||সারাবেলা ডেস্ক||
করোনা সংক্রমণ যেন কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। এরই মধ্যে প্রাণঘাতি এই অনুজীব বদলে দিয়েছে আমাদের যাপিতজীবনের অনেক অভ্যাস। করোনা থেকে দূরে থাকতে আমরা ইতোমধ্যেই থাকছি ঘরে, রাখছি পরস্পর থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব, হাত মেলাচ্ছি না অন্যের সঙ্গে। প্রিয়জনকেও জড়িয়ে ধরছি না সহসা।
তবে এই করোনা রুখতে আমরা আফ্রিকার মানুষের কাছ থেকে নিতে পারি তাদের অভিজ্ঞতার অনেককিছুই। কেননা তাদের রয়েছে ইবোলা, জিকা কিম্বা চিকনগুণিয়ার মত বেশ কতক মারাত্মক অসুখ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা।
বিস্তর দারিদ্র, অনুন্নত অবকাঠামো আর অপেক্ষাকৃত কম স্বাস্থ্য সুবিধা ও স্বাস্থকর্মী নিয়ে এরআগে বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যদুর্যোগ পারি দিয়েছে আফ্রিকার দেশগুলো। সারাবিশ্বে দেড়শ’র বেশী দেশ এখন প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস সংক্রমণে বিপর্যস্ত। যদিও এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসটি আফ্রিকাতে খুব ভালভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি।
এমনি প্রেক্ষাপটে আফ্রিকার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বিশ্বকে জানাতে চাইছে তাদের আগের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া চারটি পথপদ্ধতি তথা শিখন। যেসব পথপদ্ধতিতে আফ্রিকার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানাতে চাইছেন বৈশ্বিক এই বিপর্যয় মোকাবিলায় কী করা দরকার আর কী করা যাবে না।
শিখন এক :
যতদ্রæত সম্ভব স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি তথা সমাজনেতাদের জড়িত করতে হবে এই সংক্রমণ বিস্তার ঠেকানোর পথপদ্ধতির বাস্তবায়নে। ২০০৩ -০৪ সালে নাইজেরিয়ায় পোলিও বিস্তারে যে কাজটি করেছিল দেশটির রাষ্ট্র।
২০০০ সালের প্রথম দিকে বিশ্বের প্রায় ৯৯ শতাংশ এলাকাতে ছড়িয়ে পড়ে পোলিও নামের এক মারাত্মক অসুখ। বিপর্যয়কর এই অসুটি বলা হয়েছিল বিশ শতকের সবথেকে ভয়াবহ রোগ। মানুষের পঙ্গুত্ব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানোর মত এই রোগটি যুক্তরাষ্ট্রের সেসময়ের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্টসহ হাজারো মার্কিনীকে আক্রান্ত করেছিল।
তবে ২০০২ সালের দিকে নাইজেরিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে এই পোলিও। যাতে আক্রান্ত হয় দেশটির ২০১ জন মানুষ। এই পোলিও ২০০৩ সালের জুলাই ও ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে দেশটির বাউচি, কাদুমা, কানো, নাইজার ও জামফারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপকভাবে। বিশেষ করে এর প্রতিষেধকে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে এমন গুজবে মানুষের টিকা নিতে অনিহায় এই রোগের বিস্তার ঘটে দ্রæত। সেসময়ে গবেষকরা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষন করে দেখতে পান যে, স্থানীয় রাজনৈতিক ও সমাজ নেতাদের পরামর্শেই মানুষ এই টিকা নিতে রাজী হয়নি। সংশ্লিষ্টরা এও যুক্তি দেখালেন যে, স্থানীয় নেতা ও সমাজপতিদের বাদ দিয়ে উপর থেকে নিয়ে যাওয়া ব্যয়সাধ্য এই টিকা কর্মসূচি সফল করা মোটেও সম্ভব হবে না।
গবেষকদের এসব অভিজ্ঞতা ও যুক্তি আমলে নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, গোষ্ঠিপতি, ও বিজ্ঞানীদের টিকাদান কর্মসূচিতে যুক্ত করলেন দেশটির কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ইতোমধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। এরপর ২০১২ সালে এই অসুখটি ফের দেখা দেয় নাইজেরিয়াতে। আর সংখ্যার দিক থেকে তা ছিল গোটা বিশ্বে পোলিও আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশী। দেশকে সম্পূর্ণভাবে পোলিওমুক্ত করতে দেশটির সময় লাগে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। আর মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়ে যায় যে কোন রোগবিপর্যয় ঠেকাতে স্থানীয় নেতৃত্বের সংশ্লিষ্টতার বিকল্প নেই।
শিখন দুই :
আক্রান্ত ছাড়াও অন্যদের অসুস্থতাও বিবেচনায় নিতে হবে। যেমনটা ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল সময়ে এবোলা মোকাবিলায় কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র করেছিল।
ঋয়াবহ এবোলা ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ সুদানে। এরপর ২০১৮ থেকে ২০ সাল সময়ে কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে আক্রান্ত হয় ৩ হাজার ৪৪৪ জন। যার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ মানুষ। কঙ্গোর মানুষদের কাছে এবোলা হুমকি হলেও তা দেশটির প্রত্যেকের জন্য উদ্বেগের কারণ ছিল না। মেদসাঁ স্যঁ ফ্রন্তেয়াখঁ এমএসএফ’র এক কর্মী সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমার সন্তানরা যেন ম্যালেরিয়া কিংবা ডায়রিয়াতে মারা না যায় সেটাই আমি আগে দেখবো। আমার কাছে এবোলা মুখ্য নয়, সেটা আপনার কাছে হতে পারে।’ আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ২০১৯ সালে কঙ্গোতেই এবোলা আক্রান্তদের সুশ্রষা করতে গিয়ে মারা গেছে ৩শ’র বেশী স্বাস্থ্যকর্মী। আর এই বিষয়টিই সবাইকে জানাতে হবে যে, আক্রান্তদের পাশাপাশি অন্যদের স্বাস্থ্য সম্পর্কেও আমাদের সচেতন হতে হবে। এটা করা না গেলে ব্যর্থতাই হবে আমাদের পরিনতি।
শিখন তিন :
অসুস্থকে দোষারোপ নয় কিংবা অসুস্থতার জন্য সমাজের নির্দিষ্ট কোন গ্রæপকে দায়ী করা যাবে না। যেমনটা করা হয়ে থাকে এইচআইভি/এইডসের ক্ষেত্রে।
গেল বিশ শতকেই এইচআইভি/এইডসে মারা গেছে প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ। ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে এ পর্যন্ত সময়ে এই এইচআইভি/এইডস সবথেকে ভয়াবহ স্বাস্থ্যদুর্যোগ। প্রায় পৌনে চার কোটি মানুষ এই অসুখে আক্রান্ত এবং এই অসুস্থতা নিয়েই জীবন টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এইচআইভি/এইডস একটি জটিল স্বাস্থ্যসমস্যা হলেও তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। অনেকেই এই অসুস্থতা নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে থাকছেন। এরপরও এই অসুস্থতা নিয়ে সমাজে নানা কুসংস্কার রয়েই গেছে। অনেকেই এখনো জানেন না বা মানতে চান না যে, এইচ্আইভি অন্য কোনভাবে নয়, সংক্রমিত হয় শুধু যৌনমিলনে ও রক্তের সঞ্চালনের মধ্য দিয়ে। এছাড়া এটি তো মোটেও ছোঁয়াচে কোন অসুখ নয়।
তারপরও সমাজে অপাঙ্তেয় হওয়ার ভয়ে অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন কি না তা জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এমনকি চিকিৎসাও নিতে যান না। গেল বছরের তথ্য বলছে, শুধু ২০১৮ সালেই নতুন করে বিশ্বজুড়ে ১৭ লাখ মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছে।
