ধর্ষণ, বিচার ও আমাদের রুগ্ন বাস্তবতা

এরজন্য চলমান অস্থির ও সংকটগ্রস্ত সমাজের নানাবিধ সংস্কারের দীর্ঘমেয়াদী একটা চিন্তা রাষ্ট্রকে মাথায় নিয়ে এগুতে হবে এখন থেকেই। নানান টানাপোড়েনে সেটার সম্ভাবনা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট উদ্রেক ঘটলেও সেই ভাবনায় সংশ্লিষ্টদের আর নিশ্চল-নিশ্চুপ বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এখনই করা সম্ভব এমন উপায়গুলো নিয়ে ভাবতে ও এগুতে হবে এক্ষুণি।

|| কেশব রায় ||

দেশজুড়ে সাম্প্রতিক ধর্ষণ আর নারীর প্রতি সহিংসতায় স্তম্ভিত সবাই আমরা। প্রতিবাদ আর সংক্ষোভ-বিক্ষোভে সারাদেশ উত্তাল। সরকারও বিব্রত মোটাদাগে। বিব্রত দেশের প্রধান বিচারপতিও। আইনমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের অন্য অনেক মন্ত্রীও বিষয়টি নিয়ে ব্যক্ত করেছেন তাদের অবস্থান। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানও বাদ যায়নি তার উদ্বেগ জানাতে। সরকার বিরোধীরাও সরকার কিংবা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ছুড়ে মারছেন একের পর এক নিন্দাবাক্যের তির্যক তীর। এমনি পরিস্থিতিতে ধর্ষনের শাস্তি বাড়াতে আইন সংশোধনের উদ্যোগও জানানো হয়েছে সরকারের তরফ থেকে।

কেশব রায়, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, ঢাকা

সে যাই হোক, এই বিভৎসতা থেকে উত্তরণের স্থায়ী সমাধানটা আসলে কি বা কই? আর সেই অভীষ্টসাধনে আমাদের বাস্তবতাই বা আমাদের কতটুকু আশার জোগান দেয় এই স্তম্ভিতকালে ? আলোচনাটা আজ আমার সেই লক্ষ্যেই।

আচ্ছা ধরুন, কালকেই ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে দেওয়া হলো- তাতে ধর্ষণের সংখ্যা কি কমে যাবে আদৌ ? কিংবা ধর্ষকেরা মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে ধর্ষণ বন্ধ করে দেবে তওবা করে ? বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের শাস্তি যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, তাও ধর্ষকেরা আদৌ জানে কি ? কিংবা এই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ভয়ে কি ধর্ষকেরা তাদের ধর্ষণ বন্ধ করে দিয়েছে যথাভিমতে ?

আচ্ছা ধর্ষণের কথা বাদ দিন। প্রতিদিনই তো টিভির স্ক্রল বা পত্রিকার পাতা জুড়ে খুনের দায়ে ফাঁসি কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের খবর প্রচার হচ্ছে ফলাও করে- তাতে কি খুন কমে গেছে একটু-আধটুও ? নাকি তা বন্ধ হয়ে গেছে চিরতরে ? বিগত কয়েক বছর ধরে তো অনেক রাঘববোয়ালই দুর্নীতির দায়ে জেলে গেছেন কিংবা যাচ্ছেন- তাতে কি দুর্নীতি কমেছে ছিটেফোঁটাও ?

পাচার ও বিক্রি করতে গিয়ে হরহামেশাই ক্রসফায়ারে মারা যাচ্ছে অনেক মাদক ব্যবসায়ী ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা- তাতে কি ইয়াবা ও ফেনসিডিলের মত রমরমা মাদক ব্যবসা কমেছে যৎসামান্যও ?

অপরাধপ্রবণতায় আক্রান্ত এই দেশে দু-চারটি আলোচিত মামলার বিচারকাজ অতি দ্রুত বা দুই-ছয় মাসের মধ্যে শেষ করার মধ্য দিয়ে কি বর্তমানে চলমান ছত্রিশ লাখ মামলার জট কমিয়ে ফেলা গেছে বা যাবে আদতে ?

এই সকল জিজ্ঞাস্যের পরিস্কার উত্তর হচ্ছে- ‌‘না’। আমাদের বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে এই সব কোনাচে পথ ধরে অভীষ্টসিদ্ধি হবে না কোনোমতেই। চলমান সঙ্গিন অবস্থায় আমাদের পিঠ এমন ভাবে দেয়ালে ঠেকে গেছে যে, এখন সময় হয়ে গেছে এমন করে ভাববার যে, কীভাবে এমন বাড়বাড়ন্ত অপরাধসমূহের লাগাম টেনে ধরা যায় দ্রুততর সময়ের মধ্যে?

