|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||
বিদেশি মুদ্রা সঞ্চয়নসহ রাষ্ট্রিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অনেকক্ষেত্রেই বিশ্বপ্রেক্ষাপটে রোল মডেল হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। এমন দাবি খোদ সরকার ও রাষ্ট্রসংশ্লিষ্টদের। আয় বৈষম্য বাড়লেও অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে শনৈ শনৈ। বাড়ছে প্রবাসী আয়। করোনাকালে আমদানি ব্যয় কম হওয়ায় বাড়ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন তথা রিজার্ভ। যা কিনা এই মুহূর্তে পাকিস্তানের চেয়ে দুইগুণ। পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরুর পঞ্চাশ বছরে এসে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। আর এই সময়ে পাকিস্তানের রিজার্ভ ২ হাজার কোটি ডলার। যে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম, গেলো ৪৯ বছরে সেই পাকিস্তানকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রায় সব সূচকেই টপকে গেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ স্বাধীনের সময় রিজার্ভ এক ডলারও ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশ পাঁচ দশকেই উন্নীত হতে চলেছে উন্নয়নশীল দেশে। অথচ, বাংলাদেশের যাত্রার শুরুতেই এটিকে বলা হয়েছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। এখন এ দেশ পরিচিতি পাচ্ছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, স্বাধীনতা পরবর্তী আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদশের ঈষর্ণীয় সাফল্য অহংকার করার মতো। এই অগ্রগতির জন্য পাকিস্তান এখন ঈর্ষা করে বাংলাদেশকে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৮৫৫ ডলার। একই সময়ে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২৮৪ ডলার। গত অর্থবছরে পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ কমলেও করোনা মহামারির মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ।
২০১৮-১৯ সারা বিশ্বকে অবাক করে আট শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ, যে দেশটিকে একটা সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ‘বাস্কেট কেস’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। করোনা মহামারির মধ্যেও চলতি বছর পাকিস্তান তো বটেই, বড় অর্থনীতির দেশ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বেশি হবে বলে এরই মধ্যে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিক দিয়েও বাংলাদেশ এগিয়ে। চলতি বছরের নভেম্বরে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৪। একই সময়ে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ।
দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, দুই দেশের রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতিতে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশের মতো করে হিসাব করলে পাকিস্তানের রিজার্ভ আরও কমে যেত বলে তাদের ধারণা। রফতানিতেও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাকিস্তানের রফতানি আয় ছিল ৭৫৬ কোটি ডলার। যেখানে একই সময়ে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল ১ হাজার ২৫৪ কোটি ডলার। দারিদ্র্য বিমোচনে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। করোনার আগে মার্চে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশের কিছু বেশি। পাকিস্তানে ওই সময় তা ছিল ২৪ শতাংশ। যদিও করোনার প্রভাবে সব দেশেই দারিদ্র্যের হার বেড়ে গেছে।
তবে রেমিট্যান্স ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) বাংলাদেশের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে আছে পাকিস্তান। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাকিস্তানে নেট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ২০৩ কোটি ডলারের। ওই অর্থবছরে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ১২৭ কোটি ডলারের।
চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে নভেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ১৬৮ কোটি ডলার। একই সময়ে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসে ১ হাজার ৯০ কোটি ডলার। তবে এ খাতে নগদ প্রণোদনা দেয়ার পর থেকে বাংলাদেশে রেকর্ড রেমিট্যান্স আসছে। সরকার আশা করছে, করোনার মধ্যেও চলতি বছরের শেষে রেমিট্যান্স ২ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ফলে এ ক্ষেত্রেও পাকিস্তানকে অতিক্রম করবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ সরকার।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক সুরক্ষাসহ অর্থনীতির নানা সূচকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে পাকিস্তানের থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘পাকিস্তান একটি নষ্ট রাষ্ট্র। ওই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো তুলনাই করা উচিত হবে না। আমরা তুলনা করতে পারি উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৯ বছরে বাংলাদেশের বিস্ময়কর পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭২ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৯৩ ডলার, এখন ২ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। বাজেটের আকার ৭৮৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। জিডিপি ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩০২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দারিদ্র্যের হার ৮০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমেছে। গড় আয়ু ৪৭ বছর থেকে বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে। সঞ্চয় জিডিপির ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০ শতাংশ এবং বিনিয়োগ ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মাতৃ ও শিশু মৃতুর হার উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় হারের অনেক নিচে অবস্থান করছে বলে জানান তিনি।
আতিউর রহমান মনে করেন, এত বড় উত্তরণ সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বের ফলে। তবে ’৭৫-এ তাকে না হারালে দেশ আরও এগিয়ে যেত। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার ফলে উন্নয়ন কর্মকাÐ আবার এগিয়েছে। বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশের ওপর জোর দেয়ায় দুর্নীতি অনেকটা কমে আসায় উন্নয়নের গতি অনেকটা ত্বরান্বিত হয়েছে।
বাংলাদেশের এমন সাফল্যকে ইতিবাচকভাবে দেখেছেন পাকিস্তানের উন্নয়নকর্মীরাও। পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দায়িত্ব নেয়ার পরপরই সে দেশের এক টেলিভিশন টক শোতে পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে নেয়ার পরামর্শ দেন উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট জাইঘাম খান।
তথ্যসূত্র : নিউজবাংলা