|| সারাবেলা ডেস্ক ||
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সময় গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ ছাড়াও ঐ জেলার ওড়াকান্দি ইউনিয়নের ঠাকুরবাড়িতে যাওয়ার কথা রয়েছে। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার ওড়াকান্দি ইউনিয়নের ঠাকুরবাড়ি সংলগ্ন এলাকা হিন্দুদের মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ মাসের শেষে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মতুয়া ভোটারদের মন জয় করতেই ওড়াকান্দি যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। যেদিন মোদীর ওড়াকান্দি যাওয়ার কথা, তার পরদিন থেকেই শুরু হবে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন। ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচনে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের ভোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
ওড়াকান্দিতে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের বাসস্থান ও এর আশেপাশের এলাকা মতুয়াদের কাছে পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।
কারা এই মতুয়া সম্প্রদায়? ওড়াকান্দি কীভাবে তাদের তীর্থস্থান হল?
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিম্ন বর্ণ হিসেবে বিবেচিত নমঃশূদ্র গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মতুয়ারা। সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ সম্প্রদায় এই মতুয়ারা, যারা হরিচাঁদ ঠাকুরকে তাদের দেবতা মান্য করে।
গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে প্রায় ২১০ বছর আগে জন্ম হয় হরিচাঁদ ঠাকুরের, যিনি এই মতুয়া সম্প্রদায়ের সূচনা করেন। পরবর্তীতে তার ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের মাধ্যমে বিস্তৃতি লাভ করে মতুয়া মতবাদ।
ওড়াকান্দিতে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের বাসস্থান ও এর আশেপাশের এলাকা মতুয়াদের কাছে পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। মতুয়াদের প্রধান মন্দিরও এখানেই অবস্থিত। “হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের ‘লীলাক্ষেত্র’ – অর্থাৎ তারা যেখানে থেকেছেন, ধর্ম প্রচার করেছেন, তাদের কর্মক্ষেত্র ছিল – মতুয়াদের কাছে তীর্থস্থান”, বলছিলেন কাশিয়ানী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুব্রত ঠাকুর, যিনি হরিচাঁদ ঠাকুরের বংশধরও।
সুব্রত ঠাকুর এও বলেন, “সে সময় অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া মানুষের অধিকার আদায় ও উন্নয়নের জন্য হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর আন্দোলন করেছেন। সমাজ সংস্কার ও শিক্ষার প্রসারের জন্য নানা ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছেন”।
প্রতিবছর হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে সারাবিশ্ব থেকে লাখ লাখ মতুয়া এখানে সমবেত হন এবং পুণ্যস্নানে অংশ নেন। সেসময় কয়েকদিনের জন্য ঠাকুরবাড়ি ও আশেপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক মতুয়াদের উপস্থিতি থাকে।
সুব্রত ঠাকুর বলেন, “প্রতিবছর পুণ্যস্নানের সময়টায় প্রায় ১৫ লাখ মানুষের সমাগম হয়। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও আরো কয়েকটি দেশ থেকে মতুয়ারা আসেন তখন। সেসময় আয়োজকদের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষজন ও স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় পূণ্যার্থীদের থাকা-খাওয়া ও দেখাশোনার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।”
যেভাবে ভারত সহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে মতুয়ারা
মতুয়া আন্দোলন মূলত ওড়াকান্দি কেন্দ্রিক হলেও ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন সময়ে মতুয়াদের একটা বড় অংশ ভারতে চলে যায় বলে জানান স্থানীয় মতুয়াদের অনেকে।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতারা তাদের শিষ্যদের বড় একটা অংশ নিয়ে ভারতে চলে যান এবং উত্তর চব্বিশ পরগণার ঠাকুরনগরে নিজেদের ধর্মীয় কেন্দ্র গড়ে তোলেন।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুব্রত ঠাকুর বলেন, “তার বাবার এক ভাই ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে চলে যান, যার উত্তরসূরিরা বর্তমানে সেখানে মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।
স্থানীয় মতুয়াদের বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায় যে তাদের আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে ভারতে গিয়ে সেখানেই স্থায়ী বসতি গড়েছেন বহু বছর আগে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও অনেকেই বাংলাদেশ থেকে ভারতে বসবাসের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন ও নরেন্দ্র মোদীর ওড়াকান্দি সফর
ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মতুয়া সম্প্রদায় এবং তাদের ধর্মগুরুরা স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে একটা সময় এই মতুয়াদের অধিকাংশ ভোট বামফ্রন্ট বা তৃণমূল কংগ্রেসের মত বাম ঘরানার দলগুলোর কাছে গেলেও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে মতুয়া মহাসংঘ বিভক্ত হয়ে গেলে এই হিসেব পরিবর্তন হয়ে যায়।
সেসময় মতুয়া মহাসংঘের একটি অংশ তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে থাকে এবং আরেকটি অংশের প্রধান শান্তনু ঠাকুর বিজেপি’র টিকিটে জিতে সংসদ সদস্য হন।
বিজেপি’র দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন চালু না হওয়ায় মতুয়াদের বড় একটি অংশ হতাশ হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাই তাদের মতে, ভোটের আগে মতুয়া ভোটারদের মন জয় করা বিজেপি’র জন্য বিশেষ প্রয়োজন।
আর মতুয়াদের প্রধান তীর্থস্থানে নরেন্দ্র মোদীর সফর মন জয় করার চেষ্টার একটি অংশ বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কোলকাতার রাজনৈতিক বিশ্লেষক তপশ্রী গুপ্ত বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান ও সমাধিতে যাওয়ার কথা রয়েছে নরেন্দ্র মোদীর। কিন্তু সেখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে, ওড়াকান্দিতে মতুয়াদের গুরু হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মস্থানও রয়েছে। মোদী সেখানেও যাবেন।”
তিনি এও বলেন, “আমার ব্যক্তিগত মত হল, এ বছর পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন না থাকলে মোদী এতটা কষ্ট করতেন না।”
এবারে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন এতটাই হাড্ডাহাড্ডি হবে যে মতুয়া ভোট অনেক আসনেই নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের মোট ২৯৪টি বিধানসভার ১৪টি বিধানসভার ফল পুরোপুরি নির্ভর করে মতুয়া ভোটের ওপর। আর মোট ৬০ থেকে ৭০টি বিধানসভায় ৫ থেকে ১০ হাজার করে মতুয়া ভোটার রয়েছে, যা এবারের বাস্তবতায় ফলাফলের নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে বলে বলা হচ্ছে।
সংবাদ সূত্র: বিবিসি বাংলা।