করোনাদুর্যোগে নির্যাতনে পড়েছে দেশের ৬৫ শতাংশ নারীশিশু

|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||

বিশ্বজুড়েই চলছে এমন এক অতিমারি যা থেকে ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত এই অতিমারির বিরুদ্ধে লড়তে অন্যতম উপায় হিসেবে বলা হচ্ছে ঘরে থাকতে। কেননা করোনাভাইরাস নামের এই জীবানুটি প্রধানত বাতাসেই সংক্রমিত হয় মানুষের শরীরে। সংক্রমিত হয় মানুষে মানুষের সংস্পর্শে। যে কারণে চীনের উহান প্রদেশে যখন প্রথম এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়, তখন থেকে মানুষকে ঘরবন্দি রাখাকেই প্রধানতম প্রতিকার হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। সঙ্গত কারনেই বন্ধ হয়ে যায় রাষ্ট্রের অর্থনীতির সব চাকা। শুধু কি রাষ্ট্র, বন্ধ হয়ে যায় ব্যক্তি পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক সবধরনের আর্থ-সামাজিক কাজকর্ম।

ঘরবন্দি থাকতে থাকতে মানুষের মাঝে বাড়তে থাকে অবসাদ, হতাসা। সেইসঙ্গে কমতে থাকে সঞ্চিত পুঁজির পরিমান। বাড়তে থাকে খাবারের সংকট, ঋণের চাপ, অবসাদ কমাতে কোথাও কোথাও মানুষ ঝুকে পড়ছে মাদকের দিকে। এসবে ফলে পরিবারে বাড়ছে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। বাড়ছে পারিবারিক নির্যাতন। অবস্থানগত কারনে পুরুষরা কিছুটা রেহাই পেলেও এই নির্যাতনের সবথেকে বেশী শিকার হচ্ছে পরিবারের শিশু ও নারীরা। পাশাপাশি প্রাতষ্ঠিানিক কাজকর্মে জড়িত নারীরা হারাতে বাধ্য হচ্ছে তাদের ছোট ছোট পুঁজি, ব্যবসা ও তার দীর্ঘদিনের পরিশ্রম থেকে অর্জিত সম্পদ। তাদের উপর বাড়ছে আগে থেকে ঋণের বোঝা। এসবই বাড়াচ্ছে নারীর অর্থনৈতিক সংকট এবং সামাজিক ঝুঁকি।

করোনাদুর্যোগে কেমন আছেন দেশের ব্যক্তিপর্যায়ের নারীরা, প্রাতিষ্ঠানিক কাজকর্মে জড়িত নারীরা কীভাবে জারি রেখেছেন নিজেদের সংগ্রাম–এসব নিয়ে সম্প্রতি এক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনর স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট (স্টেপস) ও বেসরকারি সংগঠনের সম্মিলিত জাতীয় প্ল্যাটফরম বা ফোরাম জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যালায়েন্স (গ্যাড অ্যালায়েন্স)।

স্টেপস ও গ্যাড অ্যালায়েন্সের যৌথ উদ্যোগে দেশের ১৮টি জেলায় ৫৪টি উপজেলার ২৪০টি ইউনিয়নের প্রায় ৭ হাজার পরিবারের ওপর গেল ২৬শে এপ্রিল থেকে ১০ই মে পর্যন্ত দেশের ৭ হাজার পরিবারে চালানো জরিপ বা পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে উঠে আসা তথ্য বলছে, এসব পরিবারসমূহের মধ্যে ৪ হাজার ৫৫০টি পরিবারেই অভিযোগ পাওয়া গেছে নারী ও শিশু নির্যাতনের। শতকরা হারে এই সংখ্যা ৬৫ শতাংশ।

কোভিড-১৯ মহাদুর্যোগের সময়ে সকল প্রকার কাজ বন্ধ থাকার কারণে নারীদের এতোদিনের অর্জিত সঞ্চয় দিয়ে পরিবারের নিয়মিত খরচ চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নারীরা যখনই বাধা দিচ্ছে তখনই তার ওপর নেমে আসছে বিভিন্ন রকমের নির্যাতন। পর্যবেক্ষণে আরও দেখা গেছে যে, নারীদের তিল তিল শ্রমে এবং মেধায় গড়ে ওঠা ছোট ছোট উদ্যোগ ও ব্যবসার পুঁজি এখন পরিবারের প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে খরচ করতে বাধ্য হচ্ছে, এর ফলে তাদের আগামীদিনের চলার পথ আরও সংকটময় হবে বলে তারা জানিয়েছেন।

