|| ডা. শামীম তালুকদার ||
করোনা কোনো ভাইরাস নয় বা কোনো রোগ নয় এটি একটি গুজব। লকডাউন, দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের একটি চাল, তাদের নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এসব করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলছিলেন, দেশের বড় বড় নেতারা দেশ চালানোর সুবিধার্থে এবং নিজেদের পকেট গরম করার জন্য করোনা ভাইরাসকে পুঁজি করে দেশকে আটকে রেখেছে। সাধারণ জনগণ ভাত পাচ্ছে না এদিকে কারোও চোখ নেই। শুধু তিনিই নন, অনেকের মনে এমন ভাবনার উদয় হয়েছে। ভাবনাটি খুব একটা অস্বাভাবিক নয়।
সমালোচকরা বলছেন, দেশ চলছে ধার করা বুদ্ধি দিয়ে। নিজেদের উদ্ভাবিত চিন্তা চেতনার বিপরীতে অন্যদের চিন্তাকে প্রতিফলিত করা হচ্ছে, অন্যের গৃহীত পদক্ষেপ দেখে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, কোন দেশে কি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেই বুদ্ধি একটু একটু করে ধার করে এ দেশে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই সেটা আমাদের জনগণ ও অবস্থার সাথে মিলছে না। ফলে আম একদিকে যাচ্ছে আর বস্তা আরেকদিকে দৌঁড়াচ্ছে। আমকে কোনোমতেই বস্তায় ঢুকানো সম্ভব হচ্ছে না।
আসল পরিস্থিতিটা এরকম যে, বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি অনুযায়ী দেখা যায়, বিশ্বে করোনা সংক্রমণ প্রায় ১৬ কোটি ৯০ লক্ষ। আর মৃত্যু ৩৫ লক্ষ ১৩ হাজার ৪৯৭ জন। বাংলাদেশ সরকারের করোনা ইনফো’র তথ্য অনুসারে, গত ২৪ ঘন্টায় করোনায় মৃত্যুবরণ করেছে ১৭ জন আর নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ১৪৯৭ জন। বর্তমানের দেশে মোট মৃত্যু সংখ্যা ১২ হাজার ৪৫৮ জন এবং মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৭ লক্ষ ৯৩ হাজার ৬৯৩ জন। দেশের করোনা পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আছে যেখানে বিশ্বের অনেক দেশে এই পরিস্থিতি আশংকা জনক। (২৭ মে ২০২১ তারিখ পর্যন্ত)।
শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অধিংকাশ দেশেই লকডাউন চলছে। মৃত্যু বরণ করছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, আক্রান্তের পরিমাণ কোটিকেও ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে এমন ভাবনা উদয় হওয়ার পিছনে কারণ কি? এমন জিজ্ঞাসায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে বিপদে পড়ে সেই একমাত্র বিপদটা আঁচ করতে পারে। এদেশে করোনা পরিস্থিতি তেমন আশঙ্কাজনক নয়। মানুষ অন্যদেশের মতো রাস্তায় মৃত্যুবরণ করছে না। অনেকেই সুস্থ হচ্ছে। আর যারা খুবই জটিল রোগী তারাই কেবল মৃত্যুবরণ করছে। সেটাও হাসপাতালে। ফলে করোনা রোগী সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। ফলে তারা করোনাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে না।
বিভিন্ন গণমাধ্যম চিত্রে দেখা যায় , ঢাকার আশেপাশে, রাজশাহী, রংপুর, চট্রগ্রাম বা ময়মনসিংহ ছাড়াও দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের গ্রামীণ পর্যায়ের দিকে তাকালে দেখা যায়, করোনা ছড়াতে যাতে না পারে সে জন্য সরকার ঘোষিত সামাজিক দুরত্ব সেখানে মানা হচ্ছে না। স্থানীয় বাজারগুলোতে কেউ মাস্ক ব্যবহার করছে না। করলেও শতকরা ৫% এর বেশি না। যেটা খুবই আশঙ্কাজনক। সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছে। করোনার শুরুতে আতঙ্ক ও সরকারের কড়াকড়ি পদক্ষেপের ফলে গ্রামীণ পর্যায় পর্যন্ত লকডাউন ও সামাজিক দুরত্ব মানা সহ মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল। ফলাফলে করোনা পরিস্থিতিকে আমরা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পেরেছি। কিন্তু বর্তমানের মানুষ সেটা মানছে না। ফলে এলাকাগুলোতে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখা যাচ্ছে।
গত ১৪ মে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে মানুষের বাড়ি যাওয়ার হিড়িক চোখে পড়ে। ফেরিতে জায়গা নেই, রশি বেয়ে, ঝুলে থেকেও মানুষ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। অত্যধিক মানুষের সমাগমে, গরমে কিছু মানুষ মারাও গেছে। আন্ত:নগর যানবাহন বন্ধ ছিল, কিন্তু মানুষ কোনো ভাবে শহরের বাইরে গিয়ে গাড়ি ধরে বাড়ি গেছে। পুলিশি বিশেষ নজর এড়াতে এই কাজ চলেছে রাতের বেলায়। এসবকিছুই যখন গণমাধ্যমগুলোতে দেখছে তখন তাঁরা ভাবছে করোনা ভাইরাস বলতে আসলে কিছু নেই। সব কর্তৃপক্ষের চালাকি। এভাবে মানুষের যখন বাড়ি যেতেই হচ্ছে তাহলে গণপরিবহন চালু কেন হচ্ছে না? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই বা বন্ধ করে কেন রেখেছেন? আব্দুল মালেক নামে একজন বলেই ফেলেন যে, কোথায় করোনা? এতো গ্রাম-গঞ্জে ঘুরলাম একটা করোনা রোগীও তো চোখে পড়লো না। করোনা নামে আপনারা শুধ ব্যবসা করছেন। মাস্ক আর ওষুধ ব্যবসায়িরা শুধু লাভ করছে। আর আমার মতো দিনমজুররা না খেয়ে মরছি।
কিন্তু বাস্তবতা একটু আলাদা। মে মাসের প্রথম দিকে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেলে লকডাউন পুণরায় ঘোষণা করা হয়। স্বাস্থ্য বিধি মেনে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া স্বাভাবিক চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কিন্তু ১৪ মে ঈদুল-ফিতরকে উপলক্ষ করে সবাই যে যার গ্রামের বাড়ির থেকে দিকে ছোটে। বছরখানেক সময় পর আপনজনের সাথে কিছু সময় কাটানোর এটিই একটি সুযোগ। তাই কেউ এই সুযোগকে কেউ ছাড় দিতে চায় নি। সরকারি নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে যে যেভাবে পেরেছে চলে গেছে। তারাই আবার ঈদের পর রাজধানীতে ফিরে এসেছে। এতে ভাইরাসটি কতটুকু ছড়ালো তার আন্দাজ করা না গেলেও তার একটু আধটু ফল দেখা যাচ্ছে, যেমন: সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতিদিন ৭০-৮০ জন করে করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। সংক্রমণের হার ৫০-৬০ শতাংশ।
এক গৃহিণী তাঁর অতি সাধারণ চিন্তায় বলছিলেন, বাজার-ঘাট, গাড়ি-ঘোড়া সব চলছে শুধু স্কুল-কলেজ চলে না। আপাতপক্ষে, তাঁর এ ছোট্ট বক্তব্যে পুরো বাংলাদেশের সাধারণ চিত্র উঠে আসে। অফিস-আদালত, আন্তঃনগর যানবাহন, হাট-বাজার সবই প্রায় স্বাভাবিকভাবেই চলছে। এক স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থীর পিতা রফিকুল ইসলাম বলছিলেন, ‘ছেলেকে তো ৫ বছর বাইরে রেখে পড়াশুনার খরচ চালাচ্ছি। শেষ সময়ে এসে চূড়ান্ত পরীক্ষার সময় লকডাউনে আটকে গেল সাকিব। পরীক্ষা শেষ করতে না পারায় একবছরের বেশি সময় ধরে বাড়িতে বসে আছে, চাকুরীর জন্য আবেদন ও করতে পারছে না। এদিকে তাঁর মেসের ভাড়া ঠিকই বহন করতে হলো। এখন দেখি ছেলের মধ্যে হাতাশাও জেকে বসেছে। যেখানে সবই প্রায় স্বাভাবিকভাই চলছে, সেখানে শুধু শিক্ষার্থীদের আটকে রাখাটা উপরমহলের কোনো একটা পরোক্ষ স্বার্থ সিদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করছে।’ প্রাইমারী থেকে শুরু করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর অব্দি এরকম লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী সরকারের ঘোষণার দিকে চেয়ে আছে যে কবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে। তবে বর্তমানে এটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে এবং তা বাস্তবায়নে আসার পথেই রয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলার ব্যাপারে কর্মকর্তারা বেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় রেখেছেন যদিও এসব খুলে দেওয়ার ব্যাপারে সরকার পক্ষ বা অন্য মহল থেকে সরাসরি কোনো বক্তব্য আসেনি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হচ্ছে, ১. সংক্রমণের হার কমলেও এখনো রোগী পাওয়া যাচ্ছে ২. ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সনাক্তের পর একটি ধাক্কার আশঙ্কা আছে ৩. শিশুরা আক্রান্ত হলে দায় কেউ নেবে না ৪. অভিভাবকদের মধ্যে এখানোও আতঙ্ক আছে ৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কতটা স্বাস্থ্য বিধি মানা হবে তা পরিষ্কার নয় ৬. অনেক দেশেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে আবার বন্ধ করা হয়েছে ৭. অনেক দেশেই সংক্রমণ এখনোও বাড়ছে।
তবে বৈশ্বিক অবস্থা ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, পরিস্থিতি যেহেতু স্বাভাবিক আছে সেজন্য শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মণি আগামী ১৩ জুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এটি বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা যায়। তবুও করোনা যেহেতু পুরোপুরি নির্মূল করা যায় নি তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা সবার অবলম্বন করা জরুরি। অন্যথায় এর তৃতীয় ধাক্কা আসতে পারে।
আমাদের বিশেষ করে গ্রামীণ ও তৃণমূল জনগোষ্ঠির মধ্যে একধরণের অসহযোগীতাপূর্ণমনোভাবের তৈরীর আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দিন আসে দিন খায়। করোনা যে তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে বাধার আরোপ করেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাইরে না বের হলে, কাজ না করলে তাদের যে না খেয়ে দিন পারতে হয় সেটা সবার জানা বিষয়। শিক্ষার্থীরা পড়া-লেখায় দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে, মাদকাসক্ত বা আধুনিক ডিভাইজে আসক্তির পরিমাণটাও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতের একটি প্রজন্ম হুমকির মুখে পড়ছে। নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ নিয়ে তারা তৈরী হচ্ছে। এদিকে লকডাউনে আমাদের সমাজের উঁচু শ্রেণীরা জমানো অর্থ দিয়ে বেশ ভালোই চলতে পারলেও গরীবরা তা পারছে না। জীবন ধারণের জন্য তাদের বাইরে বের হতেই হচ্ছে। ফলে করোনাকে তারা ভয় পাচ্ছে না পাত্তা দিচ্ছে না। গুজব বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে।
সবশেষে দেখা যায়, করোনাকে গুজব না ভেবে মহামারী ভাবাটাই যুক্তিযুক্ত। আর এই ভাইরাসটির সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের কোনো অস্ত্র নিয়ে নামতে হবে না। দরকার সচেতনভাবে নিজে থেকেই করোনা প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নেওয়া। সংক্রমণ রোধে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে একটি বড় চ্যালেঞ্জ দাঁড়াবে স্বাস্থ্য বিধি মানার। আর যদি শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত হতে থাকে তবে পরিস্থিতি যে ঘোলাটে হবে, সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছে। তাই অভিাভবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মী ও অন্যান্যদের সবচেয়ে বেশি সচেতন হওয়া দরকার এবং শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বাড়াতে তাদের অনুপ্রেরণা দরকার। আর গত কয়েকদিন আগের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে কঠোরতা মানা জরুরি। তাহলেই সুদিন আসার অপেক্ষার প্রহর গোণা শেষ হবে।
লেখক:
জনস্বাস্থ্য গবেষক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স এসোসিয়েটস্ ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট।
নিবন্ধ তৈরিতে গবেষণা সহায়তা দিয়েছেন মো. জহুরুল ইসলাম, কমিউনিকেশন ম্যানেজমেন্ট অফিসার, এমিনেন্স এসোসিয়েটস্ ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ।