শাসন ও আইন গণতান্ত্রিক করতে আর কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে বাংলাদেশকে

|| শমশের আলী ||

২৩শে জুন পলাশী দিবস। ১৮৫৭ সালের এই দিনে রক্তপথে রাষ্ট্রক্ষমতার চৌকিদারিত্ব লাভ করে বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পাল্টে যায় বাংলায় অর্থাৎ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শাসন ব্যবস্থা। আসে বিদেশি নতুন শাসক। এদেশীয় কিছু ‌‘এজেন্ট’ দের প্রত্যক্ষ সহায়তা ও কূটকৌশলে রক্তপথে পতন ঘটে নবাব সিরাজুদ্দৌলার। ভারতবর্ষে তথা বাংলায় অস্তমিত হয় মোঘল সূর্যের।

১৭৫৭ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত এখানে চলে কোম্পানিশাসন। তারও অবসান ঘটে ১৮৫৮ সালে গ্রেট বৃটেনের রানী ভিক্টোরিয়া কর্তৃক এদেশের শাসনভার গ্রহণের মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে পাক-ভারত উপমহাদেশসহ,বার্মা, মালায়া, হংকং ও সিঙ্গাপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় বৃটিশ উপনিবেশিক শাসন। নেপাল রাজাও বৃটিশ শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। তবে ভুটান ছিল আলাদা ও স্বাধীন।

খ্রীষ্টপূর্ব ৬৩০ সালে আর্যদের প্রতিষ্ঠিত সুং রাজার মাধ্যমে এই উপমহাদেশে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর ১৯৫৭ সালে বৃটিশ কোম্পানি শাসন এবং ১৮৫৮ সালে বৃটিশ রাজতন্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। এসব শাসন ব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল; এদেশের সম্পদ পাচারের ও স্থানীয় জনগোষ্ঠিকে অধিক কর দিতে বাধ্য করার।

খ্রীষ্টপূর্ব ৬৩০ সাল থেকে বিরাজমান রাজাগণ অন্যদেশ থেকে আসলে তারা এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিল। আর বৃটিশ শাসকরা প্রচুর সম্পদ ও ধন-রত্ন নিজ দেশে পাচার করেছিল। তাছাড়া, তারা এদেশে প্রচলিত ব্যবস্থার বিপরীতে নিজেদের শাসন-শোষনের জন্য আলাদা বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা ব্যবস্থা, মুদ্রা ও আইনের প্রচলন করেছিল। যার ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠির মধ্যে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের জন্ম নেয়।

১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের অবসান হয়ে ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। বৃটিশ রাজশাসনের পরিবর্তে  উপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত স্থানীয় উচ্চবিত্তরা শাসক বনে যায়। কিন্তু পরবর্তিতে দেশের আইন, শিক্ষা, চিকিৎসা, শাসন ও বিচার কাঠামোর উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন হয়নি। উপরন্তু ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তি ক্ষনে, বৃটিশ প্রচলিত ১৩৫টি আইন, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশের আইন হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

আবার ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ ভুখন্ড আবার স্বাধীন হয়। এই স্বাধীন দেশেও প্রচলিত প্রশাসনিক কাঠামো, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচার ব্যাবস্থা ও মৌলিক আইন সমূহের অধিকাংশই বৃটিশ ও পাক সরকার প্রবর্তিত। কোন কোন আইনের কিছু কিছু ধারার পরিবর্তন হলেও গণপ্রজাতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে সামগ্রিক শাসন কাঠামো, শিক্ষা, আইন ও বিচার ব্যবস্থার ধারাবাহিক পরিবর্তনের দীর্ঘ মেয়াদী উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কারণ কোন আইন কখনো ৩০ বছরের অধিক একইভাবে চলতে পারে না। দরকার বাস্তাবতার আলোকে মূল্যায়ন ও গবেষণা পরবর্তি সংস্কার।

আর স্বাধীনতার গেল পঞ্চাশ বছরেও দেশের প্রচলিত আইন থেকে সামগ্রিক জনগোষ্ঠি কাঙ্খিত সুফল পাচ্ছে না। শাসক গোষ্ঠির সাথে জনগণের ঐক্যের সম্পর্কের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার সামঞ্জস্যপূর্ণ, গবেষণা ধর্মী, দেশপ্রেম ও সর্বজনীন নৈতিকতা ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন হয়নি। বিচারালয়ে পরিধেয় কালো গাউন এখনো বৃটিশ শাসনামলকে স্মরন করিয়ে দেয়।

এখনো তিন স্তরের নিয়োগ কাঠামো দ্বারা শাসন ব্যবস্থার মধ্যেকার বৈষম্য বিরাজমান। স্থানীয় সরকার এখনো পুরোপরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। আমরা এখনো জিডিপি ভিত্তিক উন্নয়ন কাঠামোতে আবদ্ধ। জনগণের সুখ ও সমৃদ্ধি ভিত্তিক বিকল্প উন্নয়ন কাঠামো প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। এখনো পরনির্ভরশীল উন্নয়ন কৌশলেই আটকে আছি আমরা।

সর্বপ্রথম, গণপ্রজাতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দেশের সার্বিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন বিষয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করে গণগবেষণার দীর্ঘমেয়াদের কার্যক্রম চালু করা দরকার। যাতে দেশের সকল জনগণ গণপ্রজাতান্ত্রিক আদর্শ ও উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করতে পারে। গণপ্রজাতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিসমূহ চিহ্নিত করতে পারে এবং সেই আদর্শের ভিত্তিতে দেশের শাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়নের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা চিন্তা করতে পারে।

স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনের ন্যায়, এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি আইনি কাঠামোর অধীনে, উপনিবেশিক শিক্ষার দাস নয় এমন প্রগতিশীল ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদ সচিবালয়ের অধীনে জেলা ও থানা ভিত্তিক সর্বদলীয় বা নির্দলীয় কমিটি গঠন করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব করছি। তবে, দেশের এই ধরনের মৌলিক পরিবর্তন রাতারাতি সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজনীয় সময় ক্ষেপন করে অধিক সতর্কতা ও ধৈর্য্যের সাথে এই কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। আশা করছি, আমাদের বাংলাদেশ একদিন বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশের জন্য একটি আদর্শ হবে।

শমশের আলী, গবেষক ও লেখক , মেইল : shamsher.ctg@gmail.com

১৪ thoughts on “শাসন ও আইন গণতান্ত্রিক করতে আর কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে বাংলাদেশকে”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন