|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিদিনই বাড়ছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে। মারা যাওয়ার হার ইতালি, আমেরিকা বা অন্যান্য দেশের মত না হলেও প্রতিদিনই মৃতের তালিকাতে যুক্ত হচ্ছে নতুন সংখ্যা। বাংলাদেশের জন্য মে মাসটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলা হলেও লকডাউন শিথিলে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে পারে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছে, বর্তমান সময়েই যেখানে আক্রান্তদের ঠিকমত চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না, সেখানে সংক্রমণের মাত্রা বাড়লে তাদেরকে কি করে চিকিৎসা দেওয়া হবে তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে সরকার কয়েক দফা ‘সাধারণ ছুটি’র মেয়াদ বাড়িয়ে আগামী ১৬ই মে পর্যন্ত করেছে। এরইমধ্যে খুলে দেওয়া হয়েছে গার্মেন্টস কারখানা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ, ও ইফতার বেচাকেনা। রোববার ১০ই মে থেকে খুলেছে হাট-বাজার, ব্যবসা কেন্দ্র, ও দোকানপাট। তবে যেসব শর্ত বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসব প্রতিষ্ঠান খুলতে দেওয়া হচ্ছে তাতে করে করোনা সংক্রমণের রাশ টেনে ধরা যাবে না বলেই মনে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/Corona-Curve-Peack.jpg?resize=592%2C394&ssl=1)
এ প্রসঙ্গে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, পোশাক কারখানা ও দোকানপাট খুলে গেলে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় সংক্রমণ বাড়তে পারে। করোনা বিষয়ক পরামর্শ কমিটিও এখনি ঢালাওভাবে দোকানপাট খুলে দেয়ার পক্ষে নয়, আরও কিছুদিন করোনা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে অন্তত ঈদের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল বলেই তাদের মত।
সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যেমন লকডাউন কার্যকর হয়েছে, আমাদের দেশে সেভাবে লকডাউন খুব বেশি কার্যকর হয়নি। তারা বলছেন, ‘এই ভাইরাস মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত পরীক্ষিত কোনও ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। আবার আর্থিক দিক বিবেচনায় একটানা বেশিদিন লকডাউন করে রাখাও সম্ভব না। তাই একমাত্র না হলেও এই ভাইরাস প্রতিরোধে মানুষের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে ইমিউনিটি সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। সবদিক বিবেচনায় নিয়ে সরকার সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে বলেও মনে করছেন তারা।
হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেনিন চৌধুরী এ বিষয়ে সংবাদ সারাবেলাকে বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক নম্বর কৌশল হচ্ছে লকডাউন। লকডাউনের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ঘরে রাখা। এতে করে মানুষ থেকে মানুষের শারীরিক দূরত্ব তৈরি হবে। একজন থেকে আরেকজনের শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হবে না। কোন দেশে যখন সংক্রমণ একেবারে শীর্ষে পৌঁছে আবার নিম্নমুখী হয়, তখন ধাপে ধাপে লকডাউন তুলে দেয়ার পরামর্শ দেয় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রথম পরামর্শ গ্রহণ করেছে। তবে লকডাউনকে সফল ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া দরকার, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার লেজেগোবরে অবস্থা করে ফেলেছে।’
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/Corona-Treat-02.jpg?resize=593%2C395&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/Corona-Treat-02.jpg?resize=593%2C395&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/Corona-Treat-02.jpg?resize=593%2C395&ssl=1)
তিনি আরও বলেন, মূলত যে উদ্দেশ্যে লকডাউন করা হয়েছিল, তা বাস্তবে কার্যকর হচ্ছিল না। যার ফলে করোনার সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়ছিলো। হঠাৎ করে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা গাড়ির স্টিয়ারিং ভিন্ন-পথে ঘুরিয়ে দিলো। অর্থাৎ যেভাবে লকডাউন পালন এবং শিথিল হবার কথা, সে পথে না গিয়ে অঘোষিতভাবে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে, আবার অন্যদিকে সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা যারা জনস্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করি তারা গোলকধাঁধায় পড়ে গেলাম। এটা কোন বৈজ্ঞানিক ধারাবাহিকতায় পড়ে না। যার ফলে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ বাড়বে এবং তা বাড়তেই থাকবে। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নড়বরে হয়ে পড়েছে, অচিরেই হয়তো তা ভেঙ্গে পড়বে। দুঃখজনক হলেও আমাদেরকে লাশের মিছিল দেখতে হবে।
বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী লকডাউন শিথিলের বিষয়ে বলেন, যেভাবে যতটা সাবধানতার সাথে পর্যায়ক্রমে লকডাউন তুলে নেয়ার কথা, সেভাবে হচ্ছে না। বাণিজ্যিক চাপের কাছে হেলথ কনসার্ন ডাউন রেটেড হয়ে গেল। লকডাউন এক্সিট যথাযথ পরিকল্পনা মাফিক করতে পারলে ভালো হত। আমি এটা বলেও ছিলাম। শপিং-মল, মার্কেট আমরা আমরা ঈদের পর খোলার পরামর্শ দিয়েছিলাম। যার ফলে এখন করোনার ঝুঁকি স্বাভাবিকভাবেই অনিশ্চয়তার দিকে চলে গেল। আমরা ধারণা করেছিলাম দেশে করোনা পরিস্থিতি মধ্য মে মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে, কিছুদিন পর আবার নিম্নমুখী হয়ে আস্তে আস্তে কমে যাবে। তবে এখন সংক্রমণের সম্ভাবনা আবার বেড়ে গেল। অন্যদিকে আবার আমাদের প্রস্তুতিও নেই সেই অনুযায়ী।
দেশের অন্যতম ভায়রোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম লকডাউন শিথিলের বিষয়ে সংবাদ সারাবেলাকে বলেন, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রেশারের কারণে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে। এরফলে করোনা পরিস্থিতি কোন অবস্থায় যায়, সেটা আমরা শিগগিরই বুঝতে পারবো। তবে গেল কয়েকদিনে সংক্রমণের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে করে আবারো লকডাউন জোরালো করবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/corona-curve-peak-scaled.jpg?fit=700%2C362&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/corona-curve-peak-scaled.jpg?fit=700%2C362&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/corona-curve-peak-scaled.jpg?fit=700%2C362&ssl=1)
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আশংকাজনক হারে বেড়ে গেলে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেবার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকার বিষয়টা ভালো করেই জানে। আমরাও সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছি চিকিৎসার সামর্থ্য বাড়ানোর জন্য। হাসপাতালে করোনা চিকিৎসায় বেডের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। চিকিৎসার মানও উন্নত করা হচ্ছে। এগুলো একদিনেই আর করে ফেলা সম্ভব না। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি রয়েছে, সেগুলো নিয়োগের ব্যবস্থা চলছে। আমরাও সরকারকে প্রেশার দিচ্ছি এগুলো করতে। সরকারের আন্তরিকতার সাথেই এসব কাজ দ্রুত করার চেষ্টা করছে। এখন দেশে করোনা পরিস্থিতি সার্বিক দিক থেকে বিবেচনা করলে খুব একটা খারাপ বলা যাবেনা।
করোনা টেস্টের পরিমাণ প্রতিদিন আরও ব্যাপকভাবে বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে সাবেক এ উপাচার্য আরও বলেন, করোনার পরিস্থিতিতে সরকারের প্রথম দিকের কাজগুলোর আমিও অনেক কঠিন সমালোচনা করেছি, তবে এখন সরকার যেসব কাজ করছে করোনা প্রতিরোধে তা আন্তরিকতার সাথেই করছে। আমাদের দেশের করোনার আক্রমণ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেরমত অতটা আগ্রাসী নয়, এটা আমাদের জন্য ভালো।
সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কমিউনিটি হেলথ বিশেষজ্ঞসহ চিকিৎসকরা সকলেই একটা বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, লকডাউন শিথিলের ফলে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি কোন পথে যাচ্ছে সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।