|| স. ম. গোলাম কিবরিয়া ||
সময়টা জুলাই মাস হবে। সঠিক তারিখ মনে নেই। তবে তখন ছিলো বর্ষাকাল। ১৯৭১ সাল। রাতও কাটে আতঙ্কের ভেতর। বাবা, মেঝভাই ও আমি রাতে একটি ঘরে ঘুমাই। টিনের ঘর। বাঁশের চোটির তৈরি বেড়া। তার ওপর এঁটেল মাটির পুরু প্রলেপ। দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমাতে হয়। হারিকেনের ফিতে নামিয়ে আলো কমিয়ে রাখা হয়। মৃদু আলোতে ঘরের ভেতর আবছা দেখা যায়। গভীর রাত। চারিদিক শুনশান। গ্রামের বাড়িতে সবাই একটু তাড়াতাড়ি ঘুমায়, ওঠে খুব ভোরে। বাবাসহ আমরা তিনজনই বেভোর ঘুম। হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। বাবা ধুচমুচ করে উঠলেন। আমাদেরও ঘুম ভেঙে গেলো। এত রাতে দরজায় কে? আবারও আওয়াজ, সাথে নিচুস্বরের ডাক চাচামিয়া, দরজা খোলেন। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সাহস করে বাবা বললেন, কে? বাইরে থেকে উত্তর এলো, চাচামিয়া, আমি মঞ্জু। চিনতে পেরে বাবা দরজা খুলে দিলেন। সাথে সাথেই হুড়মুড় করে ২০ থেকে ২৫জন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো। মঞ্জু ভাই আমাদের সম্পর্কে সবকিছু জানেন। আমরা কে কোথায় ঘুমাই তিনি জানেন। হয়তো আগেই তার সাথের লোকদের বলে রেখেছেন। এ কারণেই হয়তো এভাবে ঢুকে পড়লো। সবার হাতেই অস্ত্র। সবাই মুক্তিযোদ্ধা।
বাবা আমাদের নিয়ে উঠোনে দাঁড়ালেন। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে অন্য ঘর থেকে মা, ফুফুও বের হয়েছেন। বাবা পানি খেতে চাইলেন। ফুফু ঘর থেকে পানি এনে দিলে ঢক ঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করলেন। মঞ্জু ভাই এসে বাবার পাশে দাঁড়ালেন। বাবা কিছু বলতে চাইলেন। তার আগেই মঞ্জু ভাই কয়েকটা মাদুর চাইলেন। বললেন, আগে সবার শোয়ার ব্যবস্থা করি, তারপর কথা বলছি। অন্য ঘর থেকে কয়েকটা মাদুর নিয়ে মঞ্জু ভাই সেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে এলেন।
মঞ্জুভাই বললেন, চাচামিয়া, সারাদিন ওদের পেটে দানাপানি পড়ে নাই। অনেক কষ্ট করে এসেছে। একটা অপারেশনও করেছ। আগে ওদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন। পরে আপনার সাথে কথা বলছি। বাবা বললেন, এতগুলো মানুষকে এই সময় কি খেতে দেবো? ভর্তা-টর্তা বা ডালভাত, যাকিছু পারেন দেন, মঞ্জু ভাই জবাব দিলেন। রাতের কোন তরিতরকারি আছে কি না মায়ের কাছে জানতে চাইলন বাবা। জবাবে মা নেই বলেই ফুফুকে নিয়ে রান্না করতে বসলেন। তখনকার দিনে গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলো না। আর ফ্রিজ তো ধনী লোকের বিলাসিতা। আপাতত ভাত, ডাল আর ডিম ভাজি করা হলো।
মঞ্জু ভাই বাবার বন্ধুর ছেলে। লেখাপড়ায় হাতে খড়ি আব্বার কাছেই। এখন কলেজে পড়েন। ঊনসত্তর থেকেই এলাকায় যত মিছিল-মিটিং হয়, মঞ্জু ভাই আয়োজন করে। সত্তরের নির্বাচনে সারাদিন ভোট চেয়ে বেড়িয়েছেন। বিকেল হলেই মিছিলের আয়োজন করতেন। আমরা তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই বয়সেও মিছিলে যোগ দিয়েছি। স্লোগান দিয়েছি। একটি স্লোগান এখনও অনুরণিত হয়। স্লোগানটি আর কখনোই শুনিনি। কলেজ থেকেই ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত হই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ি। এরশাদের স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে অনেক মিছিল, মিটিং, পিকেটিং করেছি। অনেক স্লোগান দিয়েছি; কিন্তু ছোটবেলার সেই ঢঙে কোন স্লোগান শুনিনি। স্লোগানটি ছিলো এরকম- “নৌকা মার্কায় দিলে ভোট, শান্তি পাবে দেশের লোক, “ঐতিহাসিক পুরাতত্ত্ব ভেদ করেছি মহাশয়, আইয়ুব শালার পাঠশালাতে মৌলভিদের শিক্ষা হয়”।
সত্তরের নির্বাচনে আমাদের আসনে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ প্রার্থী ছিলেন অধ্যাপক আবু সায়্যিঈদ। প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থী আহম্মেদ রফিক। দুজনই বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। দু’জনের নামেই অনেক মিছিল করেছি সেই ছোট বেলায়। অধ্যাপক আবু সায়্যিঈদ আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলে তথ্যমন্ত্রী ছিলেন। আহাম্মেদ রফিক ভাই নির্বাচনের বিজয়ী হওয়ায় পর পাবনা শহরে নিজ বাসার কাছে আততায়ীর হাতে নিহত হন। সত্তরের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে এলাকায় মঞ্জু ভাইয়ের গুরুত্বও অনেক বেড়ে যায়। সবাই বেশ সম্মান করে এবং গুরুত্ব দেয়।
রান্না শেষ হলো। এরা কতদূর থেকে এসেছে। একটু হাতমুখ ধুতে হবে। কিন্তু টিউবওয়েলটা বড়ির বাহির আঙিনায়। গভীর রাতে এতগুলো মানুষ টিউবওয়েল চাপলে আশেপাশের মানুষ জেগে উঠবে। তখন সমস্যা হতে পারে। তাই কলসির পানি দিয়ে পরিষ্কার হলেন সবাই। ঘরের মধ্যে একটা চোকি, আলনা, একটা পড়ার টেবিল আর দুইটা চেয়ার। ঘরের বাঁকি অংশ ফাঁকা। সেখানে মাদুর বিছানো হয়েছে। খাবার নিয়ে আমরাই গেলাম। ঘরে ঢুকেই চোখ ছানাবড়া অবস্থা। এত অস্ত্র! কিছু চোকির উপর, কেউ হাতে নিয়ে, কেউ কোলের উপর রেখে কথা বলছে। কেউ হেলান দিয়ে ঝিমিয়ে নিচ্ছে। কথা-বার্তাও চলছে খুব নিচুস্বরে। ডাল ভাত জুটেছে- তাতেই যেন মহাখুশি। সারদিন খাওয়া-দাওয়া হয়নি। কমান্ডার বললেন, খেয়ে নে তারতারি। একটু ঘুমোতে হবে। দুই দিন ঘুমানো হয়নি। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই যার যার মত শুয়ে পড়লেন।
মঞ্জুভাই এবার নিজ বাড়িতে যাবেন। আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় মঞ্জু ভাইদের বাড়ি। বাড়ি যাওয়ার আগে বাবার সাথে কথা বলতে এলেন। বাবা বললেন, “এ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প করা খুব বিপদজনক কাজ হলো। রাতেই কেউ বাঘাবাড়িতে গিয়ে খবর দেবে। সকাল বেলায় পাকিস্তানিরা আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে ফেলবে। সেই সাথে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে ছাড়খার করে দেবে।” মঞ্জু ভাই বললেন, কিছুই হবে না ইনশাল্লাহ। সকালে আমি এসে ব্যবস্থা নিবো। আপনি সকালে ওদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। তারপর আপনার সাথে বসে বিস্তারিত আলাপ করবো। এখন আমি একটু বাড়ি যাই। অনেকদিন হলো বাড়ির কেউ আমার খবর জানে না।
আমাদের বাড়ির পুবদিকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাঘাবাড়ি। সেখানে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি। উত্তরদিকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সাঁথিয়া থানা সদর। সেখানে একটা ঘাঁটি। যদিও সাঁথিয়া থেকে আমাদের গ্রামে আসা বেশ কষ্টকর। পশ্চিম দিকে ছয় কিলোমিটার দূরে ফরিদপুর থানা। সেখানেও পাকিস্তানিদের ঘাঁটি। এ ছাড়া বাঘাবাড়ি থেকে স্পিডবোট নিয়ে প্রতিদিন নদীপথে পাকিস্তানিরা টহল দেয়। তাই খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি ক্যাম্প করা হলো। এই অবস্থান নিয়ে বাবার উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণও বটে। ঝুঁকি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, ঝুঁকি এ গ্রামের সবার জন্য। তবে বড় একটা সুবিধা হলো- এ গ্রামে একজনও রাজাকার নেই। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর চিন্তা-ভাবনায় কিছুটা পাকিস্তানের সমর্থক। তাই তার ছোট ছোট ছেলেদের দিয়ে যুদ্ধের শুরুর দিকে দু’একবার মিছিল করিয়েছে। কিন্তু গ্রামের সবার মনোভাব বুঝতে পেরে তা বন্ধ করেছে। মেম্বর সাহেব কখনও পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে গিয়েছেন কি না, জানি না। গেলেও গ্রামের সবার সাথেই একমত হয়ে চলতে হচ্ছে তাকে।
এখানে ক্যাম্প করার সুবিধাটা হলো এখন বর্ষাকাল। এ সময়ে আমাদের এলাকায় চারিদিকে পানি থৈ থৈ করে। বাড়িগুলোর চারদিকে পানি ওঠে। বেশীর ভাগ বাড়ি যেন একেকটা দ্বীপ। পায়ে হাঁটার কোন পথ থাকে না। চলাচলের প্রধান বাহন হয় নৌকা। প্রায় বাড়িতেই একটা ছোট আকারের নৌকা থাকে। বাজার-ঘাটেও যেতে হয় নৌকায় চড়ে। তাই হয়তো মুক্তিযোদ্ধারা এখানে ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শুকনো মৌসুমে বাঘাবাড়ি, সাঁথিয়া বা ফরিদপুর যেতে পায়ে হাঁটার একটা পথ থাকলেও এখন তা প্লাবিত। পাকিস্তানিরা এখানে হানা দিতে হলে নৌকায় আসতে হবে, যা তাদের জন্য বড় বিপদের কারণ হবে। অন্যথায় লঞ্চে আসতে হবে, কিন্তু বাঘাবাড়িতে বা ফরিদপুর ক্যাম্পে তেমন লঞ্চ নেই- তা মুক্তিযোদ্ধারা জানেন।
বাবা ফজরের নামাজ পড়া শুরু করলে আমরা ঘুম থেকে উঠি। নামাজ শেষ করে বাবা কিছু দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। বললেন, কোন মুক্তিযোদ্ধা টিউবওয়েল বা বাইরের আঙিনায় যেতে চাইলে তোমরা আগে দেখে এসো অপরিচিত কেউ আছে কি না। অপরিচিত কেউ থাকলে যেন বড়দের জানাই। মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু প্রয়োজন কি না তা যেন লক্ষ রাখি। গ্রাম দেশে অপরিচিত লোক চেনা সহজ। গ্রামের সবাই সবাইকে চিনে। যেকোন অপচিতি লোককে পরিচয় জানতে চাওয়া যায়। কারো আত্মীয়-স্বজন হলে সঠিক পরিচয় জানাতে হয়। না হলে আগন্তককেই সমস্যায় পড়তে হয়।
