|| সারোয়ার তুষার ||
রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা দেবে। রাষ্ট্র থাকবে সমাজের অন্তর্গত। সমাজে নানাবিধ স্বাধীন উদ্যোগ, সক্রিয়তা থাকে। ব্যক্তি ও সমাজের স্বাধীনতাকে নিঃশর্ত ধরে আইন ও ক্ষমতাকাঠামোর বিন্যাস তৈরি করা প্রয়োজন। নাগরিককে আইনত জুলুম-নিপীড়ন করার ঔপনিবেশিক মডেলের আইনের সাপেক্ষে মৌলিক অধিকারকে বিচার করা যাবে না। সমাজের দ্বন্দ্বগুলোর শান্তিপূর্ণ মীমাংসার পথ থাকা দরকার। একটা অন্তর্ভূক্তিমুলক বা ইনক্লুসিভ ও গণক্ষমতাতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে এগুলো অবশ্য এবং এই মুহূর্তে করণীয়।
বাংলাদেশের মানুষ একটা জাতি কারণ সে একটা জাতি হয়ে উঠতে চায়, আর কিছুই চায় না। প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছেন কথাটা। একটা জনগোষ্ঠী স্রেফ ‘জাতি’ হয়ে উঠতে চায় বলে পৃথিবীর অন্যতম দুর্ধর্ষ (পাকিস্তানী) সেনাবাহিনী একটা জেনোসাইড চালিয়েও পাকিস্তান রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে পারেনি। এইখানকার মানুষ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। ‘জাতি’ হয়েছে। কিন্তু ‘জাতি’ হলেও, যে রাষ্ট্র এই ‘জাতি’ অর্জন করেছে রক্তের বিনিময়ে, সেই রাষ্ট্রের শাসনপদ্ধতি কেমন হবে ; পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসনপদ্ধতির সঙ্গে ঠিক কী কী পার্থক্য হবে এবং কীভাবে হবে সেই ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট রূপকল্প এই ‘জাতি’র সামনে ছিল না।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ থাকাকালীন দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ এই জনগোষ্ঠীর মানুষের লড়াই সংগ্রামের অবচেতন অভিমুখ ছিল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশের বিগত সত্তর বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা থাকলেও, এখানকার মানুষের লড়াই সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস নিয়ে তেমন কোন আলাপ আলোচনা ও পর্যালোচনা নেই বললেই চলে। অথচ এই ভূখণ্ডের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার স্মারক হয়ে আছে ১৯৭০ সালের নির্বাচন। আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করানোর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা। যাতে পূর্ব বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা থাকবে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামরিক ও রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্ট যেহেতু পূর্ব বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে অস্বীকার করেছিল, তাই এই দেশের বুকে একাত্তর এসেছিল নেমে। নির্মম জেনোসাইড চালিয়েও পাকিস্তান রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা যায়নি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গণমুখী চেতনার মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থাকলেও, যে ধরনের রাষ্ট্র এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো তার সাথে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসনপদ্ধতি পার্থক্য সামান্যই ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামরিক কর্তৃপক্ষের জারি করা Legal Framework (LFO)’র অধীনে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন যারা, তাদেরই বাঙালি অংশ নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য ঔপনিবেশিক ধাঁচের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেছিল।
[১] এই শাসনতন্ত্র এই অঞ্চলের মানুষের নজিরবিহীন আত্মত্যাগকে অস্বীকার করে একব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামোর অধস্তন করেছিল বাংলাদেশের জনগণকে [২]। যার জের এখনো চলছে।
কিন্তু বাংলাদেশের ‘মূলধারা’র বুদ্ধিজীবীতায় এই সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের ইতিহাস কখনো উন্মোচিত হয়নি, হয়নি এ নিয়ে কোন আলোচনা। ফলে রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের অমীমাংসিত চুক্তিই বাংলাদেশের এখনকার প্রধান দ্বন্দ্ব। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতিই এখানে একটি গণক্ষমতাতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেয়। এই কাজ এখনো অসম্পূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে অনেক আলংকারিক কথাবার্তা থাকলেও, একাত্তরের পূর্ব বাংলার মানুষ মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারভিত্তিক একটি সমাজ-রাষ্ট্র অন্তত প্রচ্ছন্নভাবে হলেও চেয়েছে, সেই আলাপ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
মূলত বাংলাদেশের প্রধান সংকট শাসনতান্ত্রিক সংকট। এই সংকটকে পাশ কাটিয়ে আমাদের কোন ভবিষ্যত নাই। স্বাধীনতার পরপরই প্রতিষ্ঠিত স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোকে বহাল রেখে বাদবাকি সমস্ত প্রগতিশীল আকাঙ্ক্ষা আসলে কোন কাজেই আসবে না। ৫০ বছর ধরে একটা শাসনতান্ত্রিক সংকট তৈরি করে রেখে তারপর গোটা দেশকে নানা মতাদর্শে বিভক্ত করার অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে সক্রিয়তার কোন বিকল্প নাই। রাষ্ট্রকর্মের সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সংবিধান যে নিরঙ্কুশ স্বৈরতান্ত্রিক হওয়ার সুযোগ করে দেয় ক্ষমতাসীন দলকে, তা বন্ধ করতে হলে সাংবিধানিক সংস্কার করা দরকার।
কোন দলের ক্ষমতায় থাকা-না-থাকাকে বাংলাদেশের অস্তিত্বের সমার্থক করে দেখানোর পার্টিজান বুদ্ধিবৃত্তিক শঠতার বিরুদ্ধে গণমুখী বুদ্ধিজীবীতা তৈরির এখনই সময়। রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা দিবে। রাষ্ট্র থাকবে সমাজের অন্তর্গত। রাষ্ট্র থাকবে মানুষের অধীন। সমাজে নানানো স্বাধীন উদ্যোগ, সক্রিয়তা থাকে। ব্যক্তি ও সমাজের স্বাধীনতাকে নিঃশর্ত ধরে আইন ও ক্ষমতাকাঠামোর বিন্যাস তৈরি করা প্রয়োজন। নাগরিককে আইনত জুলুম-নিপীড়ন করার ঔপনিবেশিক মডেলের আইনের সাপেক্ষে মৌলিক অধিকারকে বিচার করা যাবে না। সমাজের দ্বন্দ্বগুলোর শান্তিপূর্ণ মীমাংসার পথ থাকা দরকার। একটা ইনক্লুসিভ ও গণক্ষমতাতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে এগুলোই এই মুহূর্তের করনীয়।
বাংলাদেশের মানুষের মানবিক ও নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার রাজনীতি গড়ে তোলার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন রাজনীতি এই মুহুর্তে থাকতেই পারে না। রাষ্ট্র মেরামতের সামাজিক বাসনাকে রাজনৈতিক ভাষা দেয়ার মতো বুদ্ধিজীবীতা এখন সময়ের দাবি। নাগরিক ও প্রাণ-প্রকৃতিকে রাষ্ট্রের উপনিবেশে পরিণত করার রাজনীতি গড়ে তোলাই বর্তমান সময়ের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’।
টীকা:
[১] বিস্তারিত পাবেন ফিরোজ আহমেদের বাংলাদেশের সংবিধান: উপনিবেশের উত্তরাধিকার প্রবন্ধে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, তৎকালীন হক-কথা’র একটি নিবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ একটি উক্তি: পাকিস্তান কায়েম থাকাকালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই দুই সময়ের ব্যবধান মাত্র নয় মাস হলেও, রাজনৈতিক সচেতনা, আশা-আকাংক্ষা ও মূল্যদানের দিক দিয়ে জনগণ অনেক এগিয়ে গেছে।
[২] বাংলাদেশের সংবিধান পর্যালোচনা, গণতান্ত্রিক আইন ও সংবিধান আন্দোলন, ২০১৩