মোজাম্মেল হোসেন
…শোনো শোনো পিতা। কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।
জনকের বজ্রকণ্ঠের বাণী একদিন জাতিকে জাগ্রত করেছিল। ঐক্যবদ্ধ করেছিল। প্রাণে প্রাণে উদ্দীপনা জাগিয়েছিল। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের লরাই থেকে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। যুদ্ধজয়ের ফসল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা বিদায় সময় তাদের ভেদনীতির ফলে ভারত বিভক্ত হয়ে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ওই পাকিস্তান আন্দোলনের ভেতর থেকেই যে তরুণ নেতারা দ্রুতই বুঝতে পেরেছিলেন যে পাকিস্তানের আধা-ঔপনিবেশিক শোষণের নিগরে বাঁধা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের বিকাশের কোনো পথ নাই তাঁদের অন্যতম ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮-৫২ সালে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠার মহান ভাষা আন্দোলন থেকে পরবর্তী টানা দুই দশক বাঙালি জনগণের লরাই-সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে তিনিই সময়োচিত ও যথাযথ নেতৃত্ব দিয়েছেন। নিজে কষ্ট, ত্যাগ ও জেলজুলুম সহ্য করে গণমানুষের একান্ত আপনজন হয়ে ওঠেন। ১৯৬৬ সালে পূর্ণাঙ্গ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে দ্ব্যর্থহীন স্পষ্ট ভাষায় রূপ দিয়ে ৬-দফা দাবিনামা প্রণয়ন করে ও প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের ১১-দফা দাবিকে যুক্ত করে সামরিক একনায়ক আইউব খানের পতন ঘটানো ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ ও বাঙালির অবিসংবাদী জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। এরপর ১৯৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র বিজয় ও গোটা পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন। এবং মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে, কারণ পাকিস্তানী সেনাশাসকরা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষণমতা হস্তান্তর না করে বাঙালিদের ধ্বংস করতে গণহত্যা শুরু করে। মুুক্তিযুদ্ধে বিজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল, যা বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চে ঐতিহাসিক ভাষণে বলে গেছেন, “সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।”
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অসাধারণ গুণাবলীর অন্যতম একটি দিক ছিল তাঁর ভাষণ। রাজনৈতিক বিষয় স্বচ্ছভাবে তুলে ধরে জনগণের বোধগম্য সরল ভাষায় তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে সম্মোহনী ভাষণ। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া যে ভাষণে তিনি কার্যত কৌশলে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বিশ^ব্যাপী আলোচিত ইতিহাসের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। ইউনেস্কো ২০১৭ সালে এই ভাষণ বিশে^র ঐতিহ্যগত প্রামাণ্য দলিল হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। ভাষণটি নিয়ে দেশে-বিদেশে বিস্তর আলোচনা-বিশ্লেষণ হয়েছে ও হচ্ছে।
লড়াকু জাতীয়তাবাদী নেতা এবং সদ্য-স্বাধীন দেশের শাসক হিসেবে বিভিন্ন উপলক্ষে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর অজস্র ভাষণের মধ্যে লিখিত ভাষণ হাতে গোণা, যেগুলো আন্তর্জাতিক মঞ্চের। বাকি সব ভাষণ উপস্থিত ও মৌখিক। অথচ সেগুলোর মধ্যেই কী সারবত্তা ও গভীর ব্যঞ্জনা! এটাই বঙ্গবন্ধুর বৈশিষ্ট্য। ভাষণগুলির মধ্যে আমরা খুঁজে পাই তাঁর আদর্শ, চেতনা, শিক্ষা, ভবিষ্যৎ-ভাবনা ও স্বপ্নের খেই।
