কোভিড নমুনা পরীক্ষায় নয়ছয়ের চূড়ান্ত, মূল্য দিতে হচ্ছে জীবন দিয়েও

|| শহিদুল আলম ||

‘একটা ছোট সাইজের পিৎজা আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ পাঠিয়ে দিতে পারবেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে? উনি কিছু খাচ্ছেন না, হয়তো স্বাদবদল হলে খেতে পারতেন।’আমাদের সবার প্রিয়, মুক্তিযোদ্ধা ড. জাফরুল্লাহর কথা বলছিলেন তার স্ত্রী শিরীন হক। বলাই বাহুল্য, পিজ্জার খোঁজ করতে আমি একমুহূর্ত সময় নষ্ট করিনি।

জ্যাফ, (কাছের মানুষরা তাকে এ নামেই ডাকে) প্রতি সপ্তাহে চরে গিয়ে সেখানকার মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করত, আমারও খুব ইচ্ছা করতো আমি এই খালি-পা ডাক্তারের সঙ্গী হই। আমাদের বাড়ির পাশেই তারা থাকে। ৫ বছর আগে যখন আমি, জ্যাফ, রেহনুমা শিরীনসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হয়, তখন তাদের মুক্ত বাড়িটাই আমাদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়। আমদের যুক্তি ছিল, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে সাংবাদিক কাজ করে, তাকে শাস্তি দেয়া আমাদের সংবিধানের চেতনার বিরোধী. বিরুদ্ধ মত প্রকাশের স্থান দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছিল, রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। কোটা আন্দোলনের পর শুরু হলো নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। এরপরেই গ্রেপ্তার হলাম আমি।

জেল থেকে আমার বেরিয়ে আসতে আসতে পরিস্থিতি পাল্টে গেল। জ্যাফের এখন নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়, ফলে চরে যাওয়া বন্ধ। ডায়ালাইসিসের খরচ এত বেশি দেখে, জ্যাফ নিজেই একটি ডায়ালাইসিস সেন্টার খুললো তার হাসপাতালে। খরচ হাতের নাগালে রেখেই সেখানে খুব উচ্চ মানের ডায়ালাইসিস সেবা দেয়া হয়। তার ব্যবসার পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্বচ্ছল রোগীরা দরিদ্র রোগীদের চেয়ে বেশি টাকায় সেবা দেবে, যেটা দিয়ে দরিদ্র রোগীদের ভর্তুকি দেয়া হবে, এতে দুই পক্ষই একই মানের সেবা পাবে। তবে বাংলাদেশি এলিটদের নাক উঁচু মনোভাবটা জ্যাফের হিসেবের মধ্যে ছিল না। সেবা যতই ভালো হোক, খুব কম সংখ্যক স্বচ্ছল রোগীই দরিদ্রদের সাথে এক কাতারে চিকিৎসা নিতে রাজি হলো। জ্যাফের ডায়ালাইসিস সেন্টারে ভালো মানের সেবা দেয়া অব্যাহত রয়েছে, তবে শয্যাগুলোর বেশিরভাগই দরিদ্র রোগীদের দখলে।

সাত মসজিদ রোডের বেলা ইটালিয়া রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তবে তখনও খাবার প্যাকেট করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। আমার মিষ্টি খাবার পছন্দ, তাই নিজের জন্য চকোলেট মিল্কশেক নিয়ে নিলাম। তারপর সোজা মিরপুর রোডের গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে। সেখানকার সব কর্মীরাই আমাকে চেনে, আমি সোজা আইসিইউতে চলে গেলাম। জ্যাফ তখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই আমি ডিউটিতে থাকা নার্সের কাছে পিৎজা আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ দিয়ে বাসায় চলে গেলাম।

এরপরের কয়েকটা দিন আমাদের সবারই খুব উৎকন্ঠার মধ্যে গেল। শিরীন এবং তাদের ছেলে বারিশেরও কভিড -১৯ ধরা পড়েছে, তবে জ্যাফের বয়স বেশি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা থাকায় তাকে নিয়েই আমাদের সবচেয়ে বেশি দুঃশ্চিন্তা ছিল। শিরীন, বারিশ, ড. হাফিজ এবং অন্যান্য ডিউটি ডাক্তারদের কাছ থেকে খোঁজ খবর নিয়ে রেহনুমা নিয়মিত ই-মেইল পাঠাতো। নিজের সাংবাদিকতার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সার্বিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতেন গোলাম মর্তুজা।

যখন আমার অল্প অল্প জ্বর, গিঁটে ব্যথা, রুচিহীনতা, হালকা ডায়রিয়া আর অত্যাধিক ঘামের মত মৃদু কিছু উপসর্গ দেখা দিল, রেহনুমা চিন্তায় পড়ে গেল।