সবমিলিয়ে পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রেনারীদের যে অর্থনৈতিক অবদান ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে তাও কমে যাচ্ছে। এছাড়াও এসময়ে স্থানীয় পর্যায়ে বেড়েছে গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদকের সহজলভ্যতা ও এর ব্যবহার।

পর্যবেক্ষণসমূহ:

  • জরিপে অংশ নিয়েছে এমন সাত হাজার পরিবারের মধ্যে ৪ হাজার ৫৫০টি পরিবারে নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছে শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবার। উল্লেখিত পরিবারের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ পরিবারের নারী ও শিশুরা বিভিন্ন ধরনের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এবং পরিবারগুলোতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিনই বাড়ছে।
  • ঘরবন্দি বা লকডাউন সময়ে মানুষের কর্মহীনতা ও আয় রোজগার না থাকার কারণে নারীর সঞ্চিত পুঁজি বা সম্পদ বিক্রি করে পরিবার চালানোর চেষ্টা চলছে। এধরনের কাজে নারীরা বাধা দিলে তাদের ওপর নেমে আসছে নির্যাতন। এসময়ে বাজারে নারীদের আসা-যাওয়ার সুযোগও কমে যাচ্ছে।
  • ঘরবন্দি অবস্থায় পুঁজি হারিয়ে মানুষ দিশেহারা। গ্রামীণ নারীদের ক্ষুদ্র ব্যবসা ও উদ্যোগগুলো বেশীরভাগই ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি পুরুষদের কাজ না থাকায় আরো তীব্রতর হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট।
  • পরিবারে খাবারের যোগান অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন সুদি প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের টাকার মূল অংশ অথবা পুরোটাই খরচ করতে তারা বাধ্য হচ্ছেন নারীরা। ফলে হোচট খাচ্ছে তাদের ছোট ছোট উদ্যোগগুলো।
  • কোথাও কোথাও মাদকসেবীরা টাকা যোগাড় করতে না পারার কারণে ঘরের আসবাবপত্র বিক্রির উদ্যোগ নিলে, পরিবারের সদস্যরা তাতে বাধা দিলে বাড়ছে নির্যাতন এবং যার বেশীর ভাগ শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা।
  • দুর্যোগ সময়ে নানা বিধিনিষেদের কারনে সামাজিক সংগঠনসমূহ নির্যাতনের শিকার নারীদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না। ফলে নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে তোলাও সম্ভব হচ্ছে না।
  • মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়া, হাতে টাকা না থাকা, খাবারের অভাব এবং পরিবারের নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় বাড়ছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত।
  • শ্রমজীবী পরিবারগুলোর পুরুষ সদস্যরা কাজের প্রয়োজনে এসময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করে শ্রম দিয়ে আয় করে থাকেন। অন্যদিকে নারী সদস্যরা তাদের ছোট ছোট উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে আয় করেন। এ ধরনের যৌথ আয় থেকে বছরের একটা বড় সময় তারা পরিবারের খরচ মিটিয়ে থাকেন। লকডাউন তথা ঘরবন্দিত্বের কারণে এবার তারা এধরনের কাজ এবং আয় করতে পারছেন না। ফলে পরিবারেও বাড়ছে সামনের দিনগুলো কেমন করে পাড়ি দেবেনে সেই চিন্তা।
  • কর্মহীন হয়ে একদিকে মানুষের ঘরবন্দি থাকা, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ কমে যাওয়ায় অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই। এছাড়াও প্রতিনিয়ত পরিবারের নানা প্রয়োজনের মুখোমুখি হয়ে তা মেটানোর সামর্থ্য না থাকায় বাড়ছে পারিবারিক নির্যাতন।
  • করোনায় রাষ্ট্রিয় ও বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসুশ্রষার বেহাল দশায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাও পাচ্ছেন না গ্রামীণ ও শহুরে নারী শিশুরা।
  • কোথাও কোথাও রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি তরফ থেকে পাওয়া খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা কম মূল্যে বিক্রি করে মাদক ক্রয় ও ব্যবহারের প্রবণতাও বাড়ছে।
  • বেসরকারি সংগঠনগুলোর ঋণ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় নারীরা মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে পরিবারের নানা চাহিদা মেটাতে বাধ্য হচ্ছেন। যা বিশেষ করে নারীদের ফেলছে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায়।
  • খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা সংগ্রহে ব্যর্থ হবার কারণেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন পরিবারের নারী ও শিশুরা। এর পাশাপাশি বাল্যবিয়ের প্রবণতাও বাড়ছে।
  • করোনাপরবর্তী সময়ে স্কুলগামী মেয়েশিশুদের ড্রপআউট এবং বাল্যবিয়ে হার বাড়ার আশঙ্কাও জানিয়েছেন জরিপে অংশ নেওয়া পরিবারগুলো।
  • স্থানীয় পর্যায়ে মাদক প্রাপ্তি সহজতর হওয়ায় একদিকে আসক্তি এবং এর ব্যবহার বেড়ে চলেছে। কোথাও কোথাও ব্যবসায়ীরা বাকিতে মাদক সরবরাহ করে স্টক শেষ করে নিজেদের নিরাপদ রাখছেন। ফলে বাড়ছে মাদকসেবীদের ঋণের চাপ। এটিও বাড়াচ্ছে পারিবারিক নির্যাতন।
  • গ্রামীণ জনপদে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীদের নামে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে, ইতোমধ্যে ঋণের টাকা পরিবারের প্রয়োজনে ব্যয় হয়েছে। ফলে আগামী দিনে কিস্তি বা মূল টাকা কীভাবে পরিশোধ হবে, সে নিয়েও গ্রহিতা নারীদের মধ্যে বাড়ছে মানসিক চাপ।
  • দূর্যোগের এই সময়ে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ড ও প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকা নারীরাও ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক চাপের কারণে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছেন না। যা গুরুত্বহীন করে ফেলছে তাদের অবস্থানকে। বাড়ছে আগামীতে নারীদের বিভিন্ন কর্মকান্ডে যুক্ত হবার বিষয়ে অনিশ্চয়তা। যা হতাশায় ফেলছে নারীদের।
  • করোনার এই ক্রান্তিতে নারীদের অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এবং গর্ভপাতের ঘটনাও বাড়ছে।

নির্যতনের ধরন:

  • পারিবারিক নির্যাতনের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, শারীরিক নির্যাতন, ঝগড়া, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া, খেতে না দেওয়া, ঘরে আটকে রাখা, খারাপ ব্যবহার করা, নারীকে ত্রাণ সংগ্রহের কাজে ব্যবহার, খাবারের সংকটের কারণে শিশু-নারী নির্যাতন, অভাবের কারণে স্ত্রী ও সন্তানকে মারধর, শিশু নির্যাতন, তালাক। এছাড়াও পরিবারের প্রয়োজনে কিংবা স্বামীর চাপে নারীদের সর্বশেষ জমানো টাকা তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
  • বাপের বাড়ি থেকে টাকা বা খাবার আনার জন্য নারীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, ফলে বাড়ছে তালাকের আশঙ্কা। এর পাশাপাশি বাড়ছে নারীদের কাজের চাপ। বয়স্কা নারীদের প্রতি বাড়ছে পরিবারের অন্য সদস্যদের অবহেলা। এ ছাড়া এই সময়ে নারীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাড়ছে ধর্ষণের মত ঘটনাও। স্বামীর মাদকের টাকা দিতে না পারায় কিংবা না দেওয়ায় নারীদের মারধরের শিকার হতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও নারীরা বাধ্য হচ্ছেন যৌন পেশা বেছে নিতে।

পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিত ও সময়কাল

সাম্প্রতিক সময়ে পত্রপত্রিকায় নারী ও শিশু নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হতে থাকলে স্টেপস্ এর কর্মএলাকায় ১৮টি জেলায় ৫৪টি উপজেলার ২৪০টি ইউনিয়নে প্রায় ৭ হাজার পরিবারের ওপর এ পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এই কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ছিল,পর্যবেক্ষণকৃত পরিবারসমূহে নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে কি না, ঘটলে কতটি পরিবারে ঘটছে এবং এর ধরন ও কারণগুলো সম্পর্কে জানা।
ঘরবন্দিত্ব তথা লকডাউনের এই সময়ে এ ধরনের সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা ছিল বেশ কঠিন। তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে মোবাইল ও ই-মেইল ব্যবহার করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ের ইয়্যুথ ভলান্টিয়াররা এ নিবিড় পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন।

জনদূরত্ব বজায় রেখে যে যেখানে অবস্থান করছেন, সেখান থেকে ইয়্যুথ ভলান্টিয়াররা তাদের আশপাশের পরিবারগুলোর ওপর নজর রেখেছেন। উল্লেখ্য যে, পর্যবেক্ষণকারীরা বিগত সময়ে নারীর মানবাধিকার বিষয়ে নিজ নিজ এলাকায় কর্মরত ছিলেন। মূলত পর্যবেক্ষণ নির্ভর হচ্ছে এই রিপোর্ট। গত ২৬শে এপ্রিল থেকে ১০ই মে, ২০২০ এই পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

জরিপ চালানো হয় যে সব জেলায়

দেশের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল, বরগুনা, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম জেলায় এ পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন