৭ই মার্চের ভাষণে শাসনতন্ত্র…

এখানে গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে- এই ৪০৩ জন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী, যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন পাকিস্থান রাষ্ট্রের সংবিধান রচনার জন্য। এরা কেউ স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য নির্বাচিত নন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিঃসন্দেহে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সর্বোপরি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার ১৮০ ডিগ্রী এঙ্গেলে পরিবর্তন হয়।

|| হাসনাত কাইয়ুম ||

পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ বলে আমাদের সংবিধানের ৫ম তফসিলে ৭ই মার্চের ভাষণকে যুক্ত করা হয়। আপনারা অনেকবার এই ভাষণ শুনেছেন তারপরও কিছু উল্লেখযোগ্য লাইন আবারও দেখা যাক।প্রথমেই বলা হচ্ছে—“আমাদের ন্যাশনাল আ্যসেম্বলি বসবে,আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলব। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।

“আজকের দিনে তাকান- আমাদের রাজনীতি হয়েছে এক দলে আবদ্ধ, অর্থনীতি হয়েছে লুটপাট ও পাচারমুখী, সংস্কৃতি হয়েছে ইন্নামাল ফুজুফুজু ফুজুওয়ানা মারহাবা মারহাবা টাইপের।এবার পরের আলাপ—-” কি পেলাম আমরা? আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি।”

উপরের কথাগুলোর সঙ্গে আমাদের পরিস্থিতি মিলিয়ে নিতে পারেন। যাই হোক এবার আসল কথায় আসা যাক।

ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বললেন শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান তৈরির কথা। আমরা সেই আলাপ তুলতে চাই আজ ৫০ বছর পরেও। কেন? তার উত্তর হচ্ছে সত্যিকার অর্থেই আমাদের একটা সংবিধান তৈরি হয়নি। তাহলে বলবেন দেশ চলছে কিভাবে?বলছি দেশ সংবিধান দিয়েই চলছে কিন্তু সেই সংবিধানটা আপনি একবার পড়ে দেখুন তারপর অনুধাবন করুন। না আপনি খুব পরিস্কারভাবে কিছু অনুধাবন করতে পারতে পারবেন না। কেননা আমাদের সংবিধান এতরকম কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে তৈরি যে শেষ পর্যন্ত আপনার পাগল হবার যোগাড় হবে।

একটু পরিস্কার করা দরকার সংবিধান কি? সংবিধান হচ্ছে- আপনি আপনার দেশটা পরিচালনা করার জন্য ‘রাষ্ট্র’ নামক একটা সংগঠন বানিয়েছেন। এই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে নিয়মকানুনগুলো রয়েছে-যেখানে রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্ক কেমন হবে, রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে, রাষ্ট্র কি কি করতে পারবে আর কি কি করতে পারবে না- এই সংক্রান্ত বিবিধ আইন কানুনের লিখিত নামই হচ্ছে সংবিধান। এই সংবিধান এত সরল হওয়া উচিৎ যে, যেকোন নাগরিকই যেন পড়ে বুঝতে পারে। আমাদের সংবিধানের এটা প্রথম ব্যার্থতা।

যাহোক বঙ্গবন্ধু কেন তাঁর ভাষণে বারবার সংবিধানের কথা বলেছেন? বলেছেন কারন তখনকার পাকিস্থান রাষ্ট্রের সংবিধান ছিল প্রচণ্ড রকমের অগণতান্ত্রিক, এক ব্যাক্তির ক্ষমতার, জনগণকে নিপীড়নের বৈধতা দানকারী। যার ফলে পাকিস্থান রাষ্ট্রের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান খুব দরকারি ছিল। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচন হয় এবং সে নির্বাচন হয় পাকিস্থান রাষ্ট্রের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনার জন্য। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জেতার পরেও কেন জাতীয় পরিষদ ডেকে পাকিস্থান রাষ্ট্রের সেই কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক সংবিধান দেওয়া হচ্ছে না, বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে সেই প্রশ্নটাই বারবার তুলেছেন। এই পর্যন্ত থামি।

শেষ পর্যন্ত পাকিস্থানের সাথে বনিবনা না হওয়ায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭২ সালের ২২শে মার্চ বঙ্গবন্ধু ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ’ জারি করেন। বলা হয় এই “গণপরিষদ প্রজাতন্ত্রের লাগিয়া একটি সংবিধান প্রণয়ন করিবে”। এখানে প্রজাতন্ত্র হচ্ছে- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এই গণপরিষদ ৪৭৯ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও মোট ৪০৩ জন নিয়ে গঠিত হয়।

এখানে গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে- এই ৪০৩ জন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী, যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন পাকিস্থান রাষ্ট্রের সংবিধান রচনার জন্য। এরা কেউ স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য নির্বাচিত নন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিঃসন্দেহে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সর্বোপরি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার ১৮০ ডিগ্রী এঙ্গেলে পরিবর্তন হয়।

সুতরাং এটা কি মৌলিক দায়িত্ব ছিল না যে, স্বাধীন দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নতুন করে গণপরিষদ নির্বাচন দিয়ে তারপর সংবিধান রচনা করা? সেটা না করে পাকিস্থানের সংবিধান রচনার জন্য নির্বাচিতদের দিয়ে একটি স্বাধীন দেশের সংবিধান রচনা হয় কি করে? ৪০৩ জনকেতো জনগণ নির্বাচিত করেছিল পাকিস্তানের সংবিধানের জন্য, ওই জনগণও ছিল পাকিস্থান রাষ্ট্রের।

দেশ স্বাধীন হওয়ার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারল না কেন?

বঙ্গবন্ধু যে শাসনতন্ত্র চেয়েছেন ৭ই মার্চের ভাষণে তার সাথে স্বাধীন বাংলার শাসনতন্ত্রের মৌলিক তফাৎ কি বুঝতে পারছেন?

যা হোক ৪ নভেম্বর সংবিধানের খসড়া গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়, ১৪ই ডিসেম্বর স্পীকার কর্তৃক প্রমাণীকৃত হয়, ১৫ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত সংবিধানে সাক্ষর করেন ৪০৩ সদস্যের মধ্যে ৩৯৯ জন। এই সংবিধানে সাক্ষর করেননি চার জন। তারা হলেন- সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (সিলেট), আজিজার রহমান(রংপুর), জালাল আহমেদ(কুমিল্লা), মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা(পার্বত্য চট্টগ্রাম)। এনারা কেন এই সংবিধানে সাক্ষর করেননি সেটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে এই সংবিধান স্বাধীন বাংলাদেশে কার্যকর হয়।

নিবন্ধটি লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া

সংবাদ সারাদিন