|| মাহফুজ রহমান, জয়পুরহাট থেকে ||
করোনকালীন কর্মরত চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য কর্মীদের ঝুঁকি ভাতা এবং করোনা রোগী ও তাদের চিকিৎসার জন্য পরিবহন খরচের ৫০ লাখ টাকা নিয়ে নয়-ছয় করার অভিযোগ উঠেছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্যে সরেজমিনে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: রাশেদ মোবারক জুয়েল এর বিরুদ্ধে।
গত ২ জুন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রনালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ২০২০-২১ অর্থ বাজেটের ০৭.১০৪.০২০.২৭০১.০০১.২০১৩ (অংশ-১)-৭০১ নং স্মারক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি জুন মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেশের ১৪টি জেনারেল হাসপাতালে সংগ নিরোধক ব্যয় (হোম কোয়ারেনটাইন) অর্থাৎ করোনকালীন কর্মরত চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য কর্মীদের ঝুঁকি ভাতা এবং করোনা রোগী ও তাদের চিকিৎসার জন্য পরিবহন খরচ বাবদ বরাদ্দকৃত ৭ কোটি টাকা প্রেরন করা হয়।
ওই বাজেটে দেশের ১৪ টি হাসপাতালের সাথে জয়পুরহাট জেলা হাসপাতালের জন্য একই খাতে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা বরাদ্দ আসে। কিন্তু এ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: রাশেদ মোবারক জুয়েল নির্ধারিত খাতে টাকাগুলো ব্যয় না করে তিনি একদিনের নোটিশে তড়িঘড়ি করে নিজের পছন্দ মত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাহিদাপত্র নিয়ে প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডার, নিবির পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) কম্পিউটার মনিটর, সিরিঞ্জ, অক্সিজেন পাম্প মেশিন, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ক্রয় করেন। সংশ্লিষ্ট দরপত্র দাতাদের কাছ থেকে কোটেশনের মাধ্যমে ওই টাকার ৬ পদের মালামাল কেনা হয়েছে বলেও জানান ডা: রাশেদ মোবারক জুয়েল ।
তবে নিয়ম বর্হিভূতভাবে ওই মালামালগুলি ক্রয় দেখালেও তা বুঝিয়ে না নিয়ে হাসপাতাল ত্বত্তাবধায়ক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে কেনাকাটার সমুদয় টাকার চেক ইস্্ুয করেন বলেও সরেজমিনে জানা গেছে।
জয়পুরহাট জেলা হিসাবরক্ষন কর্মকর্তা সরদার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মালামাল বুঝে পেয়েছেন মর্মে ভাউচার জমা দিলে আমরা অর্থ ছাড়ের জন্য চেক প্রদান করেছি।
তবে সংখ্যা উল্লেখ না করলেও হাসপাতালটির ষ্টোর কিপারের দায়িত্ব প্রাপ্ত আব্দুল বাতেন জানান, “আমি মনিটর পেয়েছি, অন্যান্য মালামাল এক সপ্তাহের মধ্যে আসবে বলে জেনেছি।”
আসলে বরাদ্দকৃত অর্থ চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিদিনের ভাতা এবং তাদেরসহ রোগীদের পরিবহন ব্যয় করার কথা থাকলেও অনিয়ম করে অন্যখাতে অর্থ ব্যয় করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিতরা।
এ নিয়ে ওই হাসপাতালের চিকিৎসক ডা: জাফর ইমাম, ডা: এস এম এহসানুল হক, নার্সিং সুপারভাইজার মাহমুদা চৌধুরী ও সামসুন্নাহার, ওয়ার্ড মাষ্টার সেলিম হোসেনসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে কথা বললে তারা সকলেই ক্ষুব্ধ কন্ঠে জানান, ত্বত্তাবধায়ক তাদের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ, তিনি কি করেছেন, তিনিই ভালো জানেন।
এ ছাড়া নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক ওই হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অভিযোগ করে বলেন, বরাদ্দকৃত অর্থ তাদের প্রাপ্য ছিল, কারন তারা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন। কিন্তু অনিয়ম করে যে সব মালামাল কেনা হয়েছে, তা সরকারী ভাবে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালটির করোনা ও আইসিইউ ইউনিট কেন্দ্রীয় ভাবে অক্সিজেনের আওতায় আনা হলেও অপ্রয়োজনীয় ভাবে নতুন করে অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো কেনা হয়েছে। সব চেয়ে বড় কথা হলো, চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রোগী পরিবহন খাতে বরাদ্ধকৃত অর্থগুলি অনিয়ম করে অন্য মালামাল কেনায় তারা বঞ্চিত হয়েছেন বলেও তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকারী দেড়শ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালটিতে জেলার প্রায় ১২ লাখ ও পার্শ্ববর্তী ৬-৭ টি উপজেলার আরও ৪ লাখ মানুষের একমাত্র আধুনিক চিকিৎসার ভরসাস্থল। জয়পুরহাট জেলার রোগী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী নওগাঁ জেলার ধামুইরহাট, পত্নীতলা, বদলগাছী, দিনাজপুর জেলার হাকিমপুর, বিরামপুর, ঘোড়াঘাট এবং গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী চিকিৎসার জন্য এ হাসপাতালে আসেন।
প্রতিদিন গড়ে বহির্বিভাগে শিশু, নারী-পুরুষ মিলে মোট ১ হাজার জন রোগী সেবা নিয়ে থাকেন ও অন্তঃবিভাগে প্রায় ৩’শ জন রোগী ভর্তি হন। এসব রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে করোনাকালীন সময়ে ১২ জন চিকিৎসক, ৩০ জন নার্স, এবং ২৮ জন ৩য় শ্রেণী ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হন । স্বাস্থ্য সেবায় নিয়েজিত এসব নিবেদিত কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দকৃত ৫০ লাখ টাকার ন্যায্য পাওনা বুঝে না দিয়ে অনিয়ম করে ভিন্ন খাতে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যায় করায় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিতদের মাঝে।
এ ব্যাপারে জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালের ত্বত্তাবধায়ক ডা: রাশেদ মোবারক জুয়েল জানান, “যা করেছি নিয়ম অনুযায়ী করেছি কোন অনিয়ম হয়নি।”
বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) জয়পুরহাট জেলার সভাপতি ডাঃ মোজাম্মেল হক বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রণোদনা দেওয়া হবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বরাদ্দ এসেছে। এখানে অন্য কিছু করার সুযোগ নেই। ব্যাপারটি নিয়ে আমি কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে আলোচনা করব।
বিয়য়টি নিয়ে কথা বলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডাইরেক্টর (হাসপাতাল) ডা: মো: খুরশীদ আলম ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রনালয়ের (বাজেট শাখা) যুগ্ম সচিব ড. এনামূল হক। মুঠোফোনে তারা বলেন, ‘সংগ নিরোধক ব্যায়ের টাকা ৩টি খাত ছাড়া অন্য খাতে খরচ করা যাবে না, খাতগুল্ োহলো করোনকালীন কর্মরত চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রতি দিনের ঝুঁকি ভাতা, তাদের পরিবহন ভাতা ও করোনা রোগীদের জন্য পরিবহন খরচ।
জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালের ত্বত্তাবধায়ক যদি অন্য খাতে ব্যায় করেন, তা সঠিক হয়নি, কারন এক কোডের অর্থ অন্য কোডে খরচ করা যাবে না। এ ছাড়া হাসপাতালের অন্য কোন খরচ থাকলে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগে তাকে চাহিদা পত্র দিতে হবে। অনিয়ম করে থাকলে অডিটের প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।