|| মোহাম্মদ আবু সালেহ ||
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যে সম্পর্ক চেয়েছিলেন তা আজও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে বড় ব্যবধান লক্ষ্য করে বেশির ভাগ শিক্ষককে ‘আইনশৃঙ্খলার প্রতিভু’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা এ ধরনের শিক্ষককে ভয় পায়। তাই তিনি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে বন্ধুত্ব আবশ্যক মনে করতেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের খেলার সাথী হিসেবে কাজ করতে বলেছেন। এমনকি তিনি নিজেও যখন শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় গড়ে তোলেন, তখন তিনি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলা করে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। অথচ বেশির ভাগ শিক্ষকই এ ধরনের বন্ধন সৃষ্টিতে আগ্রহী নন। তাই এ ধরনের শিক্ষকদের রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছেন ‘Born Tyrants’ বা জন্মগতভাবে জালিম। (তথ্যসূত্রঃ দুর্ভাবনা ও ভাবনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, ডঃ আকবর আলি খান, প্রথমা প্রকাশন)।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের অবাধ স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে ‘বন্দিখানার শৃঙ্খলা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাঁর মতে, এর একমাত্র প্রতিষেধক হলো ‘স্বাধীনতা মহৌষধের ব্যবস্থা’ (The System of Freedom Cure)। তিনি মনে করেন, ছাত্র-ছাত্রীদের মা-বাবা, বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকের সাথে স্বাধীন সম্পর্ক থাকলে তা সত্যিকার মানসিক বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়।
প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়, এখন আর ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের শিক্ষকদের সম্মান করেন না। এটা হয়তো অনেকাংশেই সত্য, কিন্তু আমি মনে করি একজন শিক্ষক গভীর জ্ঞানের অধিকারী হলে আর শ্রেণিকক্ষে তাঁর ভাষণ এবং শ্রেণি কক্ষের বাইরেও তাঁর জ্ঞান বিতরণের প্রক্রিয়া ও পরিবেশনা সঠিক হলে শিক্ষার্থীরা তাঁকে সম্মান করতে বাধ্য। কখনো কখনো শিক্ষকগণ ছাত্র-ছাত্রীদের নির্জ্ঞান বা মূর্খ ভাবলেও শিক্ষার্থীরা কিন্তু একজন শিক্ষকের জ্ঞানের গভীরতা সঠিকভাবে পরিমাপ করতে সক্ষম। এখনো ভালো শিক্ষকের কদর ও সম্মান সব জায়গায়ই রয়েছে। শুধু ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’ নয় বরং শিক্ষকদেরও অধ্যয়ন একমাত্র তপস্যা না হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের অবনতি অনিবার্য।
সম্প্রতি অধ্যাপক এমাজ উদ্দিন আহমদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা সম্ভবত দেশের প্রবীণতম রাষ্ট্রচিন্তককে হারালাম। একে একে এই করোনাকালেই তাঁর সমসাময়িক রাষ্ট্রচিন্তক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে আমরা হারালাম। এমাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১তম ভিসি ছিলেন।
এমাজউদ্দীন আহমদ স্যার তাঁর জীবদ্দশায় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে যে সব সাক্ষাতকার দিয়েছেন এবং লেখালেখি করেছেন তাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে কখনো আপোষ করেননি। তিনি বলতেন, আমাদের এ ভূখণ্ডে বাঙালি সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে বসবাসের বয়স প্রায় ৬,৫০০ বছর। এই সাড়ে ছয় হাজার বছরে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। আমাদের এ অঞ্চলের বাঙালি বরাবরই পরাধীনতা এবং শোষণের মধ্যে ছিল বিভিন্ন শাসনামলে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, জাতিসত্তা, পতাকা, স্বতন্ত্র ভাষা ও ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩তম ভিসি এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রথম ঢাবির ভিসি (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে শিক্ষামন্ত্রী) ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী (MAC) এমাজউদ্দীন আহমদ এর শিক্ষক ছিলেন। ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী ম্যাক (MAC) নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। ‘ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী স্মারক গ্রন্থ’-তে এমাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ছাত্রজীবনের একটা ঘটনা উল্লেখ করে সে যুগের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন ছিল তা জানবার সুযোগ করে দিয়েছেন পরের প্রজন্মের জন্য। তিনি তাঁর শিক্ষক MAC/ম্যাক স্যারের পাণ্ডিত্য, জ্ঞানের গভীরতা এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বে এতটাই ভয় এবং সম্মান করতেন যে সাধারণত তাঁর বসার কক্ষে দেখা করতে যেতেন না। একদিন ম্যাক স্যার তাঁঁকে ডেকে বললেন, ”এমাজ উদ্দিন, Why don’t you come to me sometimes? তোমরা জাননা, তোমরা আমার সাথে দেখা না করতে আসলে আমার খারাপ লাগে!”
এই ছিল তখনকার ছাত্রশিক্ষক সম্পর্ক! বাইরে যতটা কঠিন কিন্তু ভিতরে ঠিক ততটাই নরম ছিলেন। ম্যাক স্যারও ছিলেন কঠিনে-কোমলে মানুষ। তাঁদের অন্তর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিল!
ম্যাক স্যারের পাঠাভ্যাস সম্পর্কে তাঁর ছাত্রজীবনেই একটা কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল এমন যে- তিনি দৈনিক ১৮ ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন। ছাত্রজীবন এবং শিক্ষকজীবন উভয় ক্ষেত্রেই প্রফেসর MAC বেশিরভাগ সময়ই লাইব্রেরিতে পড়ে থাকতেন এবং এক ঘন্টা পরপর লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে তাঁর সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাংলার ছাত্র হলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান তাঁর এরিয়া কোর্স থাকার কারণে সরাসরি মুজাফফর স্যারের ছাত্র ছিলেন। একদিন ম্যাক স্যার ক্লাসে আনিসুজ্জামানের পাশে বসা এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা, তুমি দৈনিক কত ঘণ্টা পড়ালেখা কর?” আনিসুজ্জামান তাঁর সহপাঠীকে ফিসফিস করে বললেন, “১৪ ঘন্টা বলো, স্যার খুশি হবে!” তারপর কথামতো স্যারকে খুশি করতে ১৪ ঘন্টা পড়ালেখার কথা বললেন। ম্যাক স্যার বললেন, “আরও ঘন্টা চারেক বাড়িয়ে দাও।” সবার তো চক্ষুচড়কগাছ অবস্থা! ক্লাসে সবাই ভাবলো দৈনিক ১৪ ঘন্টা পড়াশোনার কথা বললে নিশ্চয়ই স্যার খুশি হয়ে বাহবা দিবেন, কারণ স্যারের পাঠাভ্যাস তো সর্বজনবিদিত ছিল।
মুজাফফর আহমদ চৌধুরী আর শহিদ মুনীর চৌধুরীকে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও উৎসাহ দেওয়ার কারণে ১৯৫২ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার কারাগারে অন্তরীণ করে রাখে। জেলখানায় বই না থাকার কারণে ম্যাক (MAC) স্যারের সময় কাটছিল না ভালোভাবে। তাই তিনি তাঁর স্ত্রীকে চিঠি লিখলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক রাজ্জাক স্যারের কাছ থেকে কিছু বই ধার করে (চিঠিতে তাঁর বইগুলোর নাম উল্লেখ ছিল) যেন জেলখানায় পাঠিয়ে দেন। চিঠিতে তাঁর স্ত্রীকে লিখলেন, “জেলখানাটা যদি লাইব্রেরিতে হতো তাহলে কতোইনা ভালো হতো!”
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কিংবদন্তি শিক্ষক। তিনি বিখ্যাত অধ্যাপক লাস্কির অধীনে পিএইচডি করেন।* তিনি ছিলেন মুজাফফর আহমদ চৌধুরীর শিক্ষক। বঙ্গবন্ধুও তাঁকে তাঁর ছাত্র না হয়েও শিক্ষকের মতো শ্রদ্ধা করতেন। রাজ্জাক স্যারকে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। ড. হুমায়ূন আজাদ তাঁকে ‘এ সময়ের জ্ঞানতাপস’ শিরোনাম দিয়ে তাঁর ‘সাক্ষাতকার’ বইয়ে তাঁর সাথে আলাপচারিতা তুলে ধরেন। উল্লেখ্য, তার আগে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকেই সবাই সেসময়ে জ্ঞানতাপস জানতেন এবং মানতেন। তিনিও ঢাবির বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ যথার্থই বলেছিলেন, “যে দেশে জ্ঞানীর কদর নেই, সে দেশে জ্ঞানী জন্মাতে পারে না।”
রাজ্জাক স্যার তাঁর জীবনে কোনো বই না লিখলেও তিনি ছিলেন জ্ঞানের বাতিঘর। তাঁর কাছে জ্ঞানান্বেষণে ছুটে যেতেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, সৈয়দ আলী আহসান, বদরুদ্দীন উমর, ড. কামাল হোসেনের মতো অসংখ্য গুণগ্রাহী ও জ্ঞানপিপাসু। কোনো বই কেউ খুঁজে না পেলে তাঁর কাছ থেকে এর বিষয়বস্তু শুনে আসতেন। তিনি ঢাকার কেরানিগঞ্জের বলে ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতেন এবং বলতে বলতে তাঁর বলার বাহন যে কখন ইংরেজি হয়ে যেত তা তিনিও টের পেতেন না। তিনি ছিলেন অকৃতদার এবং একটা জীবন্ত লাইব্রেরি।
আহমদ ছফা তাঁর ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইতে উল্লেখ করেন রাজ্জাক স্যার সারা জীবন ব্যাচেলর থাকার সুবাদে রান্নাটাও ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন। তিনি রান্না করে তাঁর ছাত্রদের খাওয়াতেন। ম্যাক স্যারকে কত গরুর (গোরুর?) মাংস রান্না করে খাইয়েছেন তার উল্লেখ আছে। এরকম সহৃদয়তাপূর্ণ ছিল তখনকার ছাত্রশিক্ষক সম্পর্ক।
রাজ্জাক স্যার বলতেন, একটা দেশ কতটা উন্নত ও মার্জিত তা বোঝার জন্য সে দেশের লাইব্রেরি ও কাঁচাবাজার পরিদর্শন করা আবশ্যক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালকে সেসময় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এর প্রতিষ্ঠার পরে প্রতিটি বিভাগে বেশিরভাগ শিক্ষক ছিলেন ইংল্যান্ডের সব নামকরা অধ্যাপকগণ। মুনীর চৌধুরীর মাস্টার্সের ভাইভার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁরই ব্রিটিশ শিক্ষক এজি স্টক তাঁর আত্মজীবনীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি উল্লেখ করে বলেন, তাঁর সমস্ত শিক্ষকতা জীবনে তিনি মুনীর চৌধুরীর চেয়ে মেধাবী ছাত্র পাননি। মাস্টার্সের ভাইভাতে তিনি মুনীর চৌধুরীর জ্ঞানের গভীরতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তা তাঁর স্মৃতিতে জীবন সায়াহ্নেও চির জাগরূক হয়ে রইলো।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে মুনীর চৌধুরীর ছাত্র। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, মুনীর চৌধুরীর চেয়ে বাগ্মী তিনি দেখেন নি। মুনীর চৌধুরী ছাত্রজীবনে অত্যন্ত নামকরা বিতার্কিক ছিলেন। তখনকারদিনে ঢাবির হল ছিল মাত্র ৪ টি- সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক হল, ঢাকা হল (বর্তমানে শহীদুল্লাহ্ হল) এবং ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। মুনীর চৌধুরীর বিতর্ক যেদিন থাকতো সেদিন এ চার হলের ছাত্ররা তাঁর বিতর্ক উপভোগ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো। তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম না থাকলেও মুখেমুখেই রটে যেত।
নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় ঢাবির প্রাক্তন ছাত্র ও শিক্ষক শহিদ ড. মুনীর চৌধুরী (বাংলা বিভাগ), সাংবাদিক ও উপন্যাসিক শহীদুল্লাহ কায়সার, চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক জহির রায়হান, গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শন বিভাগ), ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা বিভাগ), ড.আনোয়ার পাশা (বাংলা বিভাগ), জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি বিভাগ), রাশিদুল হাসান (ইংরেজি বিভাগ), হুমায়ুন কবীর (ইংরেজি বিভাগ), সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমদ ও সিরাজুদ্দীন হোসেন, সুরকার ও গীতিকার আলতাফ মাহমুদ, ডা. এ.এফ.এম আলিম চৌধুরী, ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বিসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেন। এর ফলশ্রুতিতে আমরা জাতির সূর্য সন্তানদের হারালাম।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী ছিলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ছাত্র। তিনি প্রায়ই বলতেন, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে দেখা করতে গেলে তিনি সবসময় নামাজ পড়তে বলতেন। আমরা জানি বহু ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন সত্যিকার জ্ঞানতাপস। ভাষার প্রশ্নে তিনি এবং মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঠিক শিক্ষাই দিয়েছিলেন। ষাটের দশকে রেডিও পাকিস্তানে যে ধর্মীয় কথিকা হতো তাতেও ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ পাকিস্তানিদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা কী!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌভাগ্য যে এস এন বোসের (সত্যেন্দ্র নাথ বসু) মতো বিশ্বমানের পদার্থবিজ্ঞানীকে এখানে রিডার হিসেবে পেয়েছে। সত্যেন্দ্র নাথ বসুর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান। সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে বোস-আইন্সটাইন স্ট্যাটিস্টিক্স প্রদান করেন, যা পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বলে বিবেচিত হয়। এছাড়াও তিনি আইনস্টাইনের সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও থিউরি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলায় বিজ্ঞান চর্চায় তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। যেহেতু ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের কথা এসেছে এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য এস.এন বোস বাংলার সেরা দুজন বিজ্ঞানী- স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ছাত্র ছিলেন।
এ প্রসঙ্গের অবতারণা করে এই বলে উপসংহার টানতে চাই যে, শিক্ষক যে মানের হবে তাঁর ছাত্রও সাধারণত সে মানের হয়। আরেকটি বিষয়ের উল্লখ করতে চাই, ষাটের দশক পর্যন্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের ঢাবিতে অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে প্রথম পছন্দ ছিল পদার্থবিজ্ঞান।
আগেই বলেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি বিষয়ে এমন কীর্তিমান শিক্ষক রয়েছেন যাঁদের আছে বিশ্বজোড়া গবেষণার খ্যাতি। তেমনি ১৯৫৭ সালে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. এ.কে নাজমুল করিমের ছাত্রছাত্রীরাই পরবর্তীতে ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হয়েছেন এবং আমি ঢাবিতে সোসিওলজি বিভাগে ছাত্র থাকতে দেখেছি ড. নাজমুল করিমের প্রতি তাঁর উত্তরসূরীদের কী অপরিসীম ভক্তি, কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা। আমাদের শিক্ষক সাবেক জাতীয় অধ্যাপক রঙলাল সেন ছিলেন ড. নাজমুল করিমের ছাত্র। সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ড. রঙলাল সেনের শিক্ষক অধ্যাপক সা’দ উদ্দিন এখনও বেঁচে আছেন।
জীবিতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর এমিরেটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বেশ কয়েক বছর আগে অবসর নিলেও এখনো লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরই সুযোগ্য ছাত্র বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছিল সামন্তবাদী। শিক্ষক দেখলেই ছাত্র পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়বে। কৃত্রিম ভক্তি দেখাবে। স্বাধীনতার পর ভেবেছিলাম সম্পর্কটা হবে গণতান্ত্রিক। তুমি কিছু কম জান, আমি কিছু বেশি জানি। কিন্তু আমি প্রভু নই। সম্পর্ক হবে সমানে সমান। আমি তোমাকে দিচ্ছি আবার তোমার থেকে নিচ্ছিও। নিচ্ছি তোমার তারুণ্য, তোমার কৌতূহল, তোমার জিজ্ঞাসা। কিন্তু দূরত্বের কারণে সব যান্ত্রিক ও অমানবিক হয়ে যাচ্ছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের Alma Mater বা জ্ঞানদায়িনী মা! ১৮৫৭ সালের করোনেশন এ্যাক্ট অনুযায়ী এ উপমহাদেশে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় (কোলকাতা, বোম্বে এবং মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভারতবর্ষে একটা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়। শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটাতে আমাদের এ পূর্ব বঙ্গে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অপরিসীম।
এদেশের সবগুলো গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ন্যায্য অধিকার আদায়ে সকল আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই আলোকবর্তিকা হয়ে সারা দেশকে পথ দেখিয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ যদি তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আদর্শ দীক্ষা না দিতেন তাহলে এসব অর্জন সম্ভব হতো না। এক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশে তথা পূর্ব বঙ্গে ড. মুহম্মদ ইউনুসের আগে কোনো নোবেলজয়ী ছিলেন না। ড. মুহাম্মদ ইউনুস আমাদের ঢাকা ইউনিভার্সিটির গর্ব। তিনি এখনও সারা বিশ্বে তাঁর কর্মের জন্য দেদীপ্যমান। তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক রেহমান সোবহান এখনও বেঁচে আছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সহপাঠীরাও যার যার ক্ষেত্রে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ড. ফরাস উদ্দীন, ড. ফখরুদ্দিন আহমদ, ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে বঙ্গবন্ধুর জন্যই আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমাদের পরিচিতি ছিল এবং এর ধারাবাহিকতা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায়ও ছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পরে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিচিত করেন ড. মুহাম্মদ ইউনুস।
আমাদের সৌভাগ্য যে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সকল আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনে (১৯৪৮-৫২) প্রথমভাগে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জেলে থাকার কারণে ১৪৪ ধারা ভঙ্গে অংশ নিতে পারেননি। তিনি শিক্ষকদের অত্যন্ত সম্মান করতেন। তিনি সাধারণত তাঁর সমবয়সী ও অনুজদের আন্তরিকভাবে ‘তুই’ বা ‘তুমি’ সম্বোধন করতেন কিন্তু তাঁর সন্তানের বয়সী শিক্ষকদেরকেও ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনামলে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী শিক্ষক অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে জাতীয় অধ্যাপক ও ডক্টর মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, তাঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও শিক্ষা মন্ত্রী নিয়োগ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর ০১লা জুলাই তারিখে শতবর্ষে পদার্পণ করলো। সেকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক সম্পর্ক, তাঁদের পাঠাভ্যাস ও সেরা ছাত্র ও শিক্ষকদের এক চিলতে তুলে আনার চেষ্টা করলাম আমার পড়াশোনা ও স্মৃতি থেকে, জানিনা কতটুকু সফলভাবে তুলে আনতে পেরেছি; আমাদের অগ্রজ পাঠকদের মতামত এ ক্ষেত্রে কাম্য। আমার বিশ্বাস এ এনেকডটস (Anecdotes) আমাদের বর্তমান ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে আর তবেই এ লেখার সার্থকতা। বাংলাদেশের রাজনীতি, আমলাতন্ত্র, প্রশাসন, সাংবাদিকতা, সাহিত্যকর্ম, ব্যাংক, বিমা, শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের নেতৃস্থানীয় জায়গাগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা সমাসীন।
আমরা লক্ষ্য করেছি ঢাবির বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের পুনর্মিলনী, বই মেলা কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ব্যক্তিবর্গও যখন তাঁদের শিক্ষকদের দেখা পান তখন তাঁরা সবাই শ্রদ্ধায় অবনত হোন। প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা যে পদেই থাকুন না কেন তাঁদের শিক্ষকদের প্রতি সম্মানটা সবসময়ই অটুট থাকে। এটিই হচ্ছে ঢাবির ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের চমৎকার রসায়ন ও সৌন্দর্য। ঢাবির ছাত্রশিক্ষক সম্পর্কের এ বন্ধন শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় এবং বন্ধুত্বে আরও পরিপূর্ণ ও পরিপুষ্ট হোক; প্রাজ্ঞ এবং যোগ্যরা কেবল শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হোক; নেতৃত্বগুণ, প্রশাসনিক দক্ষতা, গবেষণা ও মেধার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হোক এটাই আমাদের চাওয়া।
লেখক : মোহাম্মদ আবু সালেহ, সহ-প্রতিষ্ঠাতা, ই-স্কুল অব লাইফ।