আমরা ক্ষুধার্তদের খাবার বিতরণ করতে বাইরে বের হয়েছি। তারচেয়েও বড় কথা আমরা দুজনেই জ্যাফ, শিরীন এবং বারিশের কাছাকাছি গেছি, যারা প্রত্যেকেই পজেটিভ। লক্ষণ ভাল ঠেকছিল না। রেহনুমা আস্থাভাজন কয়েকজন চিকিৎসক সাথে যোগাযোগ করলো, সাথে সাথেই আমার ওষুধের ব্যবস্থা হয়ে গেল। এরই মধ্যে এদিক ওদিক যোগাযোগ করে রেহনুমা একটি ল্যাবের সন্ধান পেল, যারা বাসায় এসে আমাদের দুজনেরই নমুনা নিয়ে যাবে করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্য।

পরদিন বাইসাইকেলে চেপে খুবই হাসিখুশি এক তরুণ এলো আমাদের বাসায়। গ্লাভস এবং মাস্ক পড়া সেই তরুণ খুব ভালোভাবেই জানত কিভাবে সোয়াব নিতে হয়। কৌতুহল বশত আমরা তার কাছে কিট আর পরীক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলাম। ছেলেটি সৎ, জানালো সে এই পরীক্ষা সম্পর্কে কিছুই জানে না। শুধু জানে কিভাবে নমুনা সংগ্রহ করতে হয়, আর কাজটা সে ভালোভাবেই করেছিল।

আমি অবাক হয়েছিলাম, সিল করা প্যাকেটের গায়ে ম্যানুফ্যাকচারের তারিখ কিংবা লট নম্বর কিছুই ছিল না । তবে এ নিয়ে ওই তরুণকে কিছু জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই। সে তো তার সীমাবদ্ধতা জানিয়েই দিয়েছে। আমাদের নমুনা নিতে খুব বেশি দেরি হলো না। রেহনুমা যখন তাকে টিপ দিতে গেল, সে অনেকটা অনিচ্ছুক ভঙ্গিতেই সেটা নিলো।

আমি প্যাকেটের গায়ে লেখা ইমেইল আ্যড্রেসে সাথে সাথেই মেইল করলাম, কোন জবাব ন পেয়ে কোম্পানির ওয়েবসাইটে ঢুকে সহায়তা চেয়ে ফরম পূরণ করলাম। অন্য অনেক পণ্যের সাথে তাদের ছিল ‘কভিড-১৯ স্যাম্পলিং আ্যন্ড এক্সট্র‍্যাকশ সলিউশন’, যেটা ওই তরুণের আনা কিটের মতই দেখতে। পণ্যের বর্ণনায় ‘দক্ষ এবং নির্ভুল নমুনা সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে।

তাদের জবাবের অপেক্ষা করতে করতে আমি ঠিক করলাম পরীক্ষা পদ্ধতিটা নিয়ে একটু খোঁজখবর করি।

বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ফলাফলের জন্য পণ্যটি ব্যবহারের আগ পর্যন্ত মূল প্যাকেটের ভেতরে ৫-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। অত্যাধিক তাপ কিংবা সরাসরি সূর্যালোকের সংস্পর্শে রাখা যাবেনা। গুগলের তথ্য অনুযায়ী, ৮ জুন শেষ দুপুরের তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদিও সেই তরুণের বাইসাইকেলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা মনে হয় না ছিল, তবে ন্যুনতম গ্রহণযোগ্য আদর্শের খুব বেশি ব্যত্যয়ও এখানে ঘটেনি। বরং নমুনা সংগ্রহের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়েই আমার উদ্বেগ বেশি ছিল।

ওয়েবসাইটে নির্দেশনা ছিল, নমুনা সংগ্রহের অল্প দিনের জন্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং দীর্ঘদিনের জন্য হলে -৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হবে। আমাদের ক্ষেত্রে নিশ্চয় এটা অল্প দিনই, কিন্তু ৮ এর জায়গায় ৩১ ডিগ্রি তো কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য না। তাও যদি ধরে নেই ওই তরুণ ফেরার পথে আর কোথাও থামেনি। যদিও তার ব্যাগে অনেকগুলো কিট ছিল বলেই মনে হয়েছিল।

রেহনুমা কয়েকটি ফোন কল করে ভেতরের একজনের কাছ থেকে খবর পেল যে তাদের কাছে যেসব পরীক্ষা হয় তার ৪০ শতাংশেরই ভুল ফলাফল আসে। আমরা একেকজনের পরীক্ষার জন্য সাড়ে চার হাজার টাকা করে দিয়েছি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যদি অন্তত ৫টি পরীক্ষার ফলাফল একই আসে, তাহলে ধরে নেয়া যেতে পারে যে ভুলের সম্ভাবনা শতকরা দুই ভাগেরও কম। তার মানে অন্তত ৫টি পরীক্ষা করতে আমাদের দুইজনের জন্য খরচ হবে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা!

আমি এবার গবেষণা শুরু করলাম পরীক্ষার খরচ নিয়ে, আরেকটু অনুরোধ জানিয়ে মেইল করলাম ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে। ১১ জুন, ২০২০ বৃহস্পতিবার রাত ৩টা বেজে ৬ মিনিটে ইমেইলটা এলো।

সেলস ম্যানেজার লিখেছেন, আমাদের ক্লাসিক ভাইরাস এন্ড ট্রান্সপোর্ট মিডিয়াম কিটস (ভিটিএম কিটস) এর বিষয়ে আগ্রহ জানানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। নাম দেখে আমি বুঝলাম না তিনি নারী না পুরুষ, তবে তিনি আমাকে পণ্যটির একটি ম্যানুয়াল ও মূল্যতালিকা পাঠিয়েছেন। নির্দিষ্ট করে জানিয়েছেন প্রতিটি কিটে একটি সোয়াব, ১০ মিলি লিটারের একটি টিউব এবং একটি ৩ মিলিলিটার মিডিয়াম থাকে। ওই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন প্রায় তিন লাখ কিট বানানোর সক্ষমতা আছে, এবং তারা খুব দ্রুতই সেগুলো সরবরাহ করতে পারে।

তারপর আমি কিটের দামটা খেয়াল করলাম। প্রতিটি কিটের দাম ১.১০ মার্কিন ডলারের মতো! অর্থাৎ প্রায় ৯৩ টাকা! বাংলাদেশি হাসপাতালের জন্য এই পরীক্ষার লাভ খুব কম না! হ্যা তাদের কিছু পরিবহন খরচ আছে, কর দিতে হবে, স্থানীয়ভাবে পরীক্ষার জন্য আরো কিছু খরচও আছে। তবু একেকটি কিটে প্রায় ৪৭০০ শতাংশ লাভ! নিজেদের পকেট ভারি করা আর হাতের তালুতে ঘি মাখানোর জন্য যথেষ্ট। আর যদি নমুনা সংগ্রহ পদ্ধতিতে ভুলের কারণে একাধিক পরীক্ষা করাই নিয়মে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে তো এটা রীতিমতো একটা অন্তহীন সোনার খনি!

এর চেয়ে অনেক কম দামে, স্থানীয়ভাবে তৈরি একটি কিটকে অনুমোদন দিলেই, অর্থাৎ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের র‍্যাপিড ডট ব্লট টেস্ট কিট, পুরো পরিস্থিতিটাকে পাল্টে দেয়া যেতো।

আমরা রূপপুরে বালিশ কাণ্ডের কথা শুনেছি, নকল এন ফিফটি মাস্ক, ৫০০০ গগলসের কথা শুনেছি৷ আরো সম্প্রতি ১৮ লাখ টাকার ফ্রিজ দুই কোটি টাকায় কেনার খবর পেয়েছি। কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা যখন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে, তখন টাকা ছাপানোর চেয়ে এগুলোই কার্যকর পদ্ধতি তো বটেই।

কোনোভাবেই একটি সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য, স্থানীয়ভাবে তৈরি কিট সবার জন্য সহজলভ্য করা গেল না। টাকা বানাতে হবে, আর গণস্বাস্থ্যের কিট এতে বাগড়া দিতে পারে। নোম চমস্কির “ফেইলড স্টেট: দ্যা আ্যবিউস অফ পাওয়ার আ্যন্ড দ্যা আ্যসল্ট অন ডেমোক্রেসি” এর কথা মনে পড়ে… ’’ As in the past, the costs and risks of the coming phases of the industrial economy were to be socialized, with eventual profits privatized ….’

যেমন আন্দাজ করা গিয়েছিল, জ্যাফ যখন গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে জীবনের জন্য লড়ছে, কভিড-১৯ থেকে সেরে উঠলেও নিউমোনিয়ায় ভুগছে সে, তখন খবর এলো, দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা গণস্বাস্থ্য কিট ‘অকার্যকর।’

গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের এই কিট নিয়ে যে দোষারোপের খেলা চললো, সাথে প্রখ্যাত চিকিৎসকদের দিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল, এর বিপরীতে রয়েছে আমদানি করা কিটে কোন ধরণের মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অনুপস্থিতি। পরিষ্কারভাবেই এর সাথে টাকা কামানোর সম্পর্ক রয়েছে।

সরকারের এই অসৎ লাভের খাতিরে আমরা যে কেবল আর্থিক ক্ষতিই স্বীকার করছি তা কিন্তু নয়। আমাদের এর মূল্য দিতে হবে জীবন দিয়ে।

সংবাদসূত্র : নিউ এইজে প্রকাশিত ইংরেজি থেকে অনুদিত লেখাটি দেশরূপান্তরের সৌজন্যে ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন