে সবথেকে কষ্টে পড়েছে দেশের মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষ। কাজ নেই, আয় নেই। সামনে কতদিন এভাবে চলবে তাও জানা নেই। অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতে আক্রান্ত মানুষ। এমনি পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের আয় রোজগারে করোনার প্রভাব নিয়ে জরিপ করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক।

করোনা মোকাবেলায় অন্যান্য দেশের মত অবরুদ্ধ পরিস্থিতি তথা তথা লকডাউন ঘোষণা না করলেও সরকার সারাদেশে ঘোষণা করে ‘সাধারণ ছুটি’। দুই মাসের বেশী সময়ের এই ‘সাধারণ ছুটি’তে বন্ধ থাকে দেশের সকল অফিস আদালত, কল-কারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও গনপরিবহন। এতে করে সবথেকে বেশী ক্ষতিতে পড়ে দেশের সাধারণ মানুষ। কারখানা বন্ধ থাকায় কাজ থাকে না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বন্ধ হয়ে যায় আয় রোজগার। মানুষ ঘরবন্দি থাকায় বন্ধ হয়ে যায় শ্রমজীবী মানুষের প্রতিদিনকার রোজগার।

ব্র্যাকের জরিপ বলছে, এই সাধারণ ছুটির মধ্যে নানাভাবে ক্ষতিতে পড়েছে দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ। ৫১ শতাংশ পরিবারে কোন আয়ই হয়নি। আর রোজগার না থাকা এসব পরিবারের সংখ্যা গ্রামের চেয়ে শহরেই বেশী। এছাড়া নারীর রোজগারে সংসার চলে এমন পরিবারের আয় কমেছে সবচে বেশী।

গেল ৯ থেকে ১৩ই মে পর্যন্ত ৬৪ জেলার ২ হাজার ৩১৭ জনের ওপর পরিচালিত ওই জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয় মঙ্গলবার ভার্চুয়াল এক সম্মেলনে।

জরিপ পরিচালনাকারী গবেষক দলের সদস্য ইফফাত আনজুম আনিকা বলেন, দৈনিক মজুরির ওপর নির্ভরশীল ও স্বল্প আয়ের মানুষদের ৬২ শতাংশ চাকরি বা উপার্জনের সুযোগ হারিয়েছেন। আর্থিক কর্মকাণ্ডের দিক থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন ২৮ শতাংশ মানুষ।

আয়ের পরিমাণে কমতির চিত্র তুলে ধরে জরিপের ফলাফলে বলা হয়, সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার আগে যেখানে পরিবার বা খানাভিত্তিক গড় মাসিক আয় ছিল ২৪ হাজার ৫৬৫ টাকা, সেখানে মে মাসে তা ৭৬ শতাংশ কমে ৭ হাজার ৯৬ টাকায় নেমে আসে। আয় কমার এই হার শহর অঞ্চলে ৭৯ শতাংশ এবং গ্রামে ৭৫ শতাংশ।

জেলা বিবেচনায় আয় কমেছে সবথেকে বেশী পিরোজপুরে ৯৬ শতাংশ। এরপরেই কক্সবাজার ৯৫, রাঙামাটি ৯৫, গাইবান্ধা ৯৪, এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৯৩ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে।

ইফফাত আনজুম আনিকা জানান, পুরুষ-প্রধান পরিবার বা খানার চেয়ে আর্থিক দিক থেকে ’কিছুটা বেশি’ নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে নারী-প্রধান খানাগুলো। তিনি বলেন, “নারী-প্রধান খানার আয় কমেছে ৮০ শতাংশ, অন্যদিকে পুরুষ-প্রধান খানার আয় কমেছে ৭৫ শতাংশ। নারী-প্রধান খানাগুলোর মধ্যে ৫৭ শতাংশ জানিয়েছে, বর্তমানে তাদের কোনো উপার্জনই নেই। এই হার পুরুষ-প্রধান খানাগুলোর ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ।

করোনার এমনিতর আর্থিক অভিঘাত মোকাবেলা ও দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন পরিকল্পনাসমূহ এবং বিবিধ প্যাকেজ ও প্রণোদনা ‘দারিদ্র্যবান্ধব দৃষ্টিকোণ’ থেকে নেওয়া ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে ব্র্যাক। একইসঙ্গে সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রয়োজন এমন পরিবারগুলোর উন্মুক্ত তথ্যভাণ্ডার তৈরির পরামর্শ দিয়ে বেসরকারি এই উন্নয়ন সংস্থা এ কাজে ব্যক্তি ও এনজিওকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে।

গেরস্থালি সহিংসতা

শুধু আয় রোজগারই নয় করোনাকালে পারিবারিক সহিংতার মাত্রা নিয়েও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে জরিপে অংশ নেওয়া বেশীর ভাগ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা আগের মতোই আছে। ১১ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা মনে করেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে। আয় রোজগার না থাকা ও দারিদ্র্য বাড়াকে পারিবারিক সহিংসতা বাড়ার কারণ হিসাবে জানিয়েছেন ৫৮ ভাগ উত্তরদাতা।

করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধির প্রয়োগ

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রসঙ্গে মোট উত্তরদাতার চার ভাগের তিন ভাগ (৭৬%) জানিয়েছেন, তারা সংক্রমণ রোধে সম্ভব সব ব্যবস্থা নিয়েছেন। বাকিরা বলেছেন, তারাও স্বাস্থ্যবিধি মানেন তবে তা অনিয়মিত। যা আশঙ্কাজনক।

জরিপে অংশ নেওয়া ৭৮ শতাংশ মানুষ মনে করেন, তারা করোনাভাইরাস সংক্রমিত হবেন না। এ বিশ্বাস গ্রামাঞ্চলেই সবথেকে বেশী ৮১ শতাংশ। আর শহরের ৭১ শতাংশ মানুষ মনে করেন তারা করোনায় সংক্রমিত হবেন না।

করোনাকালে অর্থ ও খাদ্যসহায়তা ব্যবস্থাপনা

করোনাকালে রাষ্ট্রিয় ও অরাষ্ট্রিয় সহায়তা ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে উত্তরদাতাদের ৩৮ শতাংশ মনে করেন, অভাবী পরিবারগুলোর কাছে সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আরো সমন্বয় প্রয়োজন। আর উত্তরদাতাদের মধ্যে শহর এলাকার ৬২ শতাংশ অধিবাসী সহায়তার প্রয়োজনের কথা জানান। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে এই ৭২ শতাংশ।

জরিপের ফল প্রকাশের ভার্চুয়াল আলোচনায় যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক সাবেক প্রধান সমন্বয়কারী আবুল কালাম আজাদ বলেন, “সরকার শ্রমঘন খাতকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছে, যাতে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা যায়। প্রবাসফেরত শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পরামর্শও দেন তিনি।

শামেরান আবেদ, ঊর্ধ্বতন পরিচালক, ব্র্যাক

ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এবং ব্যবসায় উদ্যোগগুলোর কাছে আর্থিক সহায়তা পৌঁছাতে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার ভূমিকার কথা জানিয়ে ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক শামেরান আবেদ বলেন, “ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা বেশ চ্যালেঞ্জিং, কারণ তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো নতুন ব্যবস্থার প্রসার প্রয়োজন। একবার এই ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেই মানুষ সহজেই আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে।”

বাংলাদেশে ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জী বলেন, “কাউকে পেছনে ফেলে যাওয়ার উপায় নেই। সেবার দ্বৈততা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার চেয়ে এটাই বেশি জরুরি। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের জন্য সার্বজনীন সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।”

ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কেএএম মোর্শেদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান এবং ব্র্যাকের পরিচালক নবনীতা চৌধুরী আলোচনায় যোগ দেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন