ধর্ষণবিরুদ্ধ আন্দোলন নিয়ে কিছু সোজাসাপ্টা কথা

যেকোন আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংগঠিত শক্তির প্রয়োজন। নারী নির্যাতন নিয়ে দশকের পর দশক এনজিওরা কাজ করলেও তাদের দৌড় আলোচনা আর সেমিনারেই বন্দি। ফলে প্রতিকারের জন্য শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সংগঠনের কাছে মানুষকে ফিরে যেতে হয়।

|| মুজতবা হাকিম প্লেটো ||

ধর্ষণের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে মানুষের জেগে ওঠার প্রধান কারণ সাম্প্রতিক নির্যাতনের বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতার ভিডিও ভাইরাল হওয়া। এর আগেও শত শত হাজার হাজার ধর্ষণ হয়েছে কিন্তু মানুষ আন্দোলনের তাগিদ এভাবে অনুভব করেনি।

যেকোন আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংগঠিত শক্তির প্রয়োজন। নারী নির্যাতন নিয়ে দশকের পর দশক এনজিওরা কাজ করলেও তাদের দৌড় আলোচনা আর সেমিনারেই বন্দি। ফলে প্রতিকারের জন্য শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সংগঠনের কাছে মানুষকে ফিরে যেতে হয়।

সাম্প্রতিক আন্দোলনে সাদামাটা কিছু দাবি তোলা হয়েছে। দাবিনামা আরো বিস্তৃত করার সুযোগ নিশ্চয়ই রয়েছে। আন্দোলনের ধাপে ধাপে তা হয়তো বিকশিত করা যেতে পারে। তবে শুরুতেই পূর্ণাঙ্গ দাবিনামা পেশ করলে লক্ষ্য স্থির করা যায়।

এখন সরকারে আওয়ামী লীগ। তার ছত্রছায়ায় থাকা পাণ্ডাদেরই নাম এসব ধর্ষণকাণ্ডে উঠে আসছে। খুব সহজেই বলা যায়, এই ধর্ষণগুলো রাজনৈতিক বিকৃত ক্ষমতায়ন আর দাপটের ফল। কিন্তু আওয়ামী লীগ চিরকাল শাসন করেনি। ৭১ এ ব্যাপকভাবে ধর্ষণ হয়েছে। ধরে নিলাম যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে সেই সব ঘটনার বিচার হচ্ছে।

এরপর রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত শক্তির ক্ষমতা কেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় মাপের ধর্ষণকাণ্ড ঘটেছে ২০০১ এ। এর প্রতিটির বিচার হয়েছে কি?

আজকের এই আন্দোলন পরিচালনা করছে বাম সংগঠনগুলো। তাদের বা তাদের গুরু রাজনৈতিক দলগুলোর আপাতত রাষ্ট্রের নিয়ামক শক্তি হয়ে ওঠার কোনোই সম্ভাবনা নাই।

কয়েক দশক ধরেই এই বামদলগুলো তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করছে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে আদতে গণ্য করে না। কিন্তু প্রেসার গ্রুপ হিসেবেও সমাজ সংস্কারে তাদের অবদান আছে।

সেই জায়গা থেকে বামদের উচিত আন্দোলনের দাবিনামায় শুধু আজকের ধর্ষণই নয় অতীতের ধর্ষণগুলোরও বিচার দাবি করা। এতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনৈতিক চক্রের বাইরে রাষ্ট্রের নীতিগত দিক নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারেন তারা।

আওয়ামী লীগ সঠিকভাবেই বুঝতে পেরেছে-এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের আন্দোলনে মোড় নেবে। আর তা নিলেও দেশের নারী নীতির এক চুল পরিবর্তনও হবে না। কারণ স্বল্পমেয়াদে যে পরিবর্তন আসতে পারে তাতে ধর্ষণ বিরোধী মূল শক্তির ক্ষমতায়ন হবে না বরং দিন শেষে ব্যবহৃত টিস্যুর মতো বাস্কেটে জমা হবে।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ অবদি সব আন্দোলনের এইটাই একমাত্র অভিজ্ঞতা। আর বিএনপি-জামাতকে ক্ষমতায় আনার জন্য কোনো নেতার বা নেতাদের রাজনীতি বহির্ভূত তাগিদ থাকতে পারে। তার সাথে বামকর্মীদের আবেগের কোনো সম্পর্ক নাই।

এরই মধ্যে সরকার ফাঁসির মতো কঠিন সাজা দেবার আইন করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সাজা অপরাধী সৃষ্টিতে বড় বাধার বিষয় হলে দুনিয়াতে অপরাধীই থাকত না। ধর্ষক হয়ে ওঠার পেছনে সমাজের আরো অনেক চিন্তাই সহায়ক হয়ে ওঠে।

হেফাজত যখন বলে নারীর পোশাক দায়ী তখন ধর্ষককে রক্ষা করাই হয়। যদিও তাদের এই অষ্টধাতু মার্কা দাওয়াই যে সব ধর্ষণকাণ্ড ঘটছে তার সবগুলোর ব্যাখ্যা দিতে অপারগ।

এক মন্ত্রী বলছেন পর্নভিডিও এই ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার কারণ। দেশে যে ধর্ষণ বেড়েছে এর সরকারি স্বীকৃতি মিলল। তিনি আন্দোলনকারীদের হাতে একভাবে অস্ত্রই তুলে দিলেন। এবার তালাশ করুন ধর্ষণ সহায়ক বিষয়গুলো। আর প্রতিরোধে দাবিনামায় যুক্ত করুন।

আন্দোলনকারীরা খুব সঠিকভাবেই নারী বিদ্বেষী প্রচার নিষিদ্ধের দাবি এনেছেন। শুধু ধর্ষকের সাজা নয়, ধর্ষণকে উৎসাহ দেয় এমন বিষয়গুলোও এতে সাজার আওতায় আনার দাবিটি জোরালো করা প্রয়োজন।

একান্ত ব্যক্তিগত ছবি প্রকাশ করার দায়ে যেসব ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে তার অনেক ঘটনাই তরুণীর স্বেচ্ছায় দেওয়া ছবি ছিল সেসব। টের পাই, বর্তমান তরুণ সমাজ তাদের যৌন জীবন বাপ-দাদার আমলের মতো করে ভাবে না। তারপরও ছবির প্রকাশক সাজার যোগ্য হয়ে ওঠে কারণ সেসব ছবি পাবলিকলি প্রচারের জন্য ছিল না।

দেশে বরাবরই বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্কের চল ছিল-বিকৃত রুচি ছাড়াও তার নানাবিধ কারণও রয়েছে। প্রবাসী কর্মীদের কল্যাণে তা এখন ব্যাপক আকার নিয়েছে। আজকাল অনেক ধর্ষণ মামলা হয় যা আদতে বছরের পর বছর বিদেশে থাকা প্রবাসীর স্ত্রীর গোপন অভিসার মাত্র। বিশেষ পরিস্থিতির চাপে এমন অনেক ধর্ষণ মামলা আজকাল হচ্ছে শোনা যায়।

এক সময় ছেলে-মেয়ে এক রিকশায় চলাচল করাটাও বিশাল ব্যাপার ছিল। এখন তা নেই। তাই বলে নির্দিষ্ট কিছু ক্রিয়া যা যৌন সম্পর্ক বলে চিহ্নিত হয় এখনও তা প্রকাশ্যে আনা সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। অতীতে কোনো এক সময় যৌন ক্রিয়ার মাধ্যমে মার্গ লাভের যে চল ছিল তা কিন্তু টেকেনি। সমাজের এই আপত্তি আমলে নিতে হবে।

ফলে আন্দোলনের মাঠে নেমেই চুমু খাওয়ার নাটক করার কেদ্দারি হটকারিতা ছাড়া কিছু নয়। ২০০১ এর ধর্ষণসহ অতীতের সব ধর্ষণের বিচার চাওয়ার পাশাপাশি এই বিষয়গুলোও আমলে নিতে হবে।

অতীতে কোনো এক নকশালী গ্রুপ মসজিদে বোমা মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারা গত ৫০ বছরে একটিও কেশ উৎপাটন করতে পারেনি। সব পেকে ঝুরঝুর করে ঝরে নিজেরাই চিঙ্কু বনে গেছে।

ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন ভারসাম্য ধরে রেখে এগিয়ে চলুক-সফল হোক কামনা।

লেখক: সাংবাদিক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন