|| বিপ্লব শাহনেয়াজ, স্টকহলম, সুইডেন থেকে ||
শোকে বাকরুদ্ধ ছিলাম! কোনো কিছু লেখার চেষ্টা করেও এগুতে পারছিলাম না! প্রবাসী মনটা কেমন একটা অপরাধরোধে পুড়ছে! এত গুলো প্রাণ এভাবে অকালে ঝরে গেল- কতগুলি অর্থলোভী মানুষের সচেতন অপরাধে! সেই সাভারে – যেখানে নবীনগরে দৃঢ় চিত্তে অবস্থান করছে আমাদের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের প্রতীক স্মৃতিসৌধ! স্বাধীনতার এই পঞ্চম দশকে – এখনও মানুষকে মরতে হয় শোষিত হয়ে; লোভের শ্মশানে অঙ্গার হয়ে! স্বাধীনতা তুমি কি আজও স্পর্শের বাহিরে? নাকি কালের আবর্তনে আমরা শুধু শোষকের ই পরিবর্তন দেখেছি? শোষিত হিসাবে আমাদের অবস্থান আজও অপরিবর্তিত!
পৃথিবীটা প্রতিযোগিতার এক নিষ্ঠুরতম স্থান! সব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা – দরিদ্র আর দুর্বলের বিরুদ্ধে ধনী আর সবলের আজন্ম নিস্পেষণ- আজ বিশ্বায়নের এই যুগে নতুন মাত্রা পেয়েছে আর কি! উত্তর আমেরিকা, ইউরোপসহ বিশ্বের ধনী দেশসমূহ তাদের নিজেদের নাগরিকদের ব্যাপারে অতিমাত্রায় সচেতন! কর্ম পরিবেশ, শ্রমিক অধিকার এবং পন্যের মান একটি মানসম্মত অবস্থানে রাখতে গেলে উন্নত দেশগুলিকে অনেক বেশি বেতন দিতে হয়! তাই উন্নত দেশ থেকে কিছু কিছু মাঝারি বা ছোট ছোট শিল্প -সস্তা শ্রমের দেশে স্থানান্তরিত হয়েছে! লক্ষ্য সস্তা শ্রমবাজারকে ব্যবহার করে নিজের দেশের নাগরিকদের কমমূল্যে পণ্য কেনার সুবিধা দেয়া! নৈতিকতার যদি প্রশ্ন আসে – সস্তা শ্রমিকের কর্ম পরিবেশ, অধিকারের ব্যাপারটা কখনই ধনী ক্রেতারা – পণ্য কেনার আগে বলেনি! কর্মের মানসম্মত পরিবেশ আর শ্রমিকের যথাযথ অধিকার নিশ্চিত করলে আমাদের সস্তা শ্রমের বাজারও ইউরোপ -আমেরিকার শ্রমবাজারের মত খরচবহুল হয়ে উঠবে! এই খরচ বাঁচাতেই তো -নকশী কাঁথার শিল্পী শিউলি -শেফালী-জরিনাদেরকে গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসা! ১৬ ঘন্টা শ্রম দিয়ে বস্তির ঘরে ফিরে – কাকডাকা ভোরে- আবার সেই তালাবদ্ধ কলাপসবলে দরজার ভিতরের ১৬ ঘন্টা! বকেয়া বেতনকে জিম্মি করে – অসময়ে ইচ্ছামতন ব্যবহার! মাস গেলে হয়তবা ৩০০০ টাকা! গ্রামে যে টাকা দিয়ে অনেক কিছু হত – আজ এই টাকা দিয়ে শহরে অনেক কিছুই হয় না! বস্তির ঘর ভাড়া বাকি পরে! বকেয়া বেতন হাতছানি দেয়! আর ফেরা হয় না – সহজ সরল সেই জীবনে!
বারে বারে আমাদের দেশে এক একটা দুর্ঘটনার পর পর – মানবাধিকার দেশের সেই সব ক্রেতারা স্থানীয় মালিকদের কিছু কিছু শর্তের মধ্যে এনেছে! কিন্তু এর জন্য দিতে হয়েছে অনেক শ্রম- রক্ত!
স্থানীয় পোশাকশিল্প মালিকরা নিজেদের মুনাফা দেখেছে সবচে আগে! মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী থেকে আজ তারা সবাই ধনী শ্রেণী গোত্রীয়! ক্রেতাদের দুতাবাস পাড়ার কাছা কাছি তাদের বাস! দামী গাড়িতে তাদের যাতায়াত! তাদের কারখানা থেকে যে জামাটি তৈরী হচ্ছে , বিদেশে যাচ্ছে – ধপধপে পরিস্কার সেই জামাতে তখনও রয়ে যায় শত রেবেকা, বিউটির কান্না, ঘাম আর রক্তের নোনা স্বাদ ! রক্ত পানি করা শ্রমের ফসল যায় ক্রেতা আর বিক্রেতার পকেটে! সোজন বাঁধিয়ার ঘাটে আর শান্তি আসে না- দু:খ আর দারিদ্রকে সাথী করে, লোভ-লালসায় কখনো কয়লা – কখনো বা ছাদ চাপা মাংশপিন্ড হয়ে – আমৃত্যু দারিদ্রের দ্বাসত্ব করতে হয়!
গত চার দশকে বাংলাদেশ অবকাঠামোগত অনেক পরিবর্তন হয়েছে! দারিদ্র বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়ন, খাদ্যে স্বনির্ভরতা, শিক্ষা, সফল জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি, শিশু ও মায়ের গর্ভকালীন মৃত্যু হ্রাস, শিশু অধিকার আইন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী শিক্ষার প্রসার সহ আরো অনেক বিষয় প্রশংসার যোগ্য! ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার দিয়েছে নতুন নতুন পণ্য রফতানির সুযোগ! বিশ্বায়নএর সাথে সাথে আমাদের ভোগ্জাত আমদানিও বেড়েছে!
জাতীয় পরীক্ষাগুলিতে আগে যেখানে শতকরা ৩০ ভাগ পাশের হার ছিল, আজ সেখানে শতকরা ৮০-৯০ ভাগ হয়েছে! শিক্ষার মান কতটা বেড়েছে তা যদিও আলোচনার বিষয়!
বেড়েছে এক বাড়ন্ত ধনী মধ্যবিত্ত শ্রেণী, বেড়েছে এক উচ্চ বৃত্ত শ্রেণী! দারিদ্র কমলেও, ক্রয় ক্ষমতা বাড়লেও – বেড়েছে ধনী -গরিবের বিস্তর ফারাক! বেড়েছে হতাশা! বেড়েছে দুর্বিত্তায়ন! বেড়েছে মাদকের বিস্তার! মাদকে আসক্ত এক বিশাল জনগোষ্ঠী তৈরী হয়েছে! দুর্নীতি, সন্ত্রাস আর দুর্বিত্তায়ন পেয়েছে প্রাতিষ্ঠানিকতা! সংখ্যালঘু হয়েছে আরো সংখ্যালঘু! লোপ পেয়েছে অসাম্প্রদায়িকতার! রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দিয়েছে মাঠপর্যায়ের দুর্বৃত্তদের বৈধতা!
রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ী আর সন্ত্রাসীদের দখলে! সোজা কথা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্খলন, রাষ্ট্রীয় আর ব্যক্তি জীবনে অসম ভাবে বিস্তার করেছে! তৈরী করেছে সামাজিক অবক্ষয় ! এই অবক্ষয়ের বিস্তৃতি অনেক গভীরে!
মাঝে মাঝে ক্ষত হয়ে দেখা দেয়- রানা প্লাজার মত! এখানে রানা ও রানা প্লাজা একটি প্রতীক! আমাদের সমাজ আর দেশের অবক্ষয়ের প্রতীক! এই ভবনের নির্মান এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের আর রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছে! ক্ষয়ে যাওয়া নৈতিকতা, মুনাফালোভী মনোভাব, শোষণ -প্রেষণ এর একক বা সম্মিলিত উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে স্তপতি, পৌর মেয়র, ভবন মালিক ও তার রাজনৈতিক পরিচয়, পোশাক ব্যবসায়ী, সরকারী কর্মকর্তা, স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা সহ প্রশাসনিক কর্মকর্তা! হাতেগোনা কয়েকটি ক্ষমতাবান, অর্থলোভীর কাছে কিভাবে একটি বৃহত্তর জনগোষ্টি জিম্মি- তার জলন্ত উদাহরণ এই রানা প্লাজা! তাই রানা প্লাজার ফাটল বা ধসকে ব্যক্তি রানার কৃতকর্ম বলে হালকা ভাবে নেবার কিছু নেই! এই ফাঁটলকে দেখতে হবে গোটা জাতির ভবিষ্যতের পথে এক বিশাল ফাঁটলের সতর্কবাণী হিসাবে! আর তাই যদি না হয় তবে খুব শিগ্রই আমরা ১৬ কোটি প্রাণ একদিন এক বিশাল ধংসস্তুপের নিচে চাপা পড়বো।
রানা প্লাজা যেমন আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের স্খলন, পতন, ধংশ আর মানবতার অবমাননা! ঠিক তার বিপরীতে ধংশস্তুপের উপর দাড়িয়ে আমরা দেখিয়েছি মানবতাকে কি ভাবে মর্যাদা দিয়ে হয়! একটা মানবিক রাষ্ট্র গঠনের বন্ধুর পথে এ এক অনন্য অর্জন! ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার আর ধর্মান্ধতার বিপরীতে শাহবাগ এ যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল – সেই মানবতার অর্জনের সুদুর প্রসারী আন্দোলনে ‘রানা প্লাজা ধস পরবর্তী’ সময়ে – তার ই পূর্ণতা পেল! সেনাবাহিনী, পুলিস, পেশাদারী ও অপেশাদারী উদ্ধার কর্মী, সাধারণ মানুষ, ডাক্তার, সেবিকা, মিডিয়া কর্মী সহ সর্বপরি মানুষের মধ্যে যে সহমর্মিতা, সহানুভুতি আর সেবার মনোভাব ছিল – তা দুর্লভ! জাতি হিসাবে তা ভবিষ্যতে এক প্রেরণা দিবে বলেই বিশ্বাস করি!
ঘটনা পরবর্তী সময়ে সল্প সময়ে সংশ্লিষ্ট অনেকেই আইনের হাতে ধরা পরেছে! টি এন ও আর পৌর মেয়র প্রত্যাহার করা হয়েছে! এখন আমরা অপেক্ষা করব সুষ্ঠু বিচার আর এই গণহত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি!
জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে এই উদ্ধার কাজে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটি জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলা দল গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছেন- যা সত্যি প্রশংসাযোগ্য ও দূরদৃষ্টি সম্পর্ণ সময়উপযোগী সিদ্ধান্ত! দুর্যোগমোকাবেলা প্রক্রিয়াটি একটি চক্রের মত! একটি থেকে আর একটি পর্যায়ে যেতে কোনো সুনির্দিষ্ট সময় বিন্যাস নেই! উত্তরন করতে হয় ধীরে ধীরে। ভবন ধ্বস, মহামারী, ভুমিকম্প সব ক্ষেত্রেই এর প্রয়োজন আছে।
দুর্যোগ এবং প্রথম পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া :
দুর্যোগের ব্যাপ্তি ধারণা করেই খুব দ্রুততার সাথে উদ্ধার কাজ শুরু করে দেয়া- প্রথম পর্যায়ে খোঁজ করা, উদ্ধার করা ও নিরাপদ ভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের বের করে আনা! প্রয়োজনীয় চিকিত্সা নিশ্চিন্ত করা! আর অন্যদের অস্থায়ী আশ্রয়ে রেখে পানি, খাবার সহ প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা করা! ভুক্তভোগীদের মানসিক সাহসদান এ পর্যায়ের অন্যতম একটি প্রধান কাজ!
পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়া:
যখন প্রথম পর্যায়ের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শেষ হয় অথবা সমাধানের একটা পথ খুঁজে পায় – তখনি শুরু হয়ে যায় পুনর্নির্মাণের কাজ! কি ভাবে ভেঙ্গে যাওয়া ব্যবস্থাকে আবার দাঁড় করানো যাবে, অব এবং পরিকাঠামোগত উন্নতি, পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করা আর ভবিষ্যত এর প্রয়োজন নির্ধারণ করা – পুনর্নির্মাণ পর্যায়ের কাজ!
প্রতিরোধক ও প্রতিশোধক পর্যায়:
দুর্যোগ মোকাবেলার এই পর্বে মানুষ ব্যক্তি ও সমষ্টিগত ঝুঁকিগুলি চিনতে শিখে, প্রতিরোধ ও প্রতিশোধক এর উপায় খুঁজে বের করে! জেনে যায় কি ভাবে ঝুকিজনিত বিপদকে হ্রাস করা সম্ভব! বিভিন্ন নির্মান প্রক্রিয়ার ত্রুটি বের করে বিপদের ঝুকি কমানো হয়! আঞ্চলিক ও জাতীয় ভাবে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য একটি দল সবসময় প্রস্তুত থাকবে! যারা প্রয়োজনীয় সময়ে সল্প সময়ে নিজ নিজ কাজ ফেলে – দুর্যোগ মোকাবেলা দলে যোগ দিবে! এমনকি বিপদকালীন সময়ে কোন স্থান এর রুগী কোন হাসপাতালে যাবে তা নির্দিষ্ট করা থাকবে!
প্রস্তুতি মূলক পর্ব:
বিপদের সম্ভবনা দেখার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই কে যথা শীঘ্র জানানো ক্ষতির পরিমান কমিয়ে আনে!
windows of opportunity :
দুর্যোগ মোকাবেলার দ্বিতীয় পর্বে শুরু হয় পুনর্গঠন-ধংসের মাঝে নতুনের গান গাওয়ার সময় এটাই! গতদিনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরিবর্তন, পরিবর্ধন এর নতুন ধারাতে আসতে পারলে অসম্ভব ও সাধন হয়! বিভিন্ন জাতি তাদের উন্নয়ন আর পরিবর্তনের সত্যিকার ধারা শুরু করেছে এই সময় ই! এখন ই সময়! সংলাপের সুবাতাস, পোশাক শিল্পের মালিক সমিতিদের পরিবর্তনের আশ্বাস- ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার – সচেতন অপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া হয়ত – নতুন বসন্তের ই ইঙ্গিত! নাকি আবার রোদন ভরা বসন্তে – আমাদের ও কাঁদতে হবে – আবার- বার বার!