|| ত্রিদিবসন্তপা কুণ্ডু ||
একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছেই ভীষণ প্রাসঙ্গিক যে তা নয়, এই দিনটি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের বাঙলা ভাষাভাষীদের কাছেও সমগুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পৃথিবীর মানচিত্রে ১৯৭১ সালে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে শরৎচন্দ্র বসু, সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসিমরা যে স্বাধীন বাংলার রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন তা যে অলীক কল্পনা ছিল না, বাংলাদেশের জন্ম আমাদের সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রামাণ্য আখ্যান রচনা করেন বদরুদ্দীন উমর। যার কলম ও চিন্তনে সৃষ্টি হয়েছে এই অঞ্চলের মানুষের প্রগতির পক্ষের রাজনৈতিক সাহিত্য। উমরের রাজনৈতিক সাহিত্য সৃষ্টির ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তিন খণ্ডে রচিত অসংখ্য সাক্ষাৎকার ও দলিল সংবলিত ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (১৯৭০) গ্রন্থটি। যা আজও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসচর্চায় একটি অপরিহার্য গ্রন্থ। বিগত শতাব্দীর এক অগ্রগণ্য ইতিহাস-চিন্তাবিদ ইতিহাসের ছাত্রদের উপদেশ দিয়েছিলেন ইতিহাসকে বুঝতে হলে ইতিহাসবিদকে জানা প্রয়োজন এবং সে জন্য জরুরি তাঁর সময়কে জানা। তাই এই আখ্যানকার কোন পরিবেশে বড় হয়েছিলেন তা জানা দরকার।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের একটি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত, রাজনীতিমনস্ক পরিবারে বদরুদ্দীন উমরের জন্ম দেশভাগের আগে ১৯৩১ সালে। বাবা আবুল হাশিম ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের প্রথম সারির নেতা। অসাম্প্রদায়িক, চিন্তাশীল, ইসলামীয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষটি মুসলিম লীগে কিছুটা একলা হয়ে পড়েছিলেন শেষের দিকে। বাংলা ভাগ হোক, এটা তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি।
বস্তুত, অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার ধারণাটি ছিল আবুল হাশীমের মস্তিষ্কপ্রসূত। তাঁর নিকট আত্মীয়দের অনেকেই কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ রকম একটি রাজনৈতিক পরিবেশে বদরুদ্দীন উমরের বড় হয়ে ওঠা। পড়াশোনা বর্ধমান টাউন স্কুলে এবং পরে বর্ধমান রাজ কলেজে। দেশভাগের পরে বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃত্বের একটি বড় অংশ পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেলেও আবুল হাশিম সেই পথে পা বাড়াননি। তবে ১৯৫০ সালে তাঁদের বর্ধমানের বাড়িতে এক দল দুষ্কৃতি আগুন লাগায়। এই ঘটনায় আবুল হাশিম ভেঙে পড়েন এবং দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
উমরের বয়স তখন আঠারো। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন দর্শন নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তখন ভাষা আন্দোলনে উত্তাল। তবে সেই আন্দোলনে তিনি যুক্ত হননি। ১৯৫৭ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৫৯-৬১ সালে তিনি অক্সফোর্ডে পড়তে যান, যা ছিল তখন মার্কসীয় ইতিহাস চর্চার অন্যতম কেন্দ্র। ইতিহাসের ছাত্র না হলেও তিনি যে ঐ জ্ঞানচর্চার পরিমণ্ডলে প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নাই। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় পূর্ব বঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সারির নেতা নেপাল নাগের, যাঁর উদ্যোগে তিনি দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। ষাটের দশকে তাঁর ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৮) ও ‘সংস্কৃতির সঙ্কট’ (১৯৬৮) নামে দু’টি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়, যার ফলে তিনি রাজরোষের শিকার হন। এর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে যোগ দেন বামপন্থী রাজনীতিতে।
ষাটের দশকের শুরু থেকেই বদরুদ্দীন উমর ভাষা আন্দোলনের একটি তথ্যনির্ভর ইতিহাস লেখার ভাবনা শুরু করেন। ওই আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে যোগ না দেওয়ায় তিনি অনেকটা নির্মোহ অবস্থান নিতে পেরেছিলেন আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে। ভাষা আন্দোলনকে তিনি নিছক একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসাবে দেখতে রাজি ছিলেন না।
১৯৪৭ পরবর্তী পূর্ব বাংলার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোটিকে বোঝার জন্য বদরুদ্দীন উমর বহু মানুষের সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করেন। সে সব সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ পরে ঢাকার বাংলা একাডেমী থেকে দু’খণ্ডে প্রকাশিত হয় ‘ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ: কতিপয় দলিল’ (১৯৮৪, ১৯৮৫) নামে।



ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি শুরু থেকেই ছিল এবং এখনও আছে। বিভ্রান্তি রয়েছে আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি নিয়েও। সচরাচর এই আন্দোলনকে শহুরে, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের আন্দোলন হিসাবেই দেখা হয়ে থাকে। জনতার ভূমিকা সেখানে নাটকের মৃত সৈনিকের মতো। সম্প্রতি বাংলাদেশের কিছু ইতিহাসবিদ এই প্রশ্নটি নতুন করে তুলেছেন। কেন অগণিত সাধারণ মানুষ যাদের অনেকে স্কুলের চৌহদ্দিতে পা রাখেনি এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল?
এই বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসার দিকনির্দেশ বদরুদ্দীন উমর ১৯৭০ সালেই তাঁর লেখায় দিয়েছেন। তিনি ভাষা আন্দোলনকে একটি বিচ্ছিন্ন আন্দোলন হিসাবে দেখেননি। তাঁর বিশ্লেষণে ভাষা আন্দোলন ছিল পূর্ব বাংলার ক্রমবর্ধমান সামাজিক সংঘাতেরই বহিঃপ্রকাশ। তিনি দেখিয়েছেন যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলি ১৯৫২ সালের ভাষা-বিতর্কের সঙ্গে মিলে যায়। যার পরিণতিতেই ভাষা আন্দোলন একটি গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। এই মিলন ঠিক কী ভাবে ঘটেছিল, তা নিয়ে নতুন করে চর্চা করার অবকাশ আছে। বদরুদ্দীন উমর যেখানে শেষ করেছেন, সেখান থেকেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে নতুন ধরনের চর্চা শুরু হতে পারে।
পূর্ব পাকিস্তান সরকারের খাদ্য নীতি, কৃষিপণ্যের মূল্য, আমলা ও পুলিশের আচার-আচরণ নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ছিল উর্ধ্বমুখী। ১৯৫২ সালের ভাষা বিতর্ককে কেন্দ্র করে এই ক্রমবর্ধমান অসন্তোষেরই বিষ্ফোরণ ঘটে। এই অসন্তোষের অভিমুখকে সরকার বিরোধী আন্দোলনের দিকে পরিচালিত করায় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের ভূমিকাও ছিল অনস্বীকার্য। যদিও ভাষা আন্দোলনের সরকারি ইতিহাসে এঁদের ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তাই ভাষা দিবস উদ্যাপনের দিনে ভাষা আন্দোলনের এই আখ্যানকারকেও স্মরণ করা প্রয়োজন।
দ্রষ্টব্য: লেখাটি ২০১৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকাতে প্রকাশিত। যা ঈষৎ সম্পাদনা করে প্রকাশ করা হলো সংবাদ সারাবেলার পাঠকদের জন্য।(সম্পাদক)