|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||
চাকরি থাকলেও বেতন না পাওয়া কিংবা কেটে রাখা, করোনাঝুঁকিতে নাননো বিধিনিষেধে চাকরি হারানোর শঙ্কা, এমনকি কাজে গেলে করোনা সংক্রমণে মৃত্যুঝুঁকি–এমন সব বিরুদ্ধ পরিবেশে পালিত হলো এবারের মে দিবস তথা বিশ্ব শ্রমদিবস। প্রতিবারের মত দিবসটিতে নিজেদের দাবি আর অধিকার আদায়ের তেমন কোন আয়োজন ছিল না। তবে ছিল ভয়, শঙ্কা আর দু’মুঠো খাবারের তাড়না। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণে মালিক ও সরকারের সমন্বয় জরুরি বলে মনে করছেন শ্রমিক নেতারা।
শ্রমিক সংগঠনগুলো বলেছে, করোনা অভিঘাতে এরই মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানাসহ দেশের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক শিল্পে ৭০ হাজারের মতো শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। আর অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীরা লকডাউন পরিস্থিতিতে হয়ে পড়েছেন কর্মহীন।
সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস এর সিনিয়র গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেছেন, শ্রমজীবী মানুষ যে অনিশ্চয়তায় পড়েছে, তাতে তাদের টিকে থাকার বিষয়টিই এখন একমাত্র ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ছয় কোটি মানুষ যারা শ্রমবাজারে আছেন, তার মধ্যে পাঁচ কোটিরও বেশি রয়েছেন অনানুষ্ঠানিক খাতে। এই খাতে শ্রমিকের আয় পুরোটাই নির্ভর করে আসলে দিন এনে দিন খাওয়া-এরকম একটা অবস্থার ওপর। তাদের সঞ্চয় থাকে না। আর আনুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে প্রধান রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক, সেখানেও যে ৪০ লাখের মতো শ্রমিক কাজ করছেন, তাদের আয়ও এমন নয় যে সঞ্চয় থাকে।”
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/Poverty-1.jpg?w=1200&ssl=1)
তিনি আরও বলেছেন, “অনেকে শ্রমিক ছাঁটাইয়েও চলে গেছেন। এই যদি হয় আনুষ্ঠানিক খাতের অবস্থা তাহলে অনানুষ্ঠানিক খাতে তো যারা কাজ দেন, তাদের কোন দায়ই থাকে না। সেখানে শ্রমিকের সাথে কোন চুক্তিই থাকে না। এমন প্রেক্ষাপটে এবার মে দিবসের প্রতিপাদ্য একটাই যে তারা বেঁচে থাকতে চায়।”
এ এক অন্যরকম পহেলা মে। অন্যরকম শ্রমিক দিবস। নেই চিরচেনা ন্যায্যতা, সাম্য বা মজুরির দাবি নিয়ে সারাবছর ঘাম ঝড়ানো মানুষগুলোর মিটিং মিছিল বা স্লোগান-সর্বত্রই শূন্যতা। তবে অন্য যে কোনো সময়ের থেকে বেশিই যেন অনিশ্চয়তা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
করোনার প্রাদুর্ভাব রুখতে গত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর একে একে বন্ধ হয় শিল্প কারখানা ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এরপর নানা অনিশ্চতায় জীবন কাটলেও ঠিক এই মুহূর্তে এসে ঘোর অন্ধকারে ডুবছেন অনেকেই। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করতে নানা প্রতিষ্ঠান খোলা শুরু হলেও অনেকেই হারিয়েছেন উপার্জনের পথ-চাকরি। অনেকেই অপেক্ষার প্রহর গুনছেন কখন আসবে কর্মস্থলে যোগদানের ডাক।
শ্রমিক নেতা মন্টু ঘোষ বলেন, কয়েকজন মালিক সরকারি নিয়ম না মেনেই চাকরিচ্যুত করে দিয়েছে। সংকটেই পরিচয় মেলে বন্ধুর। তবে মহামারির এই সময়ে মালিক শ্রমিকের দূরত্বটা বুঝি বেড়েই গেল অনেকগুণ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলতে শুরু করলেও অনেক ক্ষেত্রেই নেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা। নেই সম্পূর্ণ বেতন পাওয়ার নিশ্চয়তা।
শ্রমিক নেতা জলি তালুকদার বলেন, শ্রম আইনে আছে, এই মহামারিতে ৬ মাস কোনো রকম ছাঁটাই ছাড়াই চালানো যায়। ফলে সেই ধারাকে ফলো করেই শ্রমিকদের বেতন ও চাকরি ফেরত দেন।
এরইমধ্যে চলছে শ্রমিক ছাঁটাই। গাজীপুরে কালিয়াকৈর এলাকার গার্মেন্টস শ্রমিক আব্দুল হাকিম লকডাউনের মধ্যে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। তাকে কারখানা খোলার খবর দেয়া হলে তিনি অনেক কষ্ট করে কর্মস্থলে আসেন। কিন্তু তিনি কারখানায় গিয়ে দেখেন আরও অনেকে সাথে তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে। হাকিম বলেন, “আমাদের ছাঁটাই করেছে জোরপূর্বক। এখন আমরা চাকরি পাব কোথায়? আমরা মালিকের কাছে গেলাম এবং বললাম, স্যার আমরা এখন কী করবো? ঈদ সামনে। আমাদের তো পরিবার আছে। আমরা কি করবো? সে বললো, তোরা যা পারিস কর।”
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/Labour-01.jpg?w=1200&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/Labour-01.jpg?w=1200&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/Labour-01.jpg?w=1200&ssl=1)
যদিও সরকার বলছে লকডাউন পরিস্থিতিতে কোন শিল্প কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না। শ্রমিক নেতারাও বলছেন, শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না এবং কারখানা লে-অফ করা যাবে না-এই দু’টি দাবিকেই তারা এখন সামনে আনছেন।
শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বিলস এর কর্মকর্তা কোহিনূর মাহমুদ বলেছেন, পরিস্থিতি আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটা এখনও ধারণা করা যাচ্ছে না। যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের অনিশ্চয়তা সব সময় ছিল। কিন্তু এখন তাদের জীবন জীবিকা একদমই বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের আনুষ্ঠানিক খাতেও একটা বড় ঝুঁকি। যেমন বেশিরভাগ হোটেল রেস্টুরেন্ট এখন বন্ধ এবং এর শ্রমিকদের কোন কাজ নেই। আরএমজি সেক্টরটা খুব আলোচিত এখন। এই গার্মেন্টস খাত নিয়ে আমরা একটা কেমন যেন ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছি।”
কোহিনূর মাহমুদ উল্লেখ করেছেন, “পরিবহন শ্রমিকের কাজ পুরোই বন্ধ। নির্মাণ শ্রমিকেরও কোন কাজ নেই। এই পরিস্থিতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে- আসলে ভেবে পাই না, বিশ্বাস করুন। শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যটা কী হবে?”
শ্রমিক সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতা ডা: ওয়াজেদুল ইসলাম বলেছেন, কারাখানা লে-অফ এবং শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করতে না পারলে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হবে।
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/Munnujan-Sufian.jpg?resize=595%2C397&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/Munnujan-Sufian.jpg?resize=595%2C397&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/Munnujan-Sufian.jpg?resize=595%2C397&ssl=1)
তবে শ্রম প্রতিমন্ত্রী তাদের পুরোনো বক্তব্য তুলে ধরেই বলেন, “এই মহামারির মধ্যে কোন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হবে না এবং কোন কারখানা লে-অফ করা হবে না-শ্রমিকের বেতন-মজুরি বা খাবার, মালিকরা তাদের সাধ্যমতো দেবেন। আর সরকারি শিল্প কারখানায় কোন ছাঁটাই হবে না। এটাই সরকারের সিদ্ধান্ত।” তিনি এও জানান, কারখানা লে-অফ করা বা শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অভিযোগ তারা পাচ্ছেন না। তিনি উল্লেখ করেছেন, সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ পেলে সরকার তাতে ব্যবস্থা নেবে।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী আরও বলেছেন,সারাদেশে অসহায় এবং নিম্ন আয়ের মানুষকে যে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে, তাতে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরাও সাহায্য পাচ্ছেন।
তবে শ্রমিক নেতারা বলেছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যে থমকে গেছে, তার চাপে গার্মন্টস সহ বাংলাদেশে বিভিন্ন শিল্পের শ্রমিকদের সংকট বাড়লে, সেটা সামাল দেয়ার জন্য কার্যকর কোন পরিকল্পনা তারা দেখছেন না।