কিন্তু করোনার সংক্রমণের পথপদ্ধতি এইচআইভির মত না হলেও এ নিয়েও রয়েছে অনেক ভুল ধারণা। রয়েছে সমাজে অপাঙেÍয় হওয়ার ভয়। ইথিওপিয়া ও কেনিয়ার মত দেশগুলোতে মনে করা হচ্ছে বিদেশিরাই করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছেন। আর ইতালি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সবখানে ধরেই নেওয়া হচ্ছে এশিয়রাই প্রাণঘাতি এই ভাইরাস সংক্রমণের জন্য একমাত্র দায়ী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস আধানম ঘেব্রেইয়েসস তো বলেইছেন, ‘আমরা এই সময়ে সবথেকে বড় শত্রæ বলে যাকে মনে করছি তা ভাইরাস নয়, তা হচ্ছে স্টিগমা বা কলঙ্কিত হওয়ার ভয়। যা কিনা আমাদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সহায়তা করছে।’
শিখন চার :
জরুরি স্বাস্থ্যদুর্যোগ ও স্বাস্থ্যসেবায় শুধু সরকার নয়, রাজনৈতিক মত নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সুদানের দারফুরে ২০১২ সালে হলুদ জ্বর মোকাবিলায় যা করা হয়েছিল।
দারফুরে ২০১২ সালে যে হলুদ জ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল তা ছিল আফ্রিকার গেল ২০ বছরের ইতিহাসে সবথেকে ভয়াবহ ঘটনা। এই ভাইরাসটি সংক্রমিত হয় মশার মাধ্যমে। আর এটি হলে আক্রান্তের সাংঘাতিক রক্তক্ষরণ হয়। আফ্রিকা থেকে শুরু হলেও বিশেষ করে দাস ব্যবসার মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে এটি ছড়ায় যুক্তরাষ্টে। এক প্রকার অসমর্থ করে তোলে গোটা ফিলাডেলফিয়া শহরকে। মারা যায় শহরের মোট মানুষের ১০ শতাংশ। বাকিদের দ্রæত সরিয়ে নেওয়া হয় অন্যত্র।
দারফুরে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার দ্ব›দ্ব চলে আসছে বেশ অনেক বছর ধরে। যদিও ২১০২ সালের দিকে এই সংঘাতের অনেকটাই মিটে গেছে বলে মনে করা হয়। তারপরও দেশটিতে অন্যদের যাওয়া-আসা সাংঘাতিকভাবে সীমিত করে রেখেছে দেশটির কর্তৃত্ববাদী সরকার। বিশেষ করে দেশটির স্বর্ণ খনি অধ্যুষিত জেবেল আমির এলাকাটাকে এক প্রকার নিষিদ্ধই করে রাখা হয়েছে। অথচ এই এলাকাতেই হলুদ জ্বরের প্রকোপটা বেশী হয়েছিল।
শেষপর্যন্ত হলুদ জ্বরের কার্যকর টিকা আবিস্কার হলেও সংঘাত বা সংঘাত পরবর্তি বিরোধাত্মক সমাজে এটি প্রয়োগ বেশ কঠিন। যার প্রমাণ মিলেছে দারফুরে। এই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং প্রতিষেধক প্রক্রিয়া ও প্রশমন ব্যবস্থা সবই জানা থাকবার পরও এমনি রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব বিরোধ রয়েছে এমন দেশগুলোতে স্বাস্থ্যদুর্যোগ মোকাবিলা খুব একটা সহজ হয়ে ওঠে না।
বিশেষ করে যেখানে এই ধরনের বিরোধে খোদ সরকার নিজে সম্পৃক্ত। এসব দেশে জনসাধারণ কখনোই বিশ্বাস করতে পারে না যে, সরকার একা এমন স্বাস্থ্যদুর্যোগ সামাল দিতে পারবে। এমন প্রেক্ষিতে যেটি দরকার তা হচ্ছে, সরকারতো বটেই এর সঙ্গে বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা, রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এমন অরাষ্ট্রিক সংগঠন ও দরকার হলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ।#
এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ
ইভটিজিং প্রতিরোধে নারী শিক্ষার্থীদের ভাবনা
জুন ১৩, ২০২১
প্রান্তিক মানুষের কাছে করোনা এখনোও গুজব
জুন ৫, ২০২১