তিনবেলা ভাত খাওয়া আমাদের বাড়ির রেওয়াজ। গ্রামের সব বাড়িতেই তিনবেলা ভাত খাওয়া হয়। সকালে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ানো শেষ হলো। কয়েকজন অস্ত্র পরিস্কার করতে বসলেন। একজন টুকরা কাপড় চাইলেন। দৌড়ে গিয়ে মায়ের কাছ থেকে পুরনো এক টুকরা কাপড় নিয়ে দিলাম। কাপড়ের টুকরোটি ছিলো ক্যারোলিন জাতীয়। তাই বললেন, গেঞ্জির কাপড় হলে ভাল হতো। তিনি আমাকে বসতে বললেন এবং ঐ কাপড় দিয়েই থ্রি নট থ্রি রাইফেল পরিস্কার করা শুরু করলেন। ফাঁকে ফাঁকে আমাকে নানা প্রশ্ন করছেন। নাম কি, কোন ক্লাসে পড়ি, কয় ভাই-বোন ইত্যাদি। এই সুবাদে আমি অস্ত্রগুলো দেখছি। রাতের বেলায় তো ভালভাবে দেখতে পারি নাই। থ্রি নট থ্রি রাইফেল, সেলফ লোডেড রাইফেল বা এসএলআর, স্টেনগান দেখালাম। বেওয়ানেট কিভাবে রাইফেলের মাথায় লাগাতে হয়, আবার কিভাবে ভাঁজ করে রাখতে হয়, তাও দেখলাম। কিছু গ্রেনেডও দেখলাম রয়েছে। রাইফেলের ব্যারেল বা নল পরিস্কার করার জন্য কাপড়ের মাঝে রশি বেঁধে রশির মাথা ব্যারেলের মাথা দিয়ে বের করলেন। রাইফেলের বাটের তলার একটা চেম্বার থেকে ভেতরে থাকা সরু বোতল বের করলেন। বোতলের তরল কাপড়ে মিশিয়ে রশি ধরে টেনে বের করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভেতরে গিয়ে কাপড়টা আটকে গেলো। কিছুতেই বের করা যাচ্ছে না। একজন বললেন, গেঞ্জির কাপড় হলে এমন হতো না। উপায় না দেখে অন্যরাও সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। অবশেষ দুইজন মিলে রশি ধরে টেনে অনেক কষ্টে কাপড়টা বের করলেন। সেই সাথে ব্যারেলের ভেতরটাও পরিস্কার হয়ে গেলো। সেই বয়সে স্টেনগান দেখে সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র মনে হয়েছিলো। হাতে নিয়ে দেখতে না পেরে ভেবেছিলাম ওটার ব্যারেলের ছিদ্রগুলো দিয়েও বুঝি গুলি বের হয়। কিন্তু সংকোচে কারো কাছে জানতে চাইনি। এভাবেই সারাক্ষণ তাদের দেখভালের কাজে লেগে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর মঞ্জু ভাই এলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথাবার্তা বলে বাবার কাছে এলেন। বললেন, চাচামিয়া, কোন চিন্তা করবেন না। আপনার তো একটাই বাড়তি ঘর। এই ঘরে সবার থাকতে সমস্যা হবে। তাই কয়েকজনকে অন্য বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। চিন্তা করেছি এ গ্রামের সবাইকে জড়িত করবো এই ক্যাম্পের সাথে। যাতে কেউ ক্যাম্পের কথা বাইরে গিয়ে বলতে না পারে। যারা মুক্তিযোদ্ধাদের রাখতে পারবে না, তাদের খাবার দিতে হবে। একেবারে গরীব যে, তারও একজন মুক্তিযোদ্ধার এক বেলার খাবার দিতে হবে। আপনি কি বলেন? আব্বাও এতে রাজী হলেন। এভাবেই ক্যাম্প চালানো হলো প্রায় চার মাস।
মুক্তিযোদ্ধাদের দেখভাল করতে গিয়ে তাদের স্নেহ পেয়েছি অনেক। ছোট ভাইয়ের মতই আচরণ ছিলো আমাদের প্রতি। দলের সবার নাম ভুলে গিয়েছি। সেই তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রের পক্ষে সবকিছু মনে রাখা সম্ভব নয়। তবে যুদ্ধকালের দুঃসহ স্মৃতিগুলো এখনও তাড়িয়ে বেড়ায়। মনে আছে মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলের কামন্ডার ছিলেন মুকুল ভাই। দলের প্রায় সবাই ছিলেন শাহজাদপুরের (সিরাজগঞ্জ)। কমান্ডার মুকুল ভাইয়ের পুরো নাম আব্দুর রাজ্জাক মুকুল। তাঁর অনুজ ছিলেন পাবনার সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা (পরবর্তীতে বিএনপি) প্রয়াত রফিকুল ইসলাম বকুল। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুকুল ভাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে শাহজাদপুর থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে রাজনীতিতে থাকেন নি। এই দলে ছিলেন হাবিব ভাই। তিনি খুব সুদর্শন ছিলেন। কিন্তু সেই সুদর্শন হাবিব ভাই কিনা ধরা পড়া রাজাকার বা পাকিস্তানী হানাদারদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে ব্যবচ্ছেদ করতেন। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গুলি ছিলো খুবই অমূল্য সম্পদ। এ ছাড়া গুলির শব্দ শুনে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে বা পাকিস্তানিরা শব্দ শুনে খোঁজ নিতে পারে। তাই ধারা পড়াদের ওপর গুলি খরচ করার কোন মানে হয় না। হাবিব ভাই পরে আমেরিকা চলে যান। ফিরে এসে শাহজাদপুরে বসবাস করতেন। কিছুদিন আগে তিনি মারা যান। আরো একজনের নাম মনে আছে, শরবত ভাই। শরবত ভাই ক্যাম্প ব্যবস্থাপনায় থাকতেন, কখনও কোন অপরারেশনে যেতে দেখিনি। তাঁর শরীরের যে আয়তন ছিলো, যুদ্ধ করা তার জন্য সমস্যাই বটে। স্বাধীনতা পরবর্তীতে শাহজাদপুরে এক ছাত্র-শ্রমিক সংঘর্ষে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। দলের আরেক সদস্য রউফ ভাই, পরবর্তীতে জুগ্নিদহ স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তিনি এখনও জীবিত আছেন।
প্রতিদিনই মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনে যেতেন না। যেদিন অপারেশন থাকতো না সেদিন ঘরের মধ্যেই দিন কাটতো। আমরাও সারাদিনই তাদের কাছে ঘুর ঘুর করতাম। আসল উদ্দেশ্য অস্ত্রগুলো দেখা। অপারেশন থাকলে আমরাও বুঝতে পারতাম। কারণ সন্ধ্যায় এসে মাকে বলতেন, চাচি মা, কাল ভোর রাতে খাবার দিতে হবে। মাও বুঝতেন শেষ রাতে হয়তো বের হয়ে যাবে। সারাদিন তো আর খাওয়ার সুযোগ পাবে না। তবে আবদার শুনেই মা কপট ধমক দিয়ে বলতেন, অপারেশনে যেতে হবে না। ঘরেই বসে থাকো। সারাদেশ পাকিস্তানি সৈন্যে ভরে গেছে। তোমরা গিয়ে কোথাও ফুটুস-ফাটুস করবে, আর পাকিস্তানিরা এসে পুরো এলাকা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেবে। মানুষ মেরে শেষ করে দেবে। আসলে দীর্ঘদিন এখানে ক্যাম্প থাকায় সম্পর্কটা এমনই হয়ে গিয়েছিলো। তারপরও রাতে রান্না হতো এবং শেষ রাতে খেয়ে সবাই বের হয়ে যেতেন। আবার রাতের আঁধারে ফিরে আসতেন। কোথায় গিয়েছিলেন, কী কী করলেন তার কিছু জানার মত বয়স তখন ছিলো না আমাদের।
আমাদের বাড়ির উত্তর পাশে একটা বেশ বড় বাঁশঝড় ছিলো। বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে বড়াল নদী। মনে পড়ে একদিন তাঁরা বিকেল বেলায় হন্তদন্ত হয়ে সবাই ফিরলেন। ফিরেই বাঁশঝাড়ের আড়ালে, আশেপাশের বাড়িতে নদীর দিকে অস্ত্র তাক করে পজিশন নিলেন। অন্য বাড়িতে আমাদের আশ্রয় নিতে বললেন। বাঘাবাড়ি থেকে স্পিডবোট ও লঞ্চযোগে পাকিস্তানিরা নাকি এদিকে আসছে। তাদের সাথে যুদ্ধ হবে। সেদিনই দেখলাম এসএলআর নিয়ে কিভাবে পজিশন নিতে হয়। সারা গ্রামে আতংক ছড়িয়ে পড়লো। সন্ধ্যা পর্যন্ত পজিশন নিয়ে রইলেন তারা। পরে খবর পেলেন যে পাকিস্তানিরা আসছে না। সবাই অস্ত্র-শস্ত্র গুটিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো।
