|| মীর আব্দুল আলীম ||
লকডাউনে দেশটা লক নেই। অবশ্য এর একটা কারনও আছে। লকডাউনে সরকার যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন তাতে রাস্তায় বের হওয়ার অনেক ফাঁক ফোঁকোড় রয়েছে। অনেকটা “বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোর” মতো। লকডাউনের ব্যাপারে হুঙ্কার আছে; সাথে আছে শৈথিল্যও। বলা যায় অদ্ভুত এক লকডাউনে দেশ। সরকারী নির্দেশনায় বলা হয়েছে বই মেলা চলবে, শিল্পকারখানা চলবে, ব্যাংক অফিস-আদালত চলবে, তবে সীমিত পরিসরে। প্রশ্ন হলো এসব কাদের জন্য চালু থাকবে।
আবার বলা হয়েছে গণপরিবহন চলবে না। কিভাবে মানুষ অফিস আদালত কল কারখানায় যাবেন? ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে? উড়ে উড়ে! আমি কিন্তু আজ ৫ই এপ্রিল আমার হাসপাতালে ঠিকই গেলাম। এলাকায় (রূপগঞ্জে) গিয়ে কোভিডে মারা যাওয়া দুই ব্যক্তির দাফন কাফনের ব্যবস্থা করলাম। নিজের গাড়িছিলো তাই পথে যানজট ছাড়া সমস্যা হয়নি আমার। যাদের নিজেদের গাড়ি নেই তারা কাজে কিভাবে যাবেন? যদি ডানা লাগিয়ে দেওয়া যেতো উড়ে উড়ে মানুষ কাজে যেতো। তাতো আর সম্ভব না। তাহলে কর্মস্থলে যাবার উপায়টা কি তাদের? পায়ে হেঁটে কিংবা ৩/৪ গুন বাড়তি টাকা গুণে তবেই যেতে হচ্ছে কাজে। আসলে সবদিক থেকে গরিবেরই মরণ। বলিহারি দেশ বলে কথা। এখানে গরিবই যাতনায় পরে। লকডাউনে ধনীরা আরামসে চলবে, গরিবের আয় কমে যাবে, আর ব্যয় বেড়ে যাবে এটাইতো হচ্ছে।
বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলতে হচ্ছে। ৫ই এপ্রিল থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে। সেদিন সকালে কোভিড আক্রন্ত হয়ে মারা যাওয়া আমার আল-রাফি হাসপাতালের ব্যবসায়ীক পার্টনার আরমানুজ্জামান ভাইয়ের জানাজায় যাওয়ার পথে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রূপগঞ্জে এক ঘন্টা সড়কে আটকে পড়ি। জানাজার সময়ও ঘনিয়ে আসছে। গাড়ির ভেতরে ছট্ফট্ করছি আমি। এ অবস্থায় আমার ড্রাইভার বিল্লাল বলে ওঠে- “স্যার সেইরাম লকডাউন’। আসলে লকডাউনটা সেই রকমই। অন্যদিনের চেয়ে সড়কে গাড়ি বেশি। রাস্তায় শ্রমিক কর্মচারিদের বিপুল উপস্থিতি। চলতে গিয়ে বাজারে বাজারে মানুষের জটলা ঠিক আগের মতোই। এটা নাকি লকডাউন! এদেশে সব কিছুই আসলে উল্টো পথে চলে।
পণ্য মুল্যের কি অবস্থ্য? এদেশের মানুষগুলোও বেশ অসভ্য। টাকা আছে তাই হুড়মুড় করে বাজার থেকে প্রযোজনের তুলনায় ৪ থেকে ৫ গুন খাদ্যদ্রব্য কিনে ঘরে মজুত করে। এবার লকডাউন ঘোষণার পরও তাই দেখেছি আমরা। এর ফলে বাজারে পণ্যের সংকট তৈরি হয় আর তাতে পণ্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। আর দেশের মজুতদাররাও এ সময় ঝোপ বুঝে কোপ মারবেন বলে একদম তৈরি থাকেন। সুযোগ বুঝে ১ টাকার পণ্য ২ টাকায বিক্রি করে রাতারাতি আঙ্গুল ফলে কলাগাছ হন তারা। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো কষ্টে পরে। ওদেরে কষ্ট বোঝার লোকতো আর নেই এ দেশে। তাই যা হবার তাই হয়। এসব বিষয়গুলো সরকারের ভাবনায় আসুক।