এরজন্য  চলমান অস্থির ও সংকটগ্রস্ত সমাজের নানাবিধ সংস্কারের দীর্ঘমেয়াদী একটা চিন্তা রাষ্ট্রকে মাথায় নিয়ে এগুতে হবে এখন থেকেই। নানান টানাপোড়েনে সেটার সম্ভাবনা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট উদ্রেক ঘটলেও সেই ভাবনায় সংশ্লিষ্টদের আর নিশ্চল-নিশ্চুপ বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এখনই করা সম্ভব এমন উপায়গুলো নিয়ে ভাবতে ও এগুতে হবে এক্ষুণি।

প্রশ্ন হচ্ছে, তার মধ্যে কোন্ বিষয়টার অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ঠিক এই মুহূর্তে ? রাজপথের বিক্ষুব্ধদের একটা বড়ো অংশ ধর্ষণ বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন। দাবির যৌক্তিকতা শতভাগ। প্রয়োজন সাপেক্ষেই তো নতুন নতুন আইন তৈরি হয় আর বিশেষ বিশেষ আদালত গঠিত হয়। হয়েছেও গেল সময়ে, হচ্ছে এখনও। গত দুই দশকে সময়ের প্রয়োজনে এমন বিশেষ আইন প্রনয়ণসহ বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে কয়েক ডজন। তাতে একদমই কাজের কাজ যে হয়নি তা কিন্তু নয়, তাতে সর্বসিদ্ধি হয়েছে কী ? হয়নি মোটেও। প্রশ্ন হচ্ছে- হয়নি কেন? হয়নি এজন্য যে, যেখানে এমন আদালতের প্রয়োজন ছিল পাঁচটি সেখানে হয়তো হয়েছে একটি। তাতে বিচারপ্রার্থীরা নামসর্বস্ব একটি বিশেষ আদালতে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু দ্রুত প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তি কমেনি তার একটুও। কিছুদিন যাওয়ার পর দেখা যায় ওই বিশেষ আদালতেই আবার জমে যাচ্ছে মামলার বিশাল এক স্তুপ।

বিশেষ আইন বা বিশেষ আদালতের কথা বাদই রাখলাম। আসল কথা এই যে, আমাদের এই বিশাল জনসংখ্যা আর লক্ষ লক্ষ মামলার তুলনায় বিদ্যমান স্বল্পসংখ্যক আদালত বা বিচারক দিয়ে বিচারবিভাগ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করার কোনো সুুযোগ নেই সঙ্গত কারণেই। সতেরো শ ঊনচল্লিশ কোটি টাকা বার্ষিক বাজেটের বিচারবিভাগ থেকে অলীক কিছু কেবল প্রত্যাশা করা যেতে পারে স্বপ্নঘোরেই, বাস্তবতার নিরিখে তা নয় মোটেও !

গত সপ্তাহ দুয়েক ধরে একের পর এক সামাজিক ভিত নাড়িয়ে দেওয়া ধর্ষণের ঘটনার রেশ ধরে উত্তরণের কত কত বিশেষজ্ঞ মতামতই না শুনছি আমরা ! সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ অবশ্য যথার্থই বলছেন; তবে সংক্ষুব্ধ বা বিক্ষুব্ধদের বেশীর ভাগই বলছেন হয় না জেনে অথবা না বুঝে, তারা বলছেন কেবল সাময়িক আবেগের বশবর্তী হয়ে।

একদমই সত্য যে, সবাই সব বিষয়ে জানার কথা নয় বা সব জানার সুযোগও নেই। তবে প্রয়োজনের তাগিদে দরাজগলায় দাবি তোলার মতো এমন আবেগেরও যথেষ্ট আবশ্যকতা রয়েছে রাজপথে। কিন্তু আমরা সংশ্লিষ্টরা যারা বছরের পর বছর ধরে এই সমস্যাটা দেখছি বা বলছি বা মূলে কাজ করছি, তাদের দাবি বা উপলব্ধির মূল্যও কি চোকানো হয়েছে আজ অবধি ?

ধর্ষণের মামলা হোক, খুনের মামলা হোক, দুর্নীতির মামলা হোক কিংবা কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি যেই মামলাই হোক না কেন, পাঁচ-সাত-দশ বছর ধরে মামলা চললে তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব সমাজে পড়ার যৌক্তিক অবকাশ আছে কী ? বরং তাতে হাঁপিয়ে চলা বিচারবিভাগের প্রতি দিনদিন ভুক্তভোগীদের আস্থা কমছে আরও। খেয়াল রাখতে হবে এটা সর্বাগ্রে যে, বিচারকেরা কোনো যন্ত্র বা মেশিন নন। দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ বা পাঁচগুণ মামলা কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে কোনো বিচারকের কাছ থেকে এর বেশি প্রত্যাশা করা স্রেফ বাতুলতা মাত্র !

