|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||
প্রবাদে আছে, নগর পুড়লে দেবালয় রক্ষা পায়না। মারী ও মন্বন্তরে আমীর-ফকিরের ভেদ নেই, এমন কথাও শোনা যায়। কিন্তু বিদ্যমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোয় করোনা ভাইরাসের অভিঘাতে চিরাচরিত এই প্রবাদ প্রতীয়মান হয়েছে প্রমাদ হিসেবে। লকডাউন, লে-অফ, নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির চাপে সমাজের বেশীর ভাগ মানুষ পিষ্ট হলেও একইসময়ে পুষ্ট হয়েছে মুষ্টিমেয় ধনিক জনগোষ্ঠী।
কোভিড-১৯ এর কালে নিম্ন ও মধ্য আয়ের বিপূল সংখ্যক মানুষ আয়বঞ্চিত হয়ে দারিদ্র্যসীমার কাছে বা নিচে নেমে গেছে। স্বল্পবিত্ত পড়েছে দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে আর নিম্নবিত্ত হয়েছে নিঃস্ব ও হতদরিদ্র। যদিও একই সময়ে স্ফীত হয়েছে অল্প সংখ্যক অতি ধনী মানুষের আয় ও সম্পদ। আমেরিকা থেকে এশিয়া–বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত অন্তত আধ ডজন প্রতিবেদনে এমন চিত্রই উঠে এসেছে।
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/10/Rich-Poor-04-700x392.jpg?resize=700%2C392&ssl=1)
বিশ্বজুড়ে অতি ধনীদের সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত সুইস ব্যাংক ইউবিএস বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হবার সময়টাতেই সম্পদ সঞ্চয় খুব ভালোভাবেই করেছেন বিশ্বের অতিধনী জনগোষ্ঠীর সদস্যরা।
করোনা অভিঘাতে গেলো এপ্রিল-জুলাই সময়ে বিভিন্ন দেশে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ নগরজীবনের ব্যয় মেটাতে না পেরে গ্রামমুখী হয়। আর তখন আগে থেকে শত কোটি ডলারের সমপরিমাণ সম্পদের মালিক বিলিয়নেয়ারদের উপার্জনের পানসি যেন পালে নতুন হাওয়ার দোলা পায়। এই সময়ে নিজেদের সামষ্টিক সম্পদের পরিমাণ আগের তুলনায় সাড়ে ২৭ শতাংশ বা ১০ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি বাড়িয়ে নিতে সমর্থ হন বিলিয়নেয়াররা।
মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে সীমিত মাত্রার লকডাউন শুরু হয় বাংলাদেশে। এর জেরে দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশে নিম্নবিত্তের আয় ৭৫ শতাংশ কমে যায় বলে এপ্রিলের প্রথমার্ধে ব্র্যাকের এক জরিপে উঠে আসে। ৩১শে মার্চ থেকে ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত ওই জরিপে করোনার অভিঘাতে দেশে চরম দারিদ্র্যের হার ৬০ শতাংশ বেড়ে যায়। নিম্ন আয়ের ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে খাবার ছিল না বলে জরিপ প্রতিবেদনে জানানো হয়।
বাংলাদেশের মতো প্রায় একই বাস্তবতা দেখা গেছে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। দেশটির কয়েক কোটি পরিযায়ী শ্রমিক আকষ্মিক বেকারত্বের ধাক্কায় পশ্চিম ও উত্তর ভারতের বড় শহরগুলো ছেড়ে শত শত মাইল পায়ে হেঁটে নিজগ্রামে ফিরতে বাধ্য হয়। করোনা অভিঘাতে ভারতের অন্তত এক কোটি ২০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যে পড়েছে বলে মে মাসে বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়। একই সময়ে সারাবিশ্বে কমপক্ষে চার কোটি ৯০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্য বরণে বাধ্য হতে পারে বলেও উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক।
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/10/Rich-Poor-01-700x392.jpg?resize=700%2C392&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/10/Rich-Poor-01-700x392.jpg?resize=700%2C392&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/10/Rich-Poor-01-700x392.jpg?resize=700%2C392&ssl=1)
বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের অভিঘাত সম্পর্কে শঙ্কার আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। মহামারীর ধাক্কায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে প্রাক্কলণ করেছে সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া ইকনোমিক ফোকাস রিপোর্টে বলা হয়েছে, মহামারীর অভিঘাত দীর্ঘ হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়া নজিরবিহীন অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা, লাখ লাখ মানুষকে এই মহামারী চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যেখানে গত পাঁচ বছর ধরে প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের উপরে থাকছিল।
বাংলাদেশ, ভারত ও অন্যান্য দেশে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকায় করোনা এমন করুণ আঘাত হানলেও অতি ধনীদের ক্ষেত্রে গল্পটি পুরোপুরিই ভিন্ন।
বিশ্ব ব্যাংকের সাউথ এশিয়া ইকনোমিক ফোকাস রিপোর্টের একদিন আগে বুধবার প্রকাশ হয়েছে ফোর্বস ইন্ডিয়া রিচ লিস্ট। এতে দেখা যায়, ভারতের শীর্ষ একশো ধনীর মধ্যে বেশিরভাগেরই সম্পদ বেড়েছে করোনাকালে। এক্ষেত্রেও অতিধনীদের মধ্যে যে বেশি সম্পদশালী, তার সম্পদ বেড়েছেও বেশি। টানা ১৩ বছর ধরে ভারতের শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানির সম্পদ এই অতিমারিতেও আগের চেয়ে ৭৩ শতাংশ বেড়েছে। কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের আগে ৬০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদের মালিক মুকেশ আম্বানির ঐশ্বর্যভাণ্ডারে এই সময়ে নতুন যোগ হয়েছে ৩৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। গতকাল নাগাদ তার মোট সম্পদ আট হাজার ৮৭০ কোটি ডলার।
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/10/Mukesh-Ambani.jpg?resize=314%2C234&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/10/Mukesh-Ambani.jpg?resize=314%2C234&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/10/Mukesh-Ambani.jpg?resize=314%2C234&ssl=1)
মুকেশ আম্বানি একা নন। করোনার অভিঘাতের মধ্যেই সম্পদ বাড়াতে সমর্থ হয়েছেন ভারতের অন্য ধনকুবেররাও। গত কয়েকমাসে ভারতের শীর্ষ একশো ধনকুবেরের সম্পদে সামষ্টিক ধনপ্রবৃদ্ধির পরিমাণ ৫১৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
করোনার অভিঘাতে বৈশ্বিক শেয়ার বাজারে দর ওঠানামার বাজি ধরেই ধনকুবেররা নিজ নিজ সম্পদ বাড়াতে সমর্থ হয়েছেন বলে ইউবিএস তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে। সুইস ব্যাংকটির গ্লোবাল ফ্যামিলি অফিস ডিপার্টমেন্টের হেড জোসেফ স্টাডলারের ভাষায়, কোভিড সংকটের সময় বিলিয়নেয়াররা কেবল ভাটির টান সামলে নেননি, জোয়ারের স্রোতকেও তারা নিজেদের অনুকূলে নিতে পেরেছেন।
করোনাকালে বিলিয়নেয়ারদের শুধু সম্পদ বাড়েনি, সংখ্যাও বেড়েছে। বৈশ্বিক এ সংকটের মধ্যেই বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ১৮৯ জন, যা ২০১৭ সালে ছিল দুই হাজার ১৫৮। করোনাকালে সম্পদ বাড়ার তালিকায় বড় জায়গা দখল করে আছে শিল্পপতিরা। এপ্রিল-থেকে জুলাই সময়কালে শিল্পপতি ধনকুবেরদের সম্পত্তির পরিমাণ ৪৪ শতাংশ বেড়েছে, যা তাদের মালিকানাধীন শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধিকেই ইঙ্গিত করে বলে ইউবিএস জানিয়েছে।
তবে অতিধনীরা শেয়ারবাজারেই বাজিমাত করেছেন–ইউবিএসের এমন ভাষ্য সত্য হলেও সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরে না। ভারতীয় ধনকুবেরদের সম্পদ বৃদ্ধি দেখে বোঝা যায়, অতিধনীদের সম্পদের স্ফীতিতে শেয়ারবাজার একমাত্র অনুঘটক নয়। মুকেশ আম্বানি, গৌতম আদানি ও তাদের স্বদেশী বিলিয়নেয়ারদের সম্পদে বিগত মাসগুলোতে যে ৫১ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার যোগ হয়েছে তাতে পুঁজিবাজারের সংযোগ সামান্যই। কারণ ভারতের মূল শেয়ারবাজার বোম্বের বিএসই সূচক প্রায় বছরখানেক ধরে আলুথালু পড়ে আছে।
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/10/Skyscraper-700x394.jpg?resize=700%2C394&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/10/Skyscraper-700x394.jpg?resize=700%2C394&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/10/Skyscraper-700x394.jpg?resize=700%2C394&ssl=1)
ইউবিএসের তত্ব শতভাগ স্পষ্ট মার্কিন বিলিয়নেয়ারদের সম্পদবৃদ্ধির চিত্রে। দেশটির থিংকট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ জুন মাসে এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, ১৮ই মার্চের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়নেয়ারদের সম্পদে নতুন ৫৬৫ বিলিয়ন ডলার যোগ হয়েছে। একই সময়ে বেকারত্ব, চাকরিচ্যুতি যে মাত্রায় দেখা গেছে তার তুলনা শুধু গত শতাব্দীর গ্রেট ডিপ্রেশনের সঙ্গেই হতে পারে বলে খোদ মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের ভাষ্য।
ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ধনী ১০ ভাগ পরিবারের সদস্যরাই দেশটির পুঁজিবাজারের মোট শেয়ারের ৮৪ শতাংশ করায়ত্ত করে রেখেছে। এ অবস্থায় ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান নির্বিশেষে সব সরকারই নিজেদের সফল দেখাতে পুঁজিবাজার চাঙ্গা রাখতে চায়। আর পুঁজিবাজার চাঙ্গা থাকলে লাভবান হয় সবচেয়ে ধনী ওই ১০ শতাংশ মার্কিন পরিবার। কাজেই, নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো ও বাস্তবতায় নগর পুড়লেও দেবালয়ে আঁচ লাগেনা।