|| আদালত প্রতিবেদক, ঢাকা ||
বাংলাদেশ সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রোবার ঢাকায় মারা গেছেন। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে রোবার সন্ধ্যায় তিনি মারা যান। গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হয় তার। ওইদিন থেকেই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। এর মধ্যে ১৮ই সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হবার পর থেকে তিনি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র আইসিইউতে ছিলেন। সেখানেই রোববার সন্ধ্যা ৭টা ২৫মিনিটে তিনি মারা যান। মৃত্যুসময়ে তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।
রাষ্ট্রপতি প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সরকারের প্রধান এই আইনজীবীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত মাহবুবে আলমই ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা অ্যাটর্নি জেনারেল। দেশের ১৫তম অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ২০০৯ সালের ১৩ই জানুয়ারি থেকে সরকারের পক্ষে আইনী দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি। এর আগে ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাদেশে এমন এক সময় অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বে ছিলেন যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বিচার বিভাগকে ঘিরে নানা বিতর্কের কারণে সারাক্ষণই তার দপ্তর ছিল গণমাধ্যমের মনোযোগের কেন্দ্রে। এটর্নি জেনারেল হিসেবে সবসময় মিডিয়ার স্পটলাইটে ছিলেন মাহবুবে আলম।
তিনি দীর্ঘকাল একজন আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের নেতৃত্বও দিয়েছেন। সাবেক আইনমন্ত্রী আইনজীবী শফিক আহমেদ এক সময় প্রয়াত এই অ্যাটর্নি জেনারেলের শিক্ষক ছিলেন, যিনি বলছিলেন মি. আলমকে তিনি ছাত্র এবং পরে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছেন।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, “উনি যখন সিটি ল’ কলেজের ছাত্র ছিলেন, তখন আমি সেখানকার প্রিন্সিপাল ছিলাম। পরে যখন সে অ্যাটর্নি জেনারেল, আমি তখন আইনমন্ত্রী। আইনজীবী হিসেবে তার দক্ষতা এবং সক্ষমতা বিবেচনা করেই তাকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। আইনজীবী ও অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তিনি অত্যন্ত সিনসিয়ার এবং সততা নিয়ে কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় মাহবুবে আলমের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মৌছামান্দ্রা গ্রামে ১৯৪৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি মাহবুবে আলমের জন্ম। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ১৯৬৯ সালে লোক প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ জানিয়েছেন, ছাত্র জীবনে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মাহবুবে আলম পরে পুরোপুরি আইন পেশায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছিলেন, আইন পেশায় আসার শুরু থেকেই মাহবুবে আলম আইনজীবীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ ও ষোড়শ সংশোধনী মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী ছিলেন।
শাহদিন মালিক বলেন, “উনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি ছিলেন, আবার সরকার নিয়োজিত অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ থেকেই একটা ধারণা পাওয়া যায় যে আইনজীবীদের মধ্যে উনার জনপ্রিয়তা কতটা ছিল এবং একইভাবে সরকারের জন্যও উনার প্রয়োজনীয়তা কত বেশি ছিল। উনি সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমরা অবাক হয়ে ভাবতাম, বিভিন্ন কোর্টে সরকারের হয়ে ১০টা, ১৫টা কোনদিন ২০টা মামলায় এক-ই দিনে উনি যুক্তিতর্ক হাজির করেছেন। আমরা ভাবতাম একজন মানুষ এক-ই দিনে এতগুলো কাজ করে কিভাবে!”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মামলায় আইনজীবী হিসেবে যুক্ত ছিলেন মাহবুবে আলম। তিনি বিডিআর বিদ্রোহ হত্যা মামলা, এবং সর্বোচ্চ আদালতে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধ মামলার মতো অনেক আলোচিত মামলার আইনজীবী ছিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে পদাধিকারবলে তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।