আসলে আমরা সতর্ক নই বললেই চলে। লকডাউনেও হাটবাজার পুরোদমেই চলছে। গার্মেন্ট, কলকারখানা নিয়মনীতি না মেনেই পুরোদমে উৎপাদনে। হেফাজাতের আন্দোলনও কোথাও কোথাও হচ্ছেই। রাস্তাঘাট, মসজিদে, বাজারে মানুষ। জনসমাগম সবখানেই হচ্ছে। আগের চেয়ে বাজারে এখন বেশি মানুষ। মানুষের হুঁশ নেই। টাটকা তরিতরকারী, মাছ, মাংস কিনতে মানুষ বাজারে ছুটছে। চায়ের দোকানের আড্ডাও বেশ জমছে। লোক জড়ো করে দান-খয়রাত, ফটোসেশন কোনটাই বন্ধ নেই। অন্ধ মানুষ, বন্ধ বিবেক।
এদেশে কি আইনকানুন মানে কেউ। আইনানুন মানাতে হয়। যারা মানাববার দ্বায়িদ্বে থাকেন তারা ঘরে আরাম আয়েশ করেন। কোভিডে জীবনের ঝুঁকি নিতে চান না। যাকনা সব গোল্লায় তাতে তাদের কি? জবাবদিহিতাতো নেই এদেশে। সরকার যখন লকডাউন কিংবা কোন জরুরী অবস্থার কথা ভাববেন তখন সরকারের আরেকটা বিষয় ভাবনায় থাকা জরুরী। আইন মানতে বাধ্য করার মতো লোক রাস্তায় নামানো।
পাঠক মনে আছে নিশ্চয়ই ম্যাজিষ্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলার কথা। তিনি আমার খুব কাছের মানুষ। পারিবারিক সম্পর্কও রয়েছে তারসাথে। তাঁর কথা একারনে এ রেখায় টানলাম। এমন সৎ মানুষ সরকারে অনেক আছে। সরকারের যারা আছেন তারা সবাই অসৎ নন। বেছে বেছে এলাকা ভিত্তিক, জেলা কিংবা উপজেলা ভিত্তিক এসব সৎ মানুষদের মনিটরিংয়ের দ্বায়িত্বে রাখা গেলে ফলাফলটা যে ভালো হবে সেটা নিশ্চিৎ। আসলে আমাদেও ভাবনাটা কম। সবার কথাই ভাবতে হবে। লকডাউনতো মানুষের জীবন রক্ষা করার জন্যই। তাই মানুষের সার্বিক ভাবনাটা সরকারকে ভাবতেই হবে। বিশেষ করে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের কথা। এ সময় তাদেরই বেশি কষ্ট হয়। যারা রাজনীতি করেন তাদেও বলছি। রাজনীতির খাতায় নাম লেখাতে পারলে এদেশে কামাইরোজগার বেশ ভালো হয়। তবে সব রাজনৈতিক নেতার ভাগ্যে আবার শিকে ছেঁড়ে না। আবার অনেক রাজনীতিক আছেন যারা আসলেই মানুষের কল্যাণ করতেই রাজনীতিতে আসেন। তবে যারা এপথে ওপথে কামাই রোজগার করেন তাদের বলছি। দয়া করে জনগনের কতা ভাবুন। লকডাউনে গরীবের অনেক কষ্ট হয়। না খেয়ে থাকেন অনেকে। নিজেদের অসীম ধনভান্ডার দেকে কিছু দিন তাদেরও।
যেভাবে কোভিডে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে আর মানুষ মারা যাবার ঘটনা ঘটছে তাতে সরকারের লকডাউন দেওযা ছাড়া উপায ছিলো না। লকডাউনে সরকার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশের অর্থনীতির চাকা অচল হয়। তা সামাল দিতে সরকরকে হিমশিম খেতে হয়। মানুষের জীবনতো আগে, তাই লকডাউনে যেতে হয়েছে সরকারকে। সরকারকে সহায়তা করুন। যার যতটুকু সঙ্গতি আছে সেমতো গরীবদের সহায়তা করুন।
যাহোক লকডাউনের কথা বলছিলাম। আসলে আগেও দেখেছি এদেশে হাস্যকর লকডাউন আর কোয়ারেন্টাইন চলে। লকডাউনে মানুষ এক জেলা থেকে আরেক জেলাতেও যাচ্ছেন। পঙ্গপালের মতো ট্রাক আর কাভার্ডভ্যানে মানুষ ঢাকায় আসছেন। নিষিদ্ধ গণপরিবহনও রাস্তায় দেখছি। আমরা কতইনা অসভ্য। অসচেতনতা আর কাকে বলে? যে দেশে জেল জরিমানা দিয়ে মানুষ বশ করা যায় না, সেখানে স্বেচ্ছায় লকডাউন আর বাসগৃহের কোয়ারেন্টিনের কথা শুনি। করোনা ভাইরাস নেগেটিভ আর পজেটিভের দৌঁড়ঝাপ মুখের কথায় বন্ধ করা অন্তত এদেশে অসম্ভব।
লকডাউনে ঢাকা শহরেতো ফাঁকা থাকার কথা। এখনওতো দেখছি যানজটের ঢাকাই। ঢাকা ফাঁকা না। রাস্তা ঘাট মানুষে ঠাঁসা। এখন কোথাও কোথাও আবার ট্রাফিক জ্যাম শুরু হয়েছে। অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁ খোলা। সুপার মার্কেটগুলোও অনেকই খোলা। তবে শপিংমলগুলো বন্ধ আছে। নতুন করে করোনার ঢেউ শুরু হওয়ায় সারাবিশ্ব যেখানে সতর্ক সেখানে আমাদের দেশে সবকিছু অনেকটা স্বাভাবিক। পরে হয়তো বুঝতে পারব কতটা ক্ষতি হলো।
এরইমধ্যে নেয়া হয়েছে বিসিএস ও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা। যেখানে সমাবেশ ঘটেছে লাখ লাখ মানুষের। আল্লাহ মাফ করুন। এর জের নিশ্চয়ই দিতে হবে। মহামরী করোনাতো ছাড় দেবার কথা না। একটা কথা মনে রাখতে হবে, সার্স, ডেঙ্গু বা ইবোলার মতো নানা ধরণের প্রাণঘাতী ভাইরাসের খবর মাঝে মাঝেই সংবাদ মাধ্যমে আসে। এমন মহাবিপদ থেকে আল্লাহ আমাদের উদ্ধারও করেন। আল্লাহ কিন্ত এও বলেছেন আমরা যেন এমন সময় সাবধান হই। আল্লাহর কথাওকি আমরা মানছি?
ইসলাম ধর্মে এসব রোগ-বালাইয়ের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। আল-কোরআনে মহামারী হলে যে যার স্থানে থাকার কথা বলা আছে। অন্য ধর্মেও রোগের ক্ষেত্রে সতর্ক করা আছে। প্রয়োজন না হলে ক’দিন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, অন্যের জন্য ঘর থেকে বাইরে না যাওয়াই ভালো। প্রয়োজন থাকলে কী আর করা! মনে রাখবেন, এ সমস্যা কিন্তু অনেক দিন ধরে থাকবে না। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেনই। কিছুদিন যারা সতর্ক থাকতে পারবেন, সবকিছু ঠিকঠক মেনে চলবেন তারা হয়তো এ বিপদ থেকে অনেকটা মুক্ত থাকতে পারবেন। তবে আমরা বেশিই অসাবধান। কোনো কিছুকেই গুরুত্ব দিতে চাই না কখনো। কোনো কিছু মানতে চাই না। এ অবস্থায় কি আমাদের রক্ষা হবে?
করোনায় করুণা করছে না কাউকে। সবচেয়ে ধনী দেশগুলো করোনায় কুপোকাত। উন্নত প্রযুক্তি, গবেষণা, করোনার ভ্যাকসিন, কোনটাই কাজে আসছে না। মানুষ মরছে প্রতিদিন। আমাদের আরও প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা কতটা প্রস্তুত? আর কতটা সতর্ক? সতর্কতা খুবই কম। মানুষ কথা শুনতেই চায় না। সরকারের নিয়মের তোয়াক্কা করে না। স্বাস্ত্যবিধি মেনে চলে না। তাতে অনেক ভয়ংকর রুপে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে। সামাল দেয়া কঠিনই হবে। এখনই তা হচ্ছে। সতর্কতার অভাবে করোনাভাইরাসে সারাদেশে মানুষ এমনকি বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অনেক ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। দিনদিন বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা। অরক্ষিত অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে এঅবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
হয়তো সামনে সুসংবাদ নেই। ভয়াবহ দিন আসছে। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর মিছিলে অসংখ্য মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এসময় চিকিৎসকদেরই সবচেয়ে দরকার। চিকিৎসকরা যাতে সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত না হয়ে পড়েনে সে ব্যাপারেও সরকার সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি দিতে হবে। তাদের নিরাপদ রাখা খুব জরুরী। তাই আগে চিকিৎসকদের বাঁচান। চিকিৎসক বেঁচে থাকলে রোগীদের বাঁচানো যাবে। মানসম্মত এবং সময় মতো সুরক্ষা পোশাক (পিপিই) পাচ্ছে না আমাদের চিকিৎসকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসকদের যে পিপিই দেয়া হচ্ছে তা মানসম্মত নয়। চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিৎ না হলে; চিকিৎসক, নার্স অসুস্থ হয়ে পড়লে করোনা ভাইরাস চিকিৎসাসহ সাধারণ চিকিৎসায় সংকট তৈরি হবে। চিকিৎসক বাঁচলেইতো রোগীদের বাঁচানো যাবে। আগে চিকিৎসকদের পূর্ণ সুরক্ষা দরকার। তাঁরা সুস্থ থাকলে, তাঁদের মনোবল ঠিকঠক থাকলে রোগীদের পূর্ণ চিকিৎসা মিলবে, তা নাহলে নয়। করোনা ভাইরাসের রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে দিনদিন যেভাবে চিকিৎসকরাই আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন তাতে চিকিৎসকসমাজে আতংক তৈরি হচ্ছে বৈকি! ইতোমধ্যে হয়েছেও তা। সে কারণে চিকিৎসকদের সাথে জনগণ এবং সরকারে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে। সামনে আরও হবে হয়তো।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ না করায় এবং মন্ত্রণালয়ের নানা গাফিলতির কারণে কোভিড রোগীদেও চিকিৎসাসেবায় বাজে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আক্রান্তদেও সেবা দেয়া যাচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে। হাসপাতালে সাধারন সিটও নেই। আইসিউসিসিউতো সোনার হরিণ।
যেভাবেই বলি, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের যুদ্ধে নামতে হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। ঘুরতে না যাওয়া, বেশি মানুষ এক জায়গায় না হওয়া, চায়ের দোকান, বেশি বেশি বাজার করা, আড্ডাবাজি বন্ধ করতে হবে। করোনা নামক শত্রু এদেশে ঢুকে পড়েছে। সবাই সতর্কতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে না পড়লে আমরা হয়তো এ যুদ্ধে হেরে যাব। আসুন, সবাই সতর্ক হই। যেকোন মহামারীতে সতর্কতার বিকল্প নাই।
এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। যুদ্ধ জয়ের জন্য আমাদের আতঙ্কগ্রস্ত হলে চলবে না। দিশেহারা হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। করোনা পজেটিভ কিংবা উপসর্গ হলেই ভয়ে কুকড়ে মুকড়ে যাবেন না। করোনা পজেটিভ মানেই মৃত্যু নয়। আপনি নিয়মকানুন মেনে চললে ঠিকই সেরে উঠবেন। মনে রাখবেন, ভাইরাস থেকে রক্ষার একটাই পথ, সতর্কতা।
লেখক: ব্যবসায়ি ও সমাজকর্মী, ফোন যোগাযোগ: ০১৭৩৩৩৬১১১১