অন্য একদিনের ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন শেষে বিকেল বেলায় ফিরে এলেন। সাথে তিনজন রাজাকার। সাঁথিয়া থানা আক্রমণ করেছিলেন তারা। আক্রমণে সফল হয়েছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অনেকেই মারা গেছে, অনেকে পালিয়েছে। তিনজন রাজাকার ধরে এনেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এদের একজন খুবই কম বয়সী। নাম মনসুর। কিশোর মনসুর বিরামহীণভাবে কান্নাকাটি করছে আর প্রাণভিক্ষা চাচ্ছে। বলছে, তার চাচা জোর করে রাজাকারে নাম লিখিয়েছে। সে কিছুই জানে না। কান্না থামাতে বার বার বলছে মুক্তিযোদ্ধরা। কিন্তু কিছুতেই থামছে না। এই তিনজনকে ব্যবচ্ছেদ করতে হাবিব ভাইয়ের ওপর দায়িত্ব পড়লো। গ্রামের মধ্যে এ কাজ করলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে। ছোট ছেলে-মেয়েরা দেখে ফেলতে পারে। নদীর অপর পাড়ে বিশাল পাথার। বার্ষায় নদী আর পাথার একাকার হয়ে গেছে। বিশাল পাথার দেখতে সাগরের মত মনে হয়। দূরের গ্রামগুলোর অস্তিত্বও বুঝা যায় না। তাই হাবিব ভাই পাথারে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমাদের নৌকায় সাথে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে হাবিব ভাই রওনা হলেন। অনেকক্ষণ পর তারা ফিরে এলেন। সাথে সেই কিশোর রাজাকার। তাকে আর ব্যবচ্ছেদ করা হয়নি। তার কান্নাকাটিতে হাবিব ভাইসহ সঙ্গীদের মন গলে গেছে। ফিরে বললেন, এই ছোট্ট ছেলে মুক্তিযুদ্ধের কী বুঝে আর রাজাকারীর কী বুঝে? ছেড়ে দাও ওকে। তাই করা হলো।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করা হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে আড়ম্বরতা দৃশ্যমান নয়। তবুও জাতি হিসেবে আমাদের অহঙ্কারের, গর্বের বছর ২০২১। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি তারা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও দেখতে পাচ্ছি। বয়সের কারণে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি। কিন্তু সারাক্ষণ মুক্তিযোদ্ধাদের যে সহযোগিতা করেছি- সেটাই কম কিসের?
অনেকদিন থেকেই খুঁজে ফিরছি ছেড়ে দেওয়া সেই কিশোর রাজাকার মনসুরকে। লোকমুখে শুনেছি, এখন সে জামায়াত নেতা। কিন্তু সঠিক তথ্য পাচ্ছিলাম না। কিশোর মনসুর রাজাকার পরিণত বয়সে জামায়াত নেতা হবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ একজন স্বাধীনতা বিরোধী আজীবন স্বাধীনতা বিরোধী। এর ভিন্নতা নেই। তবুও প্রাণভিক্ষা পাওয়া মনসুরকে খুঁজে বের করার তৃষ্ণা মিটছিলো না। অবশেষে জানতে পারলাম, মনসুর মোল্লা। বেড়া (পাবনা) উপজেলার হাতিগাড়া গ্রামের বাসিন্দা। বেড়া উপজেলার জামায়াত নেতা। বর্তমানে ঢাকার দক্ষিণখানে বাড়ি করেছে। দক্ষিণখানেও সে জামায়াত ইসলামের নেতা। বিত্তবৈভবও বানিয়েছে প্রচুর। দুই ছেলে বিদেশে থাকে। সুখের সংসার আছে আর স্বাধীনতা বিরোধী জামায়তের রাজনীতি করছে। ভুলে গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে ভিক্ষে পাওয়া প্রাণের কথা।
লেখক: মহাপরিচালক, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিপপ্তর।