আজ ১৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। শ্রদ্ধার সাথে ইতিহাসের মহানায়কের অবদান স্মরণ করে নানা আয়োজনে জাতি উদযাপন করছে মুজিববর্ষ। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স মাত্র ৫১ বছর। স্থপতি তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বাধীন দেশটি গড়ায় নেতৃত্ব দিতে সময় পান মাত্র সাড়ে তিন বছর। ঘাতকের নিষ্ঠুর আঘাতে পরিবারের সদস্যবর্গসহ মাত্র ৫৫ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর জীবনদীপ নিভে না গেলে আরও অন্তত বিশ বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। এ পটভ’মিতে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উৎসবের মধ্যে এক অন্তর্লীন কান্নার অস্ফ’ট ধ্বনি তাই বয়ে চলেছে জাতির চিত্তে। ১৯৭৫-এর চক্রান্তমূলক হত্যাযজ্ঞের দিন বিদেশে থাকায় পরিবারের মধ্যে বেঁচে যান শুধু বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এটা সৌভাগ্যও বটে যে, অনেক প্রতিকুলতার মধ্যে বিরতি দিয়ে দুই দফায় তিন মেয়াদের সরকার চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্ব দেশে প্রভূত উন্নতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। নজরকাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিশ^ আজ বাংলাদেশের প্রশংসা করছে। তবে সব অগ্রগতিই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। আজ যত উন্নয়ন, তত দুর্নীতি। যত প্রবৃদ্ধি, তত বৈষম্য। যত ধনাগম, তত অপরাধ। যত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার খুঁটি পোঁতা, তত সামাজিক অস্থিরতা। নারীর ক্ষমতায়ন যত, ততই নারী নির্যাতন। যত ধর্মের বয়ান, তত অধর্ম। কেন এই ভারসাম্যহীনতা?
জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীর উৎসবকালে আমাদের মনে পড়বে, যত স্বল সময়ই তিনি দেশ শাসন করুন, যত সংকট তাঁকে ঘিরে ধরুক, ততই আদর্শের প্রতি তাঁর অবিচল থাকা, ততই তাঁর দৃঢ়তা, ততই দেশের মানুষের প্রতি তাঁর উপচে পড়া অকৃত্রিম ভালবাসা। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবার স্বপ্ন তিনি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করা পর্যন্ত ত্যাগ করেননি। আমাদের মনে হবে, বঙ্গবন্ধুকে আজ আমাদের অনেক বেশি প্রয়োজন।
বঙ্গবন্ধুকে কেন প্রাণ দিতে হয়েছিল? তাঁর ঘাতকরা ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী। তাঁকে হত্যা করেই সিঁড়িতে লাশ ফেলে রেখে পাকিস্তানি ভাষায় জিন্দবাদ দেওয়া তার প্রমাণ। তারা শোষিত মানুষের বিরুদ্ধে। সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র কেটে দেওয়া তার প্রমাণ। তারা সাম্প্রদায়িক। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা কেটে দেওয়া তার প্রমাণ। তারা গণতন্ত্রেরও বিরুদ্ধে। সামরিক শাসন জারি ও সামরিক ফরমানে জনগণের সংবিধান কাটাছেঁড়া করা তার প্রমাণ।
বঙ্গবন্ধুর সরাসরি যারা ঘাতক তাদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কয়েকজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর আদর্শিক শত্রুরা কি এতটুকুও পিছু হঠেছে, না ভিন্নভাবে আরও বলীয়ান হয়েছে? বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যদি হয় চার নীতিতে ব্যক্ত, ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদনকালে গণপরিষদে তাঁর ভাষণে যা অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে পরিস্ফ’ট, তবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা আমরা পূর্ণাঙ্গ পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে এগোচ্ছি কি-না, আমরা নীতির যুগোপযোগী সংস্কার করছি না আপস করছি সে-প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়াবে জন্মশতবর্ষের উৎসবকালে। সংবিধানের চার মূলনীতির প্রতিটি তিনি নিজ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে নির্দ্বিধায় তিনি শোষিত মানুষের পক্ষে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নাদর্শের সারাৎসার কয়েকটিমাত্র শব্দে তুলে ধরা যায়, ‘বাঙালির অধিকার’ও ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। তাঁর জীবৎকালের শেষ দুই বছর যখন চতুর্দিক থেকে শত্রু ও সংকট তাঁকে ঘিরে ধরেছে এবং নতুন পথ ও পদ্ধতি বের করে তিনি মোকাবেলা করছেন, লড়ছেন, তখন এই অধিকার ও শোষিত মানুষের স্বার্থের কথা তাঁর বজ্রকণ্ঠে আরও জোরে বেজে উঠতে শুনি আমরা। গণতন্ত্রের চেনা পথ সাময়িকভাবে পরিহারের কথা বলে তাঁর গঠিত বিতর্কিত একক জাতীয় দল ‘বাকশাল’ কার্যকর করার তিনি সময় পাননি। তাঁকে সময় দেওয়া হয়নি। সেটা ঐতিহাসিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। পরিত্যক্ত কাঠামো ও পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক না করে তাঁর অভিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকার বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ।
বঙ্গবন্ধুর সবরকম চেষ্টা সত্ত্বেও লুটেরাদের তাণ্ডবে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়ছিলেন। তিনি তাঁর নিজ দলের সদস্য ও ছাত্রকর্মীদের আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির তাগিদ দিয়েছেন অনেক প্রকাশ্য ভাষণে। ১৯৭৫-এর ১১ই জানুয়ারি কুমিল্লায় সামরিক একাডেমিতে ভাষণে বলেন, “মাঝে মাঝে আমরা অমানুষ হয়ে যাই। আমরা এত রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। তবু অনেকের চরিত্র পরিবর্তন হয়নি। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি আর মুনাফাখোর বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে।…বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে।… আমাকে বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে সব জিনিস আনতে হয়। কিন্তু চোরের দল সব লুট করে খায়, দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে।…আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, বাংলাদেশের মাটি থেকে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি আর মুনাফাখোরদের নির্মূল করবো।” বঙ্গবন্ধুর কথা ছিল, আওয়ামী লীগের সীমাবদ্ধতার কারণেই তিনি বাকশাল করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু যে ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ চোরদের দেখেছিলেন তাদের উত্তরসূরিরা আজ ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করে দেওয়ার মতো বা রূপপুরের বালিশকাণ্ড ঘটানোর মতো মহাডাকাত। দেশের এক কঠিন বাস্তবতা যে, শোষক বনাম শোষিতের লড়াই যখন আছে, লুটেরাদের বাড়বাড়ন্ত ও সংকটের সাজুয্য যখন আছে, তখন বঙ্গবন্ধুর সে-সময়ের আর্তনাদসম ভাষণের অনুরণন আজ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠেও কিছু ধ্বনিত হতে শুনি। তিনিও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে লড়াই করছেন যা শুরু করতে হয়েছে দলের ভেতর থেকে। তাঁর ভাষণেও দলের লোকের বিরুদ্ধে, সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও খেদ ঝরে পরে। বঙ্গবন্ধু সময় পেয়েছিলেন অনেক কম। তাঁকে বাঁচতে দেওয়া হয়নি। জাতির আকাক্সক্ষা, দীর্ঘ সময় শাসনদণ্ড হাতে রাখা আজকের প্রধানমন্ত্রী যেন পিতার দীক্ষায় ওই আবর্ত খান খান করে ভেঙে দিতে পারেন।
উৎসব ও সংকটের এই ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধুকেই আমাদের স্মরণ করতে হয়। পিতা, আমরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে তোমার ভাস্কর্য, তোমার ম্যুরাল স্থাপন করেছি। আমরা যেন তোমার শিক্ষা নিয়ে, তোমার আদর্শে তোমার দেখানো পথে চলি। তোমার ভাষণে ভাষণে আমাদের কানে কানে প্রাণে প্রাণে সব সময় মঙ্গলবার্তাই তুমি দিয়েছ। তাই যেন আমরা শুনি। যেন মরুপ্রান্তরে মরীচিকার পেছনে না ছুটি। যেন তরাসে আমাদের হৃদয় কখনো না কাঁপে।
এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ
ইভটিজিং প্রতিরোধে নারী শিক্ষার্থীদের ভাবনা
জুন ১৩, ২০২১
প্রান্তিক মানুষের কাছে করোনা এখনোও গুজব
জুন ৫, ২০২১