প্রসঙ্গক্রমে একটা মামলার আসামির উপলব্ধির কথা এখানে উল্লেখ করতেই হচ্ছে। সাধারণ মারামারির এক মামলায় সাত বছর পরে আসামিকে নির্দোষ সাব্যস্তে খালাস দেওয়া হলে আসামি নিশ্চল কাঠগড়ায় অব্যক্তে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আসামির আইনজীবী আসামিকে ইশারা করে আমাকে সালাম দিতে বললে আসামি আমার দিকে বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন- “যেই দিন মামলা হইছে আমি তো হেই দিনই জানি আমি নির্দোষ, আর এইডা জানতে কোর্টের লাগছে সাত বছর !” স্রেফ নির্বাক হয়ে স্বস্থানে বসে থাকা ছাড়া আমার আর কোনো গত্যন্তর ছিল না সেই সময়। যদিও তার অন্তঃস্থ ভাবাবেগে অন্তরিন হয়ে আছি আমি এখনও।

নানান সীমাবদ্ধতার কারণে সকল বিচারপ্রার্থীরা হয়তো এমন ক্ষোভ মেশানো হতাশার কথা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করার সুযোগ পায় না আদালতে, কিন্তু তাদের অব্যক্ত হতাশা আর বঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস আমাদের বিচারকদের নানা ইন্দ্রিয় হয়ে তা অবশেষে ঠাঁই পায় মনের অন্দরমহলে, যার অসহ্য ভার বয়ে বেড়াতে হয় আমাদের প্রতিনিয়তই।

এমনি করে সারাদিন শম্ভুকগতির বিচারকাজ শেষে যখন ঘরে ফিরে ক্লান্ত শরীর আর অতৃপ্ত মন নিয়ে টিভির সামনে চোখ রাখি আর দেখি বিচারহীনতার সংস্কৃতি কিংবা ধীরগতির বিচারব্যবস্থা নিয়ে আমাদের তুলোধুনা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তখন রাগ-ক্ষোভ আমাদের চিত্তে দ্বিগুণ হারে উদ্গারিত হলেও তা চেপে রাখতে হয় সঙ্গত কারণেই। সেই চাপা ক্ষোভ থেকেই বলছি- চটকদারিত্বমূলক কথা, দাবি বা সমাধান বিচারবিভাগের আমূল সংস্কারের নিমিত্ত কোনো চূড়ান্ত সমাধান নয়। বরঞ্চ হাঁটতে হবে সংশ্লিষ্টদের স্থায়ী এবং চূড়ান্ত সমাধানের অভিমুখ ধরেই।

আর সেই লক্ষ্যে আইন সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান প্রনয়ন, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন ইত্যাদি নানামুখী সাময়িক সংস্কারের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের নিমিত্তে অচিরেই আদালতের সংখ্যা তথা বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে কয়েকগুণ, ক্রমান্বয়ে। তাতে অপরাধ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে এমনটা বলা যাবে না কিছুতেই; তাতে অন্তত কার্যকর দ্রুত বিচারের মাধ্যমে আইন-আদালতের প্রতি জনমনের আস্থা এবং ভয় দু’টোতেই টেকসই ছাপ ফেলানো সম্ভব নিশ্চিতভাবেই।

বিগত সময়ের এতদ্রুপ পরিক্রমা পর্যালোচনায় এটা এখন নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, চলমান জোড়াতালি বা শর্টকাট বিচারের সংস্কৃতি আকঁড়ে ধরে কমানো বা বন্ধ করা যাবে না এমন সব অপরাধের পৌনঃপুনিকতা। ফলত, অচিরেই আবার কোনো একদিন এমন কোনো বিভৎসতায় গণ-শ্লোগানে কেঁপে ওঠবে রাজপথ; টিভি-মিডিয়ায় বিচারালয়ের প্রতি বিদ্রুপের ঝড় উঠবে সংশ্লিষ্ট বা সবজান্তা বিশেষজ্ঞদের; ভুক্তভোগীদের হাঁসফাঁসে তপ্ত হবে বিচারালয় আর বিচারকেরা খাবি খাবেন কেবল দৃষ্টির অগোচরে !

তাতে কাজের কাজ আসলে হবে না কিছুই। বরঞ্চ অলক্ষেই থেকে যাবে রাজপথের সময়ের দাবি, বিচারপ্রার্থীদের ক্রমাগত গোঙানি আর বিচারকদের অন্তঃপুরের চাপা ক্ষোভ !

লেখক: অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, ঢাকা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন