|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||
সারাবিশ্বকে অবরুদ্ধ করা আর আতঙ্কে ছড়িয়ে দেওয়া করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে আজ সোমবার বাংলাদেশে উদযাপিত হবে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর।
ঈদ শব্দের অর্থ হচ্ছে আনন্দ; কিন্তু দেশের বাঙালি মুসলমানদের কাছে এবার ঈদের সেই মানে নেই; তার বদলে অবরুদ্ধ আর গৃহবন্দি অবস্থায় থেকে থেকে দুঃসময় পার হওয়ার অপেক্ষায় তারা।
ছোঁয়াচে এই রোগের সংক্রমণ এড়াতে ঈদ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে বলেছেন ঘরে থেকে ঈদ উদযাপন করতে। ঈদের জামাত হলেও কোলাকুলির চেনা দৃশ্য এবার থাকবে অনুপস্থিত; ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে হাত মেলানোও থাকবে বন্ধ।
ধর্ম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সংক্রমণ এড়াতে এবার ঈদ জামাত হবে কেবল মসজিদে, তাতে অংশ নিতে হবে বিধিনিষেধ মেনে। সবাইকে বাসা থেকে ওজু করে মসজিদে যেতে হবে মাস্ক পরে। কাতারে দাঁড়াতে হবে দূরত্ব রেখে। নামাজ শেষে কোলাকুলি বা হাত মেলানো যাবে না। করোনাভাইরাস অতি সংক্রামক বলেই এ ব্যবস্থা।
ঢাকায় প্রতিবার সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় জাতীয় ঈদগাহসহ ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঈদ জামাতের আয়োজন করা হলেও এবার তা হচ্ছে না। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে বরাবরের মতই পাঁচটি ঈদ জামাতের আয়োজন থাকছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সেখানে থাকছে বিশেষ ব্যবস্থা।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, বায়তুল মোকাররমে প্রথম জামাত হবে সোমবার সকাল ৭টায়। এরপর সকাল ৮টা, ৯টা, ১০টা এবং পৌনে ১১টায় হবে বাকি চারটি ঈদ জামাত।
আবহাওয়া ভালো থাকলে এমনিতে দেশে ঈদের প্রধান জামাতটি হয় ঢাকায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সেই জামাতে নামাজ পড়েন ঈদের সকালে। এবার তা হচ্ছে না।
প্রতিবছর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ ঈদ জামাতের আয়োজন হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয় খোলা মাঠে ঈদ জামাত আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় শোলাকিয়া ময়দানেও এবার জামাত হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী।
রোববার নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, “সব ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলবেন। কমপক্ষে ৩ ফুট সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঈদের জামায়াতে শরিক হবেন। সব মুসলিম ভাইয়ের প্রতি অনুরোধ, ঈদে কোলাকুলি থেকে বিরত থাকবেন।”



আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সোমবার রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ এলাকায় বৃষ্টি থাকবে না। রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও বৃষ্টি হতে পারে। অন্যত্র আকাশ আংশিক মেঘলাসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকবে।
করোনাদুর্যোগে অস্বাভাবিক এমনি এক ঈদুল ফিতর উদযাপন করবে আজ দেশের মানুষ। দেশের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর আজ। করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে ঘরবন্দিত্বে দেশের মুসলমানরা ঈদের জামাতে নামাজ পড়লেও করবে না কোলাকুলি। মেলাবে না বুকে বুক। এ যেন এক অন্যরকম ঈদ! এমন ঈদ বোধ করি এই ধর্মের শুরু থেকে গেল দেড় হাজার বছরে কেউ দেখেনি।
এমন এক সময়ে ঈদ এসেছে যখন দেশে লাফিয়ে বাড়ছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা। রোববার এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা গেছে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২৮ জন মানুষ। সরকার ঘোষিত ‘সাধারণ ছুটি’ জারি থাকলেও অন্যসব ক্ষেত্রে সরকারি কড়াকড়ি বেশ শিথিল করা হয়েছে।
এরইমধ্যে রাজধানীসহ সারাদেশেই সরাকারি নির্দেশনায় খুলেছে দোকানপাট। ব্যক্তিগত গাড়িতে করে ঈদে বাড়ি যেতে পারবেন এমন সরকারি নির্দেশনায় সড়কেও ছিল এমনসব ছোট গাড়ির ভিড়। প্রাইভেট কার, পিকআপ বা অটোতে করে নানা ভোগান্তির ভেতর দিয়ে অসংখ্য মানুষ তাদের গ্রামের বাড়ির পথে গেছেন।



সাধারণত প্রতিবছর ঈদের আগে আগে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী প্রধান দুই ফেরিতে যানজট লেগে যায়। এবার নৌ চলাচল বন্ধ থাকায় গত কয়েকদিন দেখা গেছে উপচে পড়া মানুষের ভিড়। তবে ঈদের আগের দিন রোববার ভিড় খানিকটা কমেছে বলে জানিয়েছেন পাটুরিয়া ফেরি ঘাটের কর্মকর্তা মহিউদ্দিন রাসেল।
তিনি বলছেন, গত কয়েকদিনের তুলনায় আজ (রোববার) ভিড় নেই, একদম ফাঁকা। মানুষজনও কম, গাড়িও কম। একেকটা ফেরিতে ৪০/৫০জন করে পার হচ্ছেন।
অন্যদিকে ১০ই মে থেকে দোকানপাট খুলে দেয়া হলেও, এবার ঈদে তেমন বিক্রিবাট্টা হয়নি বলেই জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সাধারণত ঈদের আগের রাত চাঁদ-রাত বলে এদিন দোকানপাটে কেনাকাটার ভিড় লেগে যায়। কিন্তু এবার সেরকম ভিড় কোথাও দেখা যায়নি।
ঈদ আয়োজনেও এসেছে পরিবর্তন। কোলাকুলি না করা, নিজ বাড়িতে ঈদ উদযাপনের মতো পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। এবারই প্রথম দেশের কোন ঈদগায়ে জামাত অনুষ্ঠিত হবে না।
এমন অবস্থায় এবারের ঈদকে ‘অস্বাভাবিক’ হিসাবে মূল্যায়ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
তিনি বলেন, ”এ এক অস্বাভাবিক ঈদ। এই ঈদের মতো ঈদ আমরা কখনও দেখি নাই। একাত্তরের সালে ঈদ এসেছিল আতঙ্কের মধ্যে। এবার তো মানুষ বেরোতেই পারছে না। ঈদের অনেক অনুষঙ্গ থাকে। অনেক আনন্দের উপলক্ষ তৈরি হয়, কেনাকাটা হয়। বোনাস পেলে বিপুল কেনাকাটা হয়, তাতে বিক্রেতাদের মধ্যেও লাভের বিষয় থাকে। এবার তা নেই।”
ঈদের অনুষঙ্গে সামাজিক মেলামেশা দিক এবার বিতাড়িত হওয়ার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, “ঈদ শিশু-কিশোরদের জন্য এটা বড় আনন্দের উপলক্ষ, তারা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে। এবার তো তারা বড় বিপদের মধ্যে আছে। ঈদের আনন্দটা আর পাওয়া যাচ্ছে না। ঈদের যে সামাজিকতা আছে, সেটাও নাই। মানুষ আত্মীয়-স্বজনকে দেখতে বাড়ি যায়, এবার যাচ্ছে না। উল্টো ভীতির মধ্যে আছে।”
রাষ্ট্রপতির ঈদ শুভেচ্ছা
‘ভিন্ন প্রেক্ষাপটে’ আসা ঈদ উদযাপনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।



ঈদ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে তিনি বলেন, “বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সৃষ্ট মহামারীর ফলে এ বছর ঈদুল ফিতর ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পালিত হবে। এ কঠিন সময়ে আমি সমাজের স্বচ্ছল ব্যক্তিবর্গের প্রতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি বলেছেন, “একই সাথে আমি দেশবাসীর প্রতি যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে ঈদুল ফিতর উদযাপনের আহ্বান জানাচ্ছি। নিজে ভালো থাকি-অন্যকে ভালো রাখি – এটাই হোক এবারের ঈদে সকলের প্রত্যাশা।”
প্রধানমন্ত্রীর বানী
ঈদ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে ‘অস্বাভাবিক পরিবেশের’ কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকানোর লড়াইয়ে সামনের দিকে থাকা মানুষদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, ”এই বিপদের সময় আমাদের স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ যারা জীবন বাজি রেখে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”



শেখ হাসিনা বলেন, “অস্বাভাবিক পরিবেশে এবার ঈদুল ফিতর উদযাপন করছি। করোনাভাইরাস সমগ্র বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এক অদৃশ্য ভাইরাস মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
”আমরা বাধ্য হচ্ছি নিজ নিজ অবস্থানে ধৈর্য্য সহকারে অবস্থান করতে যাতে অপরকে সংক্রমিত না করি বা নিজে সংক্রমিত না হই।”
সহনশীল ও সহানুভূতিশীল মনে একে অপরকে সাহায্য করার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “পাশাপাশি আমি করোনাভাইরাসের এই মহামারীতে অনুরোধ করব, যথাসম্ভব গণজমায়েত এড়িয়ে আমরা যেন ঘরে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করি এবং আল্লাহ্তায়ালার দরবারে বিশেষ দোয়া করি যে এই সংক্রমণ থেকে আমরা সবাই দ্রুত মুক্তি পাই।”