সরকারী নিয়োগ ও কাঠামোগত বৈষম্য

।। শমশের আলী ।।

প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, মান সম্মত কর্মসংস্থান। সেই লক্ষ্যে স্কুল ও কলেজ পড়ুয়াদের সংখ্যা বেড়েছে। আর বেড়েছে শিক্ষার প্রসার ও বাণিজ্য। ২০১৯ সালে মাধ্যমিক ও সমমানের পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ২১,২৭,৫৯৪ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছে ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৬৫ জন।

আর ২০১৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন । সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে কলেজসমূহে পড়ার সুযোগ আছে প্রায় এক লক্ষ শিক্ষার্থীর। বেসরকারী ও বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে ভর্তির সক্ষমতা অনেকের থাকলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। তরপরেও প্রতিবছর লক্ষাধিক যুবক উচ্চ শিক্ষা লাভ করে দেশের মধ্যে চাকুরী অনুসন্ধান করতে থকে। কারণ আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যা পড়ানো হয় তা দিয়ে দেশের বাইরে সম্মানজনক চাকুরীর যোগ্যতা অর্জন করে না। বরং দেশের উল্লেখযোগ্য কিছু পদে বাইরের দেশের শিক্ষিত ও অভিজ্ঞদেরকে নিয়োগ করতে হয়। আবার বিদেশে চাকুরী পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারী সহায়তা অপ্রতুল এবং প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবণা বেশি। 

প্রতিবছর যত সংখ্যক উচ্চ ও মধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা সম্পন্ন করে, তাদের সকলের জন্য সম্মান জনক চাকুরির নিশ্চয়তা নাই। আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষিত যুবকদের জন্য সম্মানজনক চাকরী হলো বিসিএস পরিক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া।

যাহোক, প্রতিবছর বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন বিসিএস পরিক্ষার মাধ্যমে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন পদ সমূহে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থকে। ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সালের ফলাফল অনুসারে মাত্র ১৪,৪০৯ জন বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছে। আর নন-ক্যাডারে প্রায় সমসংখ্যক নিয়োগ পেয়েছে। সর্বশেষ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, এখনো প্রায় ৯৫% যুবক সম্মান জনক চাকুরীর সন্ধান প্রার্থী এবং অনেকে বেকার।

বর্তমানে দেশে সম্মানজনক চাকুরী মানেই বিসিএস ক্যাডার। কারণ, চাকুরী শুরুর দিন থেকেই মোটা অংকের বেতন ও বিশাল সম্মান। চাকুরীর প্রথম দিন থেকেই নন-ক্যাডারসহ ২য়, তয় ও ৪র্থ শ্রেণীর দায়িত্বে নিয়োজিত সকল অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ও বয়োজৈষ্ঠদের অধিকর্তা। মেয়াদান্তে প্রমোশন ও উচ্চ পদে আসীন হওয়ার সম্ভাবনা। পদমর্যাদা অনুসারে সরকারী বাসভবন। কয়েকধাপ পেরুলেই সরকারী গাড়ি। সকল সরকারী সেবায় অগ্রাধিকার। সম্পূর্ণ সরকারী খরচে পকেট মানিসহ বিদেশ ভ্রমন। সরকারী খরচে আরো উচ্চতর ডিগ্রি লাভের সুযোগ। আমৃত্যু সরকারী পেনশন। সরকারী ব্যবস্থাপনার আবাসন প্রকল্পে প্লট ও ফ্ল্যাট পাবার কোটা। উচ্চপদে আসীন হতে পারলে ভিআইপি মর্যাদায় অনেক সুবিধা পাওয়া পাওয়া যায়। তাছাড়া ক্ষমাতার অপব্যবহার করে সীমাহীন সম্পদ অর্জনের সুযোগতো থাকছেই।

সর্বপরি, জনগণের দেয়া বাজেটের টাকায় তাদের বেতন-বোনাসসহ সকল সুযোগ নিশ্চিত করা হলেও রাষ্ট্র প্রদত্ত ক্ষমতার তুলনায় জনগণের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা থাকে না। ক্ষমতার অপব্যবহার বা দূর্নীতি করলেও আইনত: তার বিরুদ্ধে সহজে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। অর্থাৎ শুধুমাত্র বিসিএস পরিক্ষার ফল দেশের ৫% যুবককে সকল নাগরিক থেকে আলাদা করে ফেলে। উল্লেখ্য যে, বিসিএস পরিক্ষার ভাল ফলাফল সরকারী কোন পদের জন্য কর্ম-ক্ষমতা প্রমাণ করে না। চাকুরীতে যোগদানের পরে নিবিড় তত্তাবধান ও প্রশিক্ষনের মাধ্যমে যোগ্য বা অযোগ্য হিসাবে গড়ে তোলা হয়। তবে, এই প্রক্রিয়া ৯৫% শিক্ষিত যুবকের যোগ্যতাকে ম্লান করে দেয়, অপমানিত এবং অসম্মানিত করে।

বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পনীর তৈরী করা, রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামোর ধারাবাহিকতায় এই তিন স্তরের নিয়োগ এখনো চলমান আছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সকল ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি বাতিল হলেও কাঠামোগত বঞ্চনা ধারাবাহিকতা রয়েই গেছে। এমনকি, সরকারী কর্মকর্তাদেরকে আইন ও বিধির অধিনে সামান্য অযুহাতে খাদ্য উৎপাদক ও সাধারণ করদাতাকেও অপমান, অসম্মান বা শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যা বৃটিশ ঊপনিবেশ শাসন ব্যবস্থাকে মনে করিয়ে দেয়।

অন্যদিকে, সরকারী কোন আইনি কাঠামো না থাকায় বেসরকারী চাকুরিতে কোন প্রকারের সম্মানজনক অবস্থানের নিশ্চয়তা নেই। বেসরকারী সকল চাকুরীই অস্থায়ী ও অনিশ্চিত। উপরন্তু, যারা ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়, তাদের ক্ষমতার বহি:প্রকাশ ও ক্ষমতার অপব্যবহার দেখে, ক্লাসের সহপাঠিসহ দেশের খাদ্য উৎপাদক ও করদাতাদেরকে দারুনভাবে আহত ও ক্ষত-বিক্ষত করে।

এর সমাধান হচ্ছে, তিন স্তরের নিয়োগ বন্ধ করতে হবে এবং আইন দ্বারা জনগণের সাথে কর্মচারীদের ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে। আর খাদ্য উৎপাদক ও সাধারণ করদাতাদের সম্মান দিতে হবে।

বিগত বিসিএস পরিক্ষা সমূহের ফলাফল পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়;

৩৪তম বিসিএসএর পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল প্রায় ২২১,০০০ জন। প্রাথমিক ও লিখিত পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ১২,০৩৩ জন অর্থাৎ পাশের হার প্রায় ৫%। আর, মৌখিক পরিক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত হয় মাত্র ২,০৫২ জন।

৩৫তম বিসিএসএর পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ২৪৪,১০৭ জন। প্রাথমিক ও লিখিত পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ৬,০৮৮ জন অর্থাৎ পাশের হার প্রায় ২.৫%। আর, মৌখিক পরিক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত হয় মাত্র ২,০৭৩ জন।

৩৬তম বিসিএসএর পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ২ লক্ষাধিক জন। প্রাথমিক ও লিখিত পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ১৩,৬৭৯ জন অর্থাৎ পাশের হার প্রায় ৬.৮%। আর, মৌখিক পরিক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত হয় মাত্র ২,৩২৩ জন।

৩৭তম বিসিএসএর পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল প্রায় ২৪৩,৪৭৬জন। প্রাথমিক ও লিখিত পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ৫,৩৭৯ জন অর্থাৎ পাশের হার প্রায় ২.১%। আর, মৌখিক পরিক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত হয় মাত্র ১,৩১৪ জন।

৩৮তম বিসিএসএর পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ৩৮৯,৪৬৮ জন। প্রাথমিক লিখিত পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ১৬,২৮৬ জন অর্থাৎ পাশের হার প্রায় ৪.২%। আর, মৌখিক পরিক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত হয় মাত্র ২,২০৪ জন।

৩৯তম বিশেষ বিসিএস (স্বাস্থ্য) এর পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ৩৯,৯৫৪ জন। প্রাথমিক পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ১৩,৭৫০ জন অর্থাৎ পাশের হার প্রায় ৩৪.৪২%। আর, মৌখিক পরিক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত হয় মাত্র ৪,৪৪৩ জন।

৪০তম বিসিএসএর পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ৪১২,৫৩২ জন। প্রাথমিক পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ২০,২৭৭ জন অর্থাৎ পাশের হার প্রায় ৪.৯% মাত্র। লিখিত ও মৌখিত পরিক্ষা এখনো সম্পন্ন হয় নি।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের ক্যারিকুলাম ও পাঠ্যসূচি অনুসারে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ বছরের কোর্স সম্পন্ন করে, কমপক্ষে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করা শিক্ষার্থীরাই কেবল সাধারণ বিসিএস পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোন কোর্সে ভর্তি হতে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষায় ভাল ফলাফল আবশ্যক। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, অতীতের এতসব পরিক্ষায় পাশ করার পর সাধারণ বিসিএস লিখিত পরিক্ষায় পাশের হার ৫% এর বেশি নয় কেন?

অর্থাৎ দেশের প্রতিষ্ঠনিক শিক্ষা বা পরিক্ষা পদ্ধতির সাথে বিসিএস পরিক্ষা পদ্ধতির অবশ্যই গড়মিল আছে। যারা বিসিএস পাশ করে তাদেরকে অনেক বেশি গাইড বই নির্ভর হতে হয়। তাছাড়া, সরকারী-বেসরকারী চাকুরীর খুব কম ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত শিক্ষা কাজে লাগে। তাহলে, এই শিক্ষার সনদ নেয়ার জন্য কেন এত ব্যায়, কষ্ট ও সময়ক্ষেপন? অপরদিকে, আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নামে আমরা সাধারণ মানুষের কর্মক্ষেত্র কৃষিজমি নষ্ট করে বেকারত্ব বৃদ্ধি করলাম। বর্তমান করোনা মহামারী সময়ে অধিকাংশ সেবা, শিল্প, বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সহায়তা দেয় নি, বরং কৃষি ও স্বল্প শিক্ষিত কৃষকগণই আমাদেরকে বাঁচিয়েছেন। উচ্চ শিক্ষার সনদপ্রাপ্ত বেকারত্ব বৃদ্ধির জন্য আমরা রাষ্ট্রিয় ও পারিবারিক বাজেটের অনেকখানী ব্যায় করলাম। আসলে এই শিক্ষা ব্যবস্থা কার জন্য? শান্তনা পেতাম যদি, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিতরা উচ্চ পদে আসীন হওয়ার পর সকল ক্ষেত্রে অন্তত দেশপ্রেম, খাদ্য উৎপাদক ও করদাতাকে সম্মান দেয়াসহ নৈতিকতার সংস্কৃতি চালু করার প্রমাণ পাওয়া যেত।

শমশের আলী, গবেষক ও লেখক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন