|| ড. এনায়েত করিম ||
উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করাসহ পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর জন্য আলাদা একটি বিষেশায়িত বিশ্ববিদ্যালয় এখন সময়ের দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনে এমনতর বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও বাংলাদেশে এ ধরনের বিষেশায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেই এখন পর্যন্ত। ফলে এ দেশের পুলিশ সদস্যরা বঞ্চিত হচ্ছেন উচ্চশিক্ষার সুযোগসহ তাদের পেশাগত দক্ষতা অর্জনের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ থেকে।
এ নিয়ে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সংক্ষোভ থাকলেও সার্ভিস রুলের কারণে তারা মুখ খুলতে পারছেন না। সেনাবাহিনীর মতো পুলিশ বাহিনীতে চাকরি পেতে বা পেশা হিসেবে পুলিশ বাহিনীকে বেছে নিতে কোন প্রাক-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ বাংলাদেশে এখনও চালু হয়নি। যারা পুলিশের চাকরিতে একবার ঢুকেছেন, তাদের জন্য নিজ বাহিনীর মধ্যে তেমন কোন উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায়, একদিকে যেমন তাদের দক্ষতা বাড়ছে না, তেমনি তারা নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারছেন না স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করে। যদিও বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য সংখ্যা এখন দুই লাখের বেশী।
বর্তমান আধুনিক বিশ্বে অপরাধের ধরন ও প্রকৃতি যেমন প্রতিনিয়ত পাল্টাচ্ছে, তা শনাক্ত করতে প্রয়োজন পড়ছে তেমনই নতুন নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি। কিন্তু পুলিশের দক্ষতা বাড়াতে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ বা জ্ঞানার্জনের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ না থাকায় তারা হাতে কলমে নতুন নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে পারছে না। যদিও কোন প্রশিক্ষণ নিতে হয়, তাহলে যেতে হয় দেশের বাইরে। ফলে বাংলাদেশ পুলিশ প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে পিছিয়ে পড়ে রয়েছে ব্যাপকভাবে, যা মোটেই কাম্য হতে পারে না। তাই পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে কথা হয়েছিল পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ (এমপি) এর সাথে। আলাপকালে তিনি বলেন, যারা পেশা হিসেবে পুলিশকে বিছে নিতে চান, তাদের জন্য ক্রিমিনোলজি, সাইবার ক্রাইম ও আইন বিষয়ে বিশেষায়িত পড়ালেখার জন্য পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ভীষণ জরুরী। আমি সরকারকে বর্তমান পুলিশ প্রশাসনের তত্বাবধানে অবিলম্বে একটি পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুরোধ জানাই।
তিনি আরো বলেন, সাইবার ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে নতুন আইন প্রনয়ণ করা হলেও বাংলাদেশ পুলিশ এসব আইনের প্রয়োগ ও ব্যবহার সম্পর্কে খুবই সামান্য ধারনা রাখেন, যে কারণে অনেক মামলার প্রতিবেদন দাখিলে দেরি হয় বা ত্রুটিপূর্ণ প্রতিবেদন দাখিল করার কারণে মামলার বিচার কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। অপরাধ তত্ত্ব ও ক্রিমিনাল আইনে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থাকলে পুলিশকে এ ধরনের মামলা পরিচালনায় কোন ধরনের বিপত্তিতে পড়তে হবে না।
কথা হয়েছিল সাবেক আইজিপি এ কে এম শহিদুল হকের সাথে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর জন্য একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষার অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কিন্তু পুলিশের জন্য কোন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। আমি পুলিশ প্রধান থাকতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজারবাগ পুলিশ হোডকোয়ার্টারে একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের মৌখিক অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু জায়গার সংস্থান না থাকায় তা সম্ভব হয়নি।
শহিদুল হক আরো বলেন, আমি মনে করি বাংলাদেশ পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তার আওতায় মেডিকেল কলেজ, কারিগরি ও আইন অনুষদ প্রবর্তণ করা হলে বাংলাদেশ পুলিশকে একটি আধুনিক পুলিশ বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব, যা প্রতিযোগিতামুলক বিশ্বের কাছে প্রসংশনীয় হবে।
আধুনিক অর্থনীতি বিনির্মাণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় পুলিশকে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হয়, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও দক্ষতা না থাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংকট মোকাবেলায় পুলিশকে সমস্যায় পড়তে হয়। এসব নতুন নতুন বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকলে পুলিশ আরও আধুনিক সেবা নিয়ে জনগনের দোরগোড়ায় হাজির হতে পারতো বলে মনে করেন শহিদুল হক।
আমার মতে, দেশের অর্থনীতি রক্ষা ও উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পুলিশকে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ জানে না অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে তাদের করনীয় কি? অপরাধ দমনের বাইরে জনগন ও দেশের অগ্রগতিতে ভূমিকা পালন করতে কি করা উচিত, পুলিশ সেসব বিষয়েও অনভিজ্ঞ। সেজন্য দরকার উচ্চ শিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতার উৎকর্ষ। আর এই উৎকর্ষ সাধন সম্ভব, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে।
আমি ভারতের সরদার ভল্লবভাই প্যাটেল ইউনিভার্সিটি অব পুলিশ সিকিউরিটি এন্ড ক্রিমিনাল জাস্টিসে অতিথি শিক্ষক হিসেবে নিয়মিত পড়িয়ে থাকি। তারা পুলিশ কর্মকর্তাদের পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে যেভাবে উচ্চশিক্ষা দিয়ে থাকেন, সেটাও আমরা অনুসরন করতে পারি। ভারতে এমন আরও একটি পুলিশ একাডেমি রয়েছে। ওই একাডেমির ডিগ্রি ছাড়া কোন পুলিশ কর্মকর্তাকে এসপির উপরে পদোন্নতি দেয়া হয় না। তাই বাংলাদেশ এমন নীতি চালু করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বঙ্গবন্ধু গবেষনা একাডেমির নির্বাহী পরিচালক ড. আনোয়ারুল করিম সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকলে বিভিন্ন পেশার মান বাড়ানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশ প্রায় ১৮ কোটি মানুষের একটি জনবহুল দেশ। এই বিশাল জনগোষ্ঠির নিত্য নতুন সংঘঠিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা এবং পুলিশকে সত্যিকার সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে একটি পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কোন বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, বর্তমানে সর্বস্তরের পুলিশ সদস্যদের জন্য বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ও ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য পুলিশ ষ্টাফ কলেজ ছাড়া বাংলাদেশে উচ্চতর কোন পুলিশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। সাম্প্রতিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিমিনোলজি বিষয়ে পড়ানো হলেও এ বিষয়ে ব্যাপক উচ্চশিক্ষা লাভের কোন সুযোগ বাংলাদেশে নেই। তাই অবিলম্বে বাংলাদেশ পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ জরুরী বলে মনে করি।
আনোয়ারুল করিম পুলিশের একটি শক্তিশালী গবেষনা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উপরও গুরুত্ব দেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সহজতর হবে বলে তিনি ধারণা করেন।
দেশে ১৮ কোটি জনগনের নিরাপত্তা দেয়ার বাইরেও পুলিশকে বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়, কিন্তু উচ্চশিক্ষা, দক্ষতা ও আধুনিক জ্ঞান না থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ আশানুরুপ সাফল্য দেখাতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কোন বিকল্প নেই।
পেশাগত উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে পুলিশ স্টাফ কলেজের রেক্টর ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ড. মো. নাজিবুর রহমান বলেন, পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বর্তমানে সর্বস্তরের পুলিশ সদস্যদের প্রাণের দাবি। উচ্চ শিক্ষার স্বদিচ্ছা থাকা সত্বেও অনেক পুলিশ সদস্য সুযোগের অভাবে তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে বঙ্গবন্ধু পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি কামনা করছি। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা গেলে শুধু বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যরাই পড়ালেখার সুযোগ পাবেন না, বরং দেশি-বিদেশি সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিবর্গ এবং ছাত্র-ছাত্রীরাও উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পাবেন। এতে ভবিষ্যতে পুলিশে দক্ষ জনবল তৈরী নিশ্চিত হবে।
লেখক: ডক্টর এনায়েত করিম, প্রেসিডেন্ট, গ্লোবাল ইকোনমিস্ট ফোরাম