সুইডেনের করোনা কৌশল ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

|| বিপ্লব শাহনেওয়াজ, সুইডেন থেকে ||

সুইডেনে আজ পর্যন্ত প্রায় ২২০০ জন কোভিড-১৯ এ মারা গেছেন যা অন্য স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোর চেয়ে বেশী। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ হাসপাতালে এবং বাকি ৫০ শতাংশ ওল্ডহোমেই মারা গেছেন। ওল্ডহোমে থাকা মানুষগুলোকে হাসপাতালে আনা হয়নি তাদের বায়লোজিক্যাল বয়স এবং এডভান্সড ক্যান্সারসহ অন্য কো-মরবিডিটির কারনে। তাদের কোন চিকিৎসাই কার্যকররী হতো না- এমনকি তারা পরিবহনের ঝক্কিটুকুও সহ্য করতে পারতো না। পেলিয়েটিভ চিকিৎসা তাদের মৃত্যুকে সহজতর করেছে।

করোনা পরিস্থিতিতে অনেক দেশই তাদের পরিসংখ্যানে শুধু হাসপাতালে মারা যাওয়াদেরই গণনায় আনছে। সুইডেন অবশ্য হাসপাতাল এবং ওল্ডহোমে যারা কোভিডে মারা যাচ্ছে তাদের সবাইকেই গোনায় আনছে। আর এজন্যই সুইডেনে কোভিডে মৃত্যুর হার অন্য নরডিক দেশগুলোর চেয়ে তুলনামূলক বেশী। এর সঙ্গে অবশ্য একটি ব্যর্থতা রয়েছে দেশটির। আর তা হচ্ছে বয়স্কদের মধ্যে করোনার সংক্রমন নিয়ন্ত্রন না করতে পারা।

এ পর্যন্ত সুইডেনে মারা গেছে তাদের বয়স ক্রম যথাক্রমে ৯০ বছরের বেশী ৫২৬ জন, ৮০ থেকে ৮৯ বছরের মধ্যে ৮৭০ জন, ৭০ থেকে ৭৯ বছর বয়সী ৫১৪ জন, ৬০ থেকে ৬৯ বছরের মধ্যে ১৭১ জন, ৫০ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে ৪৬ জন, ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ২৪ জন, ৩০ থেকে ৩৯ বছরের মধ্যে ৮ জন, এবং ২০ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে ৬ জন। এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ২২০০ জন মৃতের মধ্যে ১৯১০ জনের বয়সই ৭০ এর বেশী। ৭০ এর নীচে বয়সের যারা মারা গেছেন তাদের সংখ্যা ২৬০ জন। এদের মধ্যে আবার অনেকে আগে থেকেই নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন।

সুইডেনের মোট জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি। এরমধ্যে মাত্র ১৮ হাজার ৭০০ করোনা পজেটিভ নিবন্ধিত। এদের বেশীর ভাগই রাজধানী ষ্টকহোমের মানুষ। আজ পর্যন্ত রাজধানীর এক তৃতীয়াংশের মতো মানুষ করোনায় সংক্রমিত। যাদের অনেকেই মৃদু অথবা কোন উপসর্গ ছাড়াই সংক্রমিত হয়েছে।

সুইডেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু এর টেষ্ট! টেষ্ট!! টেষ্ট!!! না করে শুধু কঠিনভাবে আক্রান্ত যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, ওল্ডহোমে রয়েছে এবং ট্রেসিংয়ের কারনে স্বাস্হ্যকর্মীদের PCR টেষ্ট করিয়েছে।

উপসর্গ নেই এমন অনেকেই র‌্যানডম পদ্ধতিতে এন্টিবডি টেষ্ট করছে। ধারনা করা হচ্ছে মে মাসের মধ্যে রাজধানী স্টকহোমের অর্ধেক জনগোষ্ঠি করোনায় সংক্রমিত হবে। অনেকের আবার হার্ড ইমিউনিটি তৈরী হবে ভ্যাকসিন আসার আগেই।

লকডাউন যাকে সুইডিস রাজনীতিবীদরা ব্যক্তিস্বাধীনতারবিরুদ্ধ রাষ্ট্রের একটি কঠোর নীতি বলছে। সেই প্রেক্ষিতে না হোক সুইডেন শুরু থেকেই লকডাউনের পথে না গিয়ে জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতিকে স্বাভাবিক রেখে দীর্ঘমেয়াদী মহামারী প্রতিরোধক পন্থা গ্রহন করে ইতোমধ্যেই আলোচিত এবং সমালোচিত। পুরো দেশটিকে পরীক্ষাগার বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে সরকারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠেছে, জনগনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে অমানবিক বৈজ্ঞানিক খেলা চলছে দেশটিতে। তবুও সুইডিস সরকার চলছে নিজেদের একদল বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের নির্দেশনায়। তবে চুড়ান্ত মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি।

সুইডিস কৌশলের মূল লক্ষ্যই ছিলো যারা মৃদুভাবে কিংবা উপসর্গ ছাড়াই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে এবং যাদের হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন হবে তাদের জন্য অবকাঠামো তৈরী করা, বেড এবং আইসিইউর সংখ্যা বাড়ানো। এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, সংক্রমনের কার্ভ আস্তে আস্তে সমতলের দিকে যাচ্ছে – হাসপাতাল এবং আইসিইউ র অনেক বেড খালি- তাই বলা যায় সুইডিস সরকারের প্রস্তুতি এখন পর্যন্ত যথাযথ রয়েছে।

জরুরী পেশার অভিভাবকগন যেন কাজ করতে পারে তার জন্য ১৬ বছরের নীচের বাচ্চাদের বিদ্যালয় এবং ডে-কেয়ার সেন্টার খোলা রেখেছে পুরোটা সময়েই। এ পর্যন্ত কোন স্কুলে বিপর্যয় ঘটেনি। হাসপাতালে ভর্তি ও আইসিইউতে কিছু শিশু (১৮ বছর পর্যন্ত) ভর্তি হলেও মৃতের তালিকায় কেন শিশু নেই। আমরা শিশুদের নিশ্চিন্তেই স্কুলে পাঠাচ্ছি। সুইডিস কৌশলের যথার্থতার এটিও একটি দৃষ্টান্ত ।

সুইডেনের এমনতর কৌশলের পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি চলতে থাকবে। কিন্তু চুড়ান্ত যাকিছু সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে ইতোমধ্যেই লকডাউনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আমরা দেখছি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিজীবনে। ভ্যাকসিন অথবা হার্ড ইমিউনিটি না আসা পর্যন্ত ভাইরাসের তান্ডব চলবে অনেক দিন পর্যন্ত।

করোনার মতো মহামারী মোকাবিলায় লকডাউন ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির জন্য স্বল্পমেয়াদী কার্যকর কৌশল হলেও – লকডাউনসময়ে দারিদ্র, ক্ষুধা, পারিবারিক সংঘাত, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির মতো ক্ষতিকর দিকগুলিও বিবেচনায় আনা দরকার। স্বল্পসময়ের লকডাউনের মধ্যেই জনগনকে শিখতে হবে মহামারী মোকাবেলার দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতিগুলো। মেনে চলতে অভ্যস্ত হতে হবে সামাজিক দুরত্ব, আনতে হবে ব্যক্তিগত আচার-অভ্যেসের পরিবর্তন। তাই কতদিন লকডাউন চললো? কত মানুষ আক্রান্ত হলো? কার টেষ্ট করা হলো আর হলো না – তা নিয়ে আলোচনা কার্যকর কোন সমাধান দেবে না।

সামান্য উপসর্গ নিয়ে বা কিট নিয়ে ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পা দিয়ে আজকে যে নেগেটিভ প্রমানিত হলো সে কিন্তু একটু পরেই আক্রান্ত হয়ে নিজের অজান্তে অন্যকে আক্রান্ত করতে পারে। এরজন্য যার চিকিৎসা প্রয়োজন তার জন্য টেষ্টই হচ্ছে বাস্তবসম্মত কৌশল। উপসর্গ থাকলে নিজে থেকেই সচেতন হয়ে থাকতে হবে আইসোলেসনে। স্বাস্থ্যসুশ্রষা নিতে হবে যথা সময়ে। এবং সুস্থ মানুষদেরকেও চলতে হবে নিয়ম মেনে।

বাংলাদেশের জন্য সবচে জরুরি হচ্ছে, যাদের চিকিৎসা প্রয়োজন তাদের জন্য স্বাস্হ্যখাতকে তৈরী করা এবং স্বাস্হ্যকর্মীদের সুরক্ষা দেয়া। শতকরা ৯০ ভাগই মৃদু উপসর্গ বা উপসর্গহীন ভাবেই করোনাভাইরাসকে মোকাবেলা করছে। ১০ ভাগের জন্য স্বাস্হ্যসুশ্রষা নিশ্চিন্ত করা দরকার। প্রয়োজন সংক্রমন রোধে ব্যক্তিগত অভ্যাসের চর্চ্চা। গনহারে পরীক্ষা করে আক্রান্তের সংখ্যা গুনলে প্রাথমিক পর্যায়ে হয়তোবা আইসোলেসন করে রোগ নিয়ন্ত্রনে আনা যেতো।

কিন্তু এই মূহুর্তে গনহারে পরীক্ষার দরকার নেই। যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হবে তাদেরই পরীক্ষা করানো উচিত। না হলে সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট হবে- আক্রান্তদের প্রতি ঘৃনা বা আক্রোশ তৈরি হবে। যেমনটি হয়েছে মৃতদের সৎকারের ক্ষেত্রে। প্যানিক বা আতঙ্ক নয়। ভাইরাসের সংক্রমন পদ্ধতিকে জেনে বিজ্ঞান সম্মত ভাবে মহামারি মোকাবেলা করতে হবে। মেনে নিতে হবে বাস্তবতাকে। এমন একটা মহামারি, এমন একটা দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতিতো হবেই। অবকাঠামোর কার্যকারিতা ক্ষয়ক্ষতিকে কমিয়ে আনবে।

তবে বাংলাদেশে মোট শনাক্ত রোগীর সঙ্গে আক্রান্ত ডাক্তার নার্সদের সংখ্যা কঠিন আগামীর পূর্ভাভাস দেয়। তাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে এখন থেকেই।#
বিপ্লব শাহনেওয়াজ, চিকিৎসা কর্মকর্তা, স্টকহোম উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন