|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল জাজিরায় প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’শিরোনামীয় প্রতিবেদনের প্রতিবাদ ও সংক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। সরকারের শীর্ষস্থানীয় লোকজন, সেনাপ্রধান ও তার সহোদরদের নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদনটি আল জাজিরায় সম্প্রচার করা হয় বাংলাদেশ সময় ২রা ফেব্রুয়ারি রাত দুইটায়। এরপর থেকেই প্রতিবেদনটিকে মিথ্যা, অপপ্রচার, ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিহিত করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার বলছেন কাদের
আল জাজিরার প্রতিবেদন শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ‘উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারের নোংরা বহিঃপ্রকাশ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার নিজের সরকারি বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী।
ওবায়দুল কাদের বলেন, “বাংলাদেশের গণমাধ্যমে স্বাধীনভাবে কাজ করছে, সরকারের সমালোচনাও করছে। দেশের এতো ভাইব্র্যান্ট এবং অ্যাক্টিভ মিডিয়া যেখানে কোনো ধরনের তথ্য পায়নি সেখানে আল জাজিরা টেলিভিশনে শেখ হাসিনাকে নিয়ে অসত্য তথ্য প্রচার অত্যন্ত নিন্দনীয়।তিনি বলেন, “লন্ডনে বসে যারা দেশবিরোধী অপপ্রচার করছে এবং উসকানি দিচ্ছে, সেই অশুভ চক্রের যোগসাজশ রয়েছে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের আইন নিজস্ব গতিতে এবং স্বাধীনভাবে চলছে। দুর্নীতি দমন কমিশন নিজস্ব আইনগত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অনুযায়ী চাপমুক্ত হয়ে কাজ করছে।কোন ব্যক্তি বিশেষের দায়কে সরকার প্রধানের সাথে লিংক করা সাংবাদিকতার নীতিবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে- এটি সঠিক সাংবাদিকতা নয়।”
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, “৭৫ পরবর্তী সময়ে দেশে সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর সাহসী ও সুদক্ষ নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। দেশে-বিদেশে বসে দেশ এবং সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার করা কোন কাজে আসবে না বরং বুমেরাং হবে। শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আল জাজিরার প্রতিবেদন উদ্দেশ্যমূলক ও অপপ্রচারের নোংরা বহিঃপ্রকাশ।”
দেশবিরোধী অপশক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহযোগী হয়ে উদ্দেশ্যমূলক, বিভ্রান্তিকর এবং একপেশে প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধ করতে আল জাজিরা টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, যারা দেশের স্বাধীনতা ও দেশের উন্নয়ন, অর্জন এবং অগ্রগতিকে এখনও মেনে নিতে পারেনি তারাই এই প্রতিবেদনের কৌশলী ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় লিপ্ত।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় প্রকাশিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স ম্যান’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি ‘তথ্যভিত্তিক নয়’ মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, এটি ‘দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের’ বহিঃপ্রকাশ।বুধবার দুপুরে গুলশান পুলিশ প্লাজায় নৌ-পুলিশের ‘বঙ্গবন্ধু কর্নারের’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, “দেখুন, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইএসপিআর ওই প্রতিবেদনের জবাব দিয়েছেন। প্রতিবেদনটি তথ্যভিত্তিক নয়। এটা হলুদ সাংবাদিকতা।… এগুলো সাংবাদিকতার নর্মসের ভেতরে পড়ে না।” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমি মনে করি, যারা এটা করেছে। তাদের একটি উদ্দেশ্য ছিল। সে উদ্দেশ্য নিয়ে তারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছেন। আমরা মনে করি এগুলো ভিত্তিহীন এবং দেশবিরোধী একটি ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি
সোমবার রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে আল জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যা ও মানহানিকর’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সেখানে বলা হয়, কিছু ‘উগ্রপন্থি ও তাদের সহযোগী, যারা লন্ডন এবং বিভিন্ন জায়গায় থেকে এসব করছে’, তাদের এই ‘বেপরোয়া অপপ্রচারকে’ বাংলাদেশ সরকার প্রত্যাখ্যান করছে।
এই প্রতিবেদন একগুচ্ছ বিভ্রান্তিকর শ্লেষ আর বক্র ইংগিত ছাড়া আর কিছু নয়, যা আসলে চরমপন্থি গোষ্ঠী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কুখ্যাত কিছু ব্যক্তির দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘অপপ্রচার’, যারা ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ রাষ্ট্রের প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক নীতির বিরোধিতা করে আসছে।
“এই প্রতিবেদনে ১৯৭১ সালের নৃশংস গণহত্যার কথা এমনকি উল্লেখও করা হয়নি। জামায়াতের অপরাধীরা সে সময় লাখ লাখ বেসামরিক বাঙালিকে হত্যা করে এবং দুই লাখের বেশি নারীকে ধর্ষণ করে। এটা আল জাজিরা এবং তাদের প্রতিবেদনের প্রধান ভাষ্যকার ডেভিড বার্গম্যানের রাজনৈতিক পক্ষপাতেরই প্রতিফলন, যে বার্গম্যান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।”
বিবৃতিতে বলা হয়, “আল জাজিরার প্রতিবেদনে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার মূল সূত্র একজন সন্দেহভাজন আন্তর্জাতিক অপরাধী, যাকে আল জাজিরাই ‘সাইকোপ্যাথ’ আখ্যায়িত করেছে। প্রধানমন্ত্রী বা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওই ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার সামান্যতম প্রমাণও সেখানে নেই। আর মানসিক ভারসাম্যহীন কারও কথার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া একটি আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেলের জন্য বড় ধরনের দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক।এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে জামায়াতে ইসলামীর মদদপুষ্ট কয়েকজন দণ্ডিত পলাতক অপরাধী এবং কুখ্যাত ব্যক্তি তাদের চিরাচরিত ছকে বাংলাদেশবিরোধী এই অপপ্রচার সাজিয়েছে, যারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উগ্র গোষ্ঠী এবং সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে আল জাজিরার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন সময়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “কিছু উগ্রপন্থি ও তাদের সহযোগী, যারা লন্ডন এবং বিভিন্ন জায়গায় থেকে এসব করছে, তাদের এই বেপরোয়া ‘অপপ্রচারকে’ বাংলাদেশ সরকার প্রত্যাখ্যান করছে। বাংলাদেশের অসাধারণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য যেখানে সরকারের ভূমিকা প্রমাণিত, সেই অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সরকারকে কক্ষচ্যুৎ করার লক্ষ্য নিয়ে সাজানো হীন রাজনৈতিক ছক বাস্তবায়নে আল জাজিরা নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে, এটা হতাশাজনক।”
সেনাসদর থেকে যা বলা হলো
সেনা সদরের তরফ থেকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো এক বিবৃতিতে ওই প্রতিবেদনকে বর্ণনা করা হয় ‘সাজানো এবং দুরভিসন্ধিমূলক’হিসেবে।কল্পনাপ্রসূত ও অসৎ উদ্দেশ্যে প্রচারিত এই প্রতিবেদন সর্ম্পকে সেনাসদর দপ্তর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।”
সেনা সদর বলেছে, “মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা এই প্রতিবেদনটি সাম্প্রতিক সময়ে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক দেশকে অস্থিতিশীল করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টার একটি অপপ্রয়াস মাত্র। প্রতিবেদনটি তৈরির কুশীলব হলেন, জনাব ডেভিড বার্গম্যান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দন্ডিত একজন অপরাধী, জনাব জুলকারনাইন সায়ের খান (সামি ছদ্মনামধারী) মাদকাসক্তির অপরাধে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি হতে বহিষ্কৃত একজন ক্যাডেট এবং জনাব তাসনিম খলিল অখ্যাত নেত্র নিউজ-এর প্রধান সম্পাদক ।
“অসৎ ও কলুষিত চরিত্রের অধিকারী এসকল স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গ পূর্ব থেকেই তাদের নিজেদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে বাংলাদেশ বিরোধী কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছে। আল-জাজিরার মতো একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের সাথে মুলধারার সাংবাদিকতা থেকে বিচ্যুত ও অশুভ চিন্তাধারার এসকল ব্যক্তিবর্গের যোগসাজশের বিষয়টি অনাকাঙ্খিত ও বোধগম্য নয়। দেশের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাগণের বিভিন্ন দাপ্তরিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত কার্যক্রমের ভিডিও ক্লিপ ও ছবি চাতুর্যের সাথে সম্পাদনা এবং অডিও সংযোজন করে এই প্রতিবেদনটি তৈরী করা হয়েছে।”
প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, “প্রতিবেদনটিতে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ইসরায়েল থেকে ইন্টারনেট ও মোবাইল মনিটরিং সরঞ্জামাদি ক্রয় সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্যের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরির একটি কোম্পানী থেকে ক্রয়কৃত সিগন্যাল সরঞ্জামাদিকে উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে ইসরায়েল থেকে আমদানিকৃত মোবাইল মনিটরিং প্রযুক্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ক্রয়কৃত সরঞ্জাম কিংবা এ সংক্রান্ত কোন নথিপত্রেই এগুলো ইসরায়েলের তৈরী বলে উল্লেখ নেই। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের সাথে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় উক্ত দেশ থেকে প্রতিরক্ষা সামগ্রী ক্রয় কিংবা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গ্রহণের কোন অবকাশ নেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই মিথ্যা ও বানোয়াট প্রতিবেদনটিকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভেদ ও দূরত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টির একটি অপপ্রয়াস হিসেবে মনে করে। বর্তমান চেইন অব কমান্ডের অধীনে এই সুশৃঙ্খল বাহিনী দেশের সংবিধান এবং সরকারের প্রতি সর্বদাই অনুগত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সরকারের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধাশীল থেকে দেশ মাতৃকার উন্নয়ন ও সেবায় নিয়োজিত থাকার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।”