|| অর্থবাজার প্রতিবেদন, ঢাকা ||
যারা দেশে টাকা না খাটিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে পাঠাচ্ছেন, তাদের একেবারে দেশ ছেড়েই চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বললেন, দেশের টাকা অবৈধভাবে যারা বিদেশে বিনিয়োগ করছেন, তাদের ধরতে বিদ্যমান আইনগুলোর ত্রুটি-বিচ্যুতি ঠিক করা হবে।
শুক্রবার বাজেট পরবর্তি সংবাদ সম্মেলনে বিদেশে টাকা পাচার নিয়ে এক সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, “আমরা চাই আমাদের দেশের অর্থ বিদেশে না যাক। এদেশের অর্থ এখানে অর্জন করে এখানে খরচ করতে হবে। আর যারা খরচ করতে চান না, এখান থেকে তারা একবারেই চলে যাক না।”

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে টাকা পাচার প্রতি বছরই বাড়ছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রকাশিত সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয় শুধু ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় এই পরিমাণ ৯৮ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। বছর পাচার করা এই টাকার পরিমাণ গড়ে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা।
এরআগে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রের ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত আয়-ব্যয়ের হিসাব তথা বাজেট উপস্থাপন করতে গিয়ে মুস্তফা কামাল বলেন, দেশ থেকে আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং এবং ভুয়া বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ ধরনের প্রবণতা রোধ করতে যে পরিমাণ অর্থ আন্ডার ইনভয়েসিং বা ওভার ইনভয়েসিং করে পাচার করা হয়েছে এবং যে পরিমাণ প্রদর্শিত বিনিয়োগ ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হবে, তার ওপর ৫০ শতাংশ হারে করারোপ করা যেতে পারে।
সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের একটি ব্যবসায়িক গ্রুপের সম্পদ ও বিনিয়োগের তথ্য সংবাদমাধ্যমে আসার কথা জানিয়ে একজন সাংবাদিক অর্থমন্ত্রীকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে ওই গ্রুপ বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্য বৈধ কোনো অনুমতি নেয়নি। এ প্রসঙ্গে ওই সাংবাদিক জানতে চান, পাচার করা টাকায় করারোপের আগে পাচারকারীদের ধরতে সরকার আন্তরিক কি না।
এর উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, “যেটা আগে চলে গেছে… দুই-একটা জায়গায় মামলা হয়েছে, বেশিরভাগ জায়গায় মামলা হয়নি। পুরনোগুলো তদন্ত করে কিছু করা যায় কি না। আমার মনে হয় আইন পর্যালোচনা করা দরকার। আইনে যদি কোনো ক্রটি-বিচ্যুতি থাকে, সেটাকে…। কোনো আইনই নেই, টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। আমরা যদি অটোমেশন করতে পারি, যদি এটা করা যায়…।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচার কমেছে দাবি করে মন্ত্রী বলেন, “আগে পত্রিকা খুললেই দেখা যেত মাল আসেনি, কিন্তু টাকা চলে গেছে, এটা এখন অনেক কমেছে। গত দেড় বছরে অনেক কমেছে। অটোমেশনের মাধ্যমে এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। বাকিটা আইনি প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে পারলে…।”
মুস্তফা কামাল এও বলেন, “ কোনো সরকারই চাইবে না দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাক। প্রত্যেক সরকারের… যারা অপরাধ করবে তাদের চিহ্নিত করে আইনি প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা। আইনি প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার জন্য যদি আইন থাকে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করব, আর যদি না থাকে আমরা প্রয়োজনীয় আইনগুলোকে আরো শক্তিশালী করে তৈরি করব। আমরা এই কথা দিতে পারি।”
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ থেকে লভ্যাংশ তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। সেই অর্থও এ দেশে বিনিয়োগ করতে বলা হবে কি না-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, “বিদেশে লভ্যাংশ নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো ধরনের বাধা বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। ট্যাক্স দিয়ে থাকলে বেতনের টাকা নেওয়া যায়। শুধু সম্পদ বিক্রি করতে হলে অনুমতি নিতে হয়।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, “দেশিরা বিনোয়োগ করে ট্যাক্স দেওয়ার পর, এটা তাদের নিজস্ব টাকা। এটা তারা নতুন করে বিনিয়োগ করবে নাকি নিজেদের টাকা নিজেরা নিয়ে যাবে বা নিজেরা ব্যবহার করবে, এটা সম্পূর্ণ তাদের এখতিয়ার। ঠিক তেমনিভাবে বিদেশিরা যখন এদেশে বিনিয়োগ করে, বিনিয়োগ থেকে প্রফিট আর্ন করবে, ট্যাক্স দেবে, এরপর যে ইনকাম থাকে সেটা তাদের ইনকাম, এর উপরে সরকারের কোনো নিষেধ নাই। দেশি-বিদেশি সবাইকে সমানভাবে ট্রিমমেন্ট দেওয়া হয়।”
এবারের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়বে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, “আমার মনে হচ্ছে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না ব্যাংক ব্যবস্থায়। কারণ ব্যাংকে তারল্য পরিস্থিতি এখন খুবই ভালো। ৩০শে এপ্রিল ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি হল, এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত আছে। তাছাড়া রিজার্ভ খুবই হেলদি… আমি মনে করি অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণ নেই।”
উল্ল্যেখ, চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ৭৪ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে, আরও কিছু নেওয়া হবে। সংশোধিত বাজেটে ৮২ হাজার কোটি টাকা ধরা আছে। আর নতুন বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।