লকডাউন চিচিং ফাঁক, চিচিং বন্ ও করোনার চালাকি

|| সীমান্ত বাঁধন চৌধুরী ||

প্রতিদিনই লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। চারদিকে শুধু আপনজন হারানোর কান্না । অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠা আর অসহায়ত্ব এখন আমাদের প্রতিমুহূর্তের সঙ্গী। খুব চেনা আপন এ পৃথিবী মানুষের কাছে এখন খুব অচেনা ভিন্ন কোনো এক গ্রহ। কারণ কোভিড- ১৯ যেনো আমাদের চারপাশকে অচেনা অপরিচিত করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রায় তিনমাস হতে চলল করোনার বয়স। প্রথমে হামাগুড়ি দিয়ে এলেও এখন রীতিমত লাফিয়ে বাড়ছে প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা।

তবে মানুষ তো শুধুই করোনায় মারা যাচ্ছে না। নানা ধরণের রোগের কারণেই মারা যাচ্ছে । আগের সময় থেকে এখন তফাৎ হলো এই যে, আগে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা পেয়ে মানুষ বেঁচে যেতো, এখন তাঁরা হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে চিকিৎসা নিতে না পেরে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। মৃত্যু অনিবার্য সত্য। তাই বলে এভাবে ? বিনা চিকিৎসায় ?

স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, “চিকিৎসার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও হাসপাতাল থেকে রোগী ফিরিয়ে দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ” কে শোনে কার কথা! আর শুধু বললেই তো হবে না। কে মেনে চলল, কে মানল না, বলার পর তা দেখভাল করলে না হয় কথা ছিল। সেটাও কী হচ্ছে। আর এই হওয়াটাইবা দেখবে কে?

সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল অমান্য তো করেই যাচ্ছে ! কি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, আদৌ নেয়া হচ্ছে কি না,তা মানুষ জানছে না। কোন কথাটা কে রাখছে ?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, ৫০ শয্যার বেশি যে কোনো হাসপাতাল হোক সেটা সরকারি বা বেসরকারি, কোভিড-নন কোভিড দুই ধরণের রোগীই সেখানে সেবা পাবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

ব্যয়বহুল বেসরকারি ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে কোভিড-১৯ পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে সরকার। সরকার নির্দিষ্ট ফি ধার্য করে দিলেও বেশিরভাগ হাসপাতাল অতিরিক্ত ফি আদায় করছে। এমন অভিযোগ উঠছেই। বৈশ্বিক এমন বিপর্যয়ে তাঁরা মানবিক না হয়ে করোনা যেন তাদের কাছে টাকা কামানোর উৎসবে পরিণত হয়েছে ।

ডায়ালাইসিস রোগীর করোনা শনাক্ত হওয়ায় চিকিৎসা না দিয়ে মাঝ রাতে বের করে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ আনোয়ার খান মডার্ন, ল্যাবএইড, ইউনাইটেডসহ বেশিরভাগ হাসপাতালের বিরুদ্ধেই শোনা যাচ্ছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে, আর হাসপাতালগুলো তাঁদের খেয়ালখুশি মত কাজ তারা করে যাচ্ছে । কে দেখবে এসব ? মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই ।

হাসপাতাল আছে, চিকিৎসা নেই। টেস্ট নেই। টেস্ট আছে তো নমুনা জট, দীর্ঘসূত্রতা। এমন হচ্ছে যে, রিপোর্ট পাওয়ার আগেই পরপারে চলে যেতে হচ্ছে রোগীকে। আর বেঁচে থাকলেও করোনা রোগী হয়ে যাবেন যেন অচ্ছ্যুৎ ! কোন হাসপাতালে ঠাঁই না মেলার সম্ভাবনাই বেশি, যদিও বা ঠাই মেলে, প্লাজমা লাগবে তো ? করোনা ভাইরাসের ভুয়া প্রত্যয়ন পত্র নিয়ে প্লাজমা বিক্রি করছে একশ্রেণীর হারামির দল।

করোনার প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেবেন? আছে জেএমআই এন ৯৫ মাস্ক। হয়রানির আরেক নাম? করোনা হটলাইন। দরিদ্রদের সাহায্য পাঠিয়েছে সরকার ? সে এলাকার চেয়ারম্যানের ছেলে, ভাই, বোন, বউসহ দরিদ্রদের তালিকায় দেখা গেলো ১৯ জনের নাম! পার্বতীপুরে ১০ টাকা কেজির চাল কিনেছে ৪ মৃত ব্যক্তি! লালামনিরহাটে নিজেকে মৃত দেখিয়ে স্ত্রীর নামে বিধবা ভাতা নেন এক ক্ষমতাসীন নেতা ! ত্রাণের চাল, ডাল, তেল প্রসঙ্গ থাক। এসব বলতে গেলে ১০০১ রাতেও শেষ হবে না।

দ্য ইকনোমিস্টের এশিয় মুদ্রণ সংস্করণে একটি নিবন্ধে সম্প্রতি বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, (আইসিডিডিআরবি) এর প্রাক্কলন অনুযায়ী শুধু রাজধানী ঢাকাতেই আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যে সাড়ে ৭ লাখ। যদিও সরকারি হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ হাজারের নিচে।”

কি ভয়ানক কথা!

করোনাকে আসলে আমরা এই তিন মাসে অনেক তুচ্ছ করে দেখেছি। তাতে করোনার unlimited delivery হয়ে গিয়েছে।

যেমন- লকডাউন চিচিং ফাঁক,চিচিং বন্ ।

হাজার হাজার শ্রমিক ঢাকায় ডেকে আনা, গ্রামে পাঠানো, ঈদের আনন্দ করতে পাঠানো আবার আনা। ব্যক্তিগত গাড়িওয়ালাদেরই শুধু ঈদ করতে বাড়ি যেতে রাস্তা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া। এসব মস্করা মানুষ সহ্য করলেও করোনার সহ্য করবার কথা না। এর খেসারত হিসেবে করোনা আমাদের দিয়েছে এক হৃদয়হীন Suspense.

যেভাবে করোনার আগুন ঘরের চালায় ধরেছে, তাতে আকাশচুম্বী হতে কতক্ষন ?

এই ঘোরতর অন্ধকার বিপদে অন্তত সরকারি বেসরকারি হাসপাতালসমূহ, সেবাদানকারী, মালিক/কর্তৃপক্ষ তথা স্বাস্থ্যবিভাগের সর্বত্র মানবিকতার ফলন হোক। অভাগা দেশের দুর্ভাগা মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হোক।

আমরা ভুলে না যাই, মৃত্যু অমোঘ সত্য সবার জন্য। তা যিনি মনে করেন To the well-organized mind, death is but the next great adventure তিনিও সত্যিকার অর্থে মরতে ভয় পান, আবার কেউ,“”মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান” পাঠ করলেও মরণ খাতির করবে না। মরণ, করোনা এরা চালাকি বোঝে।

৭ thoughts on “লকডাউন চিচিং ফাঁক, চিচিং বন্ ও করোনার চালাকি”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন