করোনারোগীদের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রাখার অভিযোগ ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে

|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||

রাজাধানীর গুলশানের অভিজাত হিসেবে পরিচিত ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুনে করোনাসংক্রমিত যে পাঁচ রোগী মারা গেছেন তাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রাখা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনশেষে একথা জানান, ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশিষ বর্ধন।

অব্যবস্থাপনা আর আগুন নেভানোর সরঞ্জামের খামতির কথা জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনিও বৃহস্পতিবার আগুনে পোড়া আইসোলেশন সেন্টার দেখতে গিয়ে বললেন, এর দায় কোনভাবেই এড়াতে পারেন না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

আগুনের ঘটনা তদন্তে গঠিত ফায়ার সার্ভিস দফতরের কমিটির প্রধান দেবাশীষ বর্ধন বলেন, “এটা ভেরি রিস্কি ছিল (খুব ঝুঁকিপূর্ণ), ভেরি রিস্কি। যারা মারা গেছেন তারা ঠিক সানশেডের নিচে মারা গেছেন।”

শুধু ইউনাইটেডই নয়, দেশের হাসপাতালগুলোতে করোনাসংক্রমিতদের প্রতি অবহেলার অভিযোগ এনে স্বজনরা বলে আসছেন, হাসপাতালে ভর্তির পর তাদের আশেপাশে কেউ যেতে চায়না। ইউনাইটেড হাসপাতালের ক্ষেত্রেও এটি ঘটেছে কি না জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, ” আপনারা জানেন, করোনা পেশেন্টের আশপাশে কেউ থাকে না। আগুন লাগার পর তারা কেউ বের হতে পারে নাই। হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে।”

রিয়াজুল আলম লিটন করোনা উপসর্গ নিয়ে ভতর্ি হয়েছিলেন ইউনাইটেড হাসপাতালে। আগুনে পুড়ে মারা গেলেন তিনি
ছবি: সংগৃহিত

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধনের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন ফায়ার ব্রিগেড ট্রেনিং সেন্টারের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বাবুল চক্রবর্তী, উপ-সহকারী পরিচালক নিয়াজ আহমেদ এবং বারিধারার জ্যেষ্ঠ স্টেশন অফিসার মো. আবুল কালাম আজাদ।

দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ‍“এই হাসপাতালটির আগুন নেভানোর দায়িত্বে আছেন একজন কর্মকর্তা, যিনি ঘটনার সময় বাসায় ছিলেন। তাই সে নিয়ে আমাদের বলার কিছু নাই, কিন্তু উনি তো ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের জন্য একটি দল গঠন করে দেবেন। ওনাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দেখে আমরা মন্তব্য করেছি যে, হাসপাতালের ফায়ার সেফটি ম্যানেজমেন্ট নামমাত্র; কাজে কেউ ছিল না।”

হাসপাতালে কতজনের অগ্নিনির্বাপক দল রয়েছে জানতে চাইলে দেবাশীষ বর্ধন বলেন, “আমিও তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু কিছুই বলতে পারে না। নতুন স্থাপিত বর্ধিত অংশেও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। মূল ভবনেরও ১১টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের আটটির মেয়াদ শেষ হয়েছে এক মাস আগেই।”

ফায়ার হাইড্রেন্ট ছিল কিন্তু আগুন লাগার পর সেটির মুখ খুলে দেওয়ার মত কেউ ছিল না সেখানে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাই গিয়ে তা সেটা খুলেছেন বলে জানান দেবাশীষ।

আগুনের কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “পুরোটাতেই বৈদ্যুতিক লাইন দেওয়া ছিল। কোনো ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা ছিল না, কারণ নেগেটিভ প্রেসারের এসি ছিল; এসি ছিল কয়েকটা। যেগুলোর ছবি তোলা হয়েছে এবং বেশ কিছু আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। সবগুলো বিষয় পর্যালোচনা করে কমিটি সিদ্ধান্ত নিবে কোথায় থেকে আগুন লেগেছিল।”

আইসোলেশন সেন্টার সম্পর্কে তিনি বলেন, “এটা একটা টিনশেড। বর্ধিত অংশটির উপরে টিন দিয়ে তার নিচে সিলিং করা হয়েছে। আর বেড়া দেওয়া হয়েছে পারটেক্স ও গ্লাস দিয়ে। এগুলোর সব দাহ্য। সহজেই জ্বলে।”

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “গাফিলতি বলতে চাচ্ছি না। মানুষগুলো কেন মরলো? ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা কী ছিল, কী নাই? অগ্নিকাণ্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতি, কী কী প্রয়োজন ছিল আর কী কী আছে, কী কী ছিল না, তা তদন্ত প্রতিবেদনে দিয়ে দেব।”

এদিকে নিহত পাঁচজনের মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উপ-কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি প্রাপ্ত) আব্দুল আহাদ। আর এ ঘটনায় গুলশান থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

মেয়র আতিকুল যা জানালেন

বৃহস্পতিবার হাসপাতালে আগুনে পোড়া আইসোলেশন সেন্টারটি দেখতে গিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি জানালেন, করোনা আইসোলেশন ইউনিটের আগুন নেভানোর জন্য যে ১১টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা ছিল সেগুলোর আটটিই ছিল মেয়াদোত্তীর্ন।

সাংবাদিকদের আতিকুল বলেন, “এই ধরণের হাসপাতালে রোগী আসে ভালো হবার জন্য। যদি রোগী মারা যায় তাহলে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কোনভাবেই দায় এড়াতে পারে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।”

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দু:খ প্রকাশ

করোনা আইসোলেশন ইউনিটে অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ রোগী নিহত হবার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বুধবার রাতেই একটি বিবৃতি দেয় ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিবৃতিতে বলা হয়, “সম্ভবত বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে আগুন আইসোলেশন ইউনিটের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সেসময় আবহাওয়া খারাপ ছিল এবং বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বাতাসের তীব্রতায় আগুন প্রচণ্ড দ্রুততার সাথে ছড়িয়ে পড়ার ফলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখানে ভর্তি পাঁচজন রোগীকে বাইরে বের করে আনা সম্ভব হয়নি।”

ঘটনার তদন্তে ফায়ার সার্ভিসকে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পূর্ণ সহায়তা করছে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।

পাঁচ রোগীর মৃত্যু

ঢাকার গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে করোনাভাইরাসের রোগীদের ইউনিটে বুধবার রাতে আগুন লেগে মারা গেছে করোনাসংক্রমিত পাঁচ রোগী। বুধবার রাত পৌনে ১০টার দিকে বেসরকারি হাসপাতালটির নিচের চত্তরে করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীদের জন্য স্থাপিত আইসোলেশন ইউনিটে আগুন লাগলে এসব রোগী মারা যান।
তাদের মধ্যে তিনজনের কোভিড-১৯ পজিটিভ আর দুজনের নেগেটিভ ছিল বলে জানিয়েছেন ডিএমপির গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উপ-কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি প্রাপ্ত) আব্দুল আহাদ।

উল্লেখ্য দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে ইউনাইটেড হাসপাতালে করোনাভাইরাস সংক্রমিতদের ভর্তি করা না হলেও মাসখানেক আগে ভর্তি শুরু হয়েছিল। এজন্য হাসপাতালের নিচের চত্তরের একাংশে ‘তাঁবু’ খাটিয়ে করোনাভাইরাস ইউনিট স্থাপন করে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল।

ইউনাইটেড হাসপাতালের চিফ অফ কমিউনিকেশনস অ্যান্ড বিজনেস ডা. সেগুফা আনোয়ার বুধবার রাতেই বলেছিলেন, বৈদুতিক ‘শর্ট সার্কিট’ থেকে আগুন লেগেছে বলে ধারণা তাদের। রোগীদের উদ্ধার করতে না পারার জন্য আবহাওয়াকে দায়ী করে তিনি বলেন, “আগুন লাগার সময় আবহাওয়া খারাপ ছিল, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। তীব্র বাতাসের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে আইসোলেশন ইউনিটে থাকা রোগীদের বাইরে বের করা যায়নি।”

আর পুলিশ উপ-কমিশনার সুদীপ চক্রবর্তী বলেন, “সেখানে এসি ছিল এবং এসির স্পার্ক থেকে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া এখানে যেসব উপাদান ছিল, সবই দাহ্য পদার্থ। এখানে স্যানিটাইজার ছিল, সেগুলোও দাহ্য পদার্থ। সে কারণে খুব অল্প সময়ে আগুন একটা বড় রূপ নেয় এবং পাঁচজন রোগী মারা যান।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন