|| মীর আব্দুল আলীম ||
কয়েক শত মানুষ জীবন্ত আগুণে পুড়ে মারা যাবার পরও পুরনো ঢাকা থেকে কেমিকেল গোডাউন সরানো যায়নি। শত নির্দেশনাও কাজে লাগেনি। তাই আবারও সেই পুরনো ঢাকার কেমিকেল গোডাউনে আগুন লেগে কলামটি লেখা পর্যন্ত (২৩শে এপ্রিল ২টা) নারীসহ মারা গেছে ৪ জন। দগ্ধ হয়েছেন অন্তত ২১ জন। শুক্রবার ভোর সাড়ে ৩টায় রাজধানীর পুরান ঢাকার বংশালে বাবুবাজার ব্রিজ সংলগ্ন আরমানিটোলা খেলার মাঠের পাশে একটি ছয়তলা ভবনে এই আগুন লাগে।
এতো কিছুর পরও সচেতন হয়না সংশ্লিষ্ট মানুষগুলো। আর সচেতন হবেই বা কেমন করে। এ যে জান জীবনের সংস্থান। তবে যার বেশী উদ্যোগি হওয়ার কথা সেই রাষ্ট্রই তো এখনো দায় সারতেই ব্যস্ত। তাই কেমিকেল গোডাউন পুরনো ঢাকা থেকে সরেনি। হয়তো সরবেও না। কেমিকেল গোডাউন ঢাকা শহর থেকে সরানোর দরকার নেই। বরং পুরনো শহরের মানুষগুলো সরিয়ে বনজঙ্গলে নিয়ে যাওয়াই ভালো। মানুষের জীবনতো বাঁচানো চাই!
তাতে মানুষ নিরাপদ হবে; ঝামেলা চুকে যাবে।

চকবাজারে যা ঘটেছে সেই ২০১০ সালে নিমতলীতে একই ঘটনা ঘটেছিল। তখন ১২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ওই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিলে চকবাজারে পুনরাবৃত্তি হতো না। শত অঙ্গার হওয়া লাশ আর আমাদের দেখতে হতো না। নিমতলির মর্মান্তিক ঘটনার পর কেমিকেল গোডাউনগুলো সরনোর দাবি ওঠে। সরকারও নড়ে চড়ে বসে। শোক শেষ হলে বেমালুম ভুলে যায় সবাই।
গোডাউন সরেনি বরং ফুলে ফেঁপে গোডাউনের সংখ্যা বেড়েছে। লাইসেন্স দেয়া হয়েছে নতুনদের। তাই যা হবার তাই হয়েছে। ফি বছর অঙ্গার হচ্ছে মানুষ। মানুষের পোড়া হাঁড়, মাংসের গন্ধে গোটা বাংলাদেশের হৃদয় দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে তবুও সংশ্লিষ্টদের হৃদয়ে তা নাড়া দিচ্ছে না।২৩শে এপ্রিল পুরনো ঢাকার ৬তলা যে ভবনে আগুন লাগে সেটাতে গোডাউন এবং আবাসিক এ্যাপার্টমেন্ট অপরিকল্পিতভাবে গড়া বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্ট ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা।
আমরা সব ভুলে যাই। এবারের আরমানিটোলা খেলার মাঠের ছয়তলা ভবনে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে তাও ভুলে যাবো। ভোলারাম বাঙালী বলে কথা! মানুষ শোক ভুলবে; সরকার কর্তব্য করতে ভুলবে। আবারও পাশের কোন গোডাউনে আগুন লাগবে। আবারও মানুষ মরে কয়লা-কাবাব হবে। মানুষের জীবনের কি আর দাম আছে? থাকলে ব্যস্ত এলাকা থেকে কবেই গোডাউনগুলো সরে যেত। নিমতলী ট্রাজেডির পর গোডাউন সরানোর প্রকল্প বাস্তবায়নে ১০ বছর সময় লাগতো না। এভাবে একের পর এক মানুষ অঙ্গার হতো না।
আসলে এ দায় কার? এর সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারবে না। আসলে আমরা নির্লজ্জ অসভ্য জাতি। আমাদের বোধদোয় হয় না কখনো। দায়িত্বশীলরা দ্বায়িত্ব পালন করে না। তাই আমরা লাশ হই রাস্তা ঘটে, বসত ঘরে কর্মস্থলে।
কোথাও একদন্ড নিরাপত্তা নেই আমাদের। সেই ২০১০ সালে নিমতলীর ঘটনার পর যদি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হতো। আবাসিক এলাকা থেকে কেমিকেল গোডাউন সরিয়ে
শহরতলিতে স্থানান্তর হতো তাহলে দগ্ধ হয়ে হতাহত হবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না মোটেও। ঢাকা থেকে কেমিকেল গোডাউনগুলো সরানোর কথা কেরানীগঞ্জে। কেরানীগঞ্জ বিসিক কেমিকেল পল্লীর কি খবর? পত্রিকান্তে জানলাম, ১১ বছরেও মেলেনি জমি। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১০ সালে কিন্তু অনুমোদন ২০১৮ সালে। আমাদের দুর্ভাগ্য বলতে হয়। ১০ বছরে প্রকল্প অনুমোদন আর বাস্তবায়ন কোনটাই হয়নি। পুরান ঢাকায় ছড়িয়ে আছে ৪ হাজার কেমিকেল গুদাম ও কারখানা।



ঘিঞ্জি পুরনো ঢাকার শহরটাতে কেমিকেল কারখানা ভাবা কি যায়? এটা বাংলাদেশেই সম্ভব। কেরানীগঞ্জে কেমিকেল পল্লী স্থাপনের জন্য আট বছরেও জমি অধিগ্রহণ হয়নি। ২০১৮ সালে একনেকে অনুমোদনের পর গত জানুয়ারিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রকল্প পরিচালক। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ না দেয়ায় এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। বরাদ্দ পেলে জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা করছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)।
আল্লাহই জানে গোডাউনগুলো সরানোর কাজ কবে শেষ হবে। আগে মানুষ কয়লা হয়েছে ১২৪ জন এবার শতাধিক ছাড়াবে। এর পর কিছু না ঘটুক। ঘটলে হয়তো প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে পারে।
নিমতলী থেকে চকবাজোরের চুড়িহাট্টার ট্র্যাজেডি পর্যন্ত কয়েক বছরে মন্ত্রী, মেয়র, সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা দফায় দফায় গুদাম সরানোর ঘোষণা, আশ্বাস ও নির্দেশ দেন। সব নির্দেশ অকার্যকর ছিলো। পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে থাকা ৪ হাজার কেমিকেল প্রতিষ্ঠানগুলো ছিলো বহাল তবিয়তে। নিমতলির ঘটনার পর তৎকালনি বাণিজ্য মন্ত্রী কেমিকেল গোডাউনগুলো শহর থেকে সরিয়ে নেয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন। নিমতলীর ঘটনার সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারে শিল্পমন্ত্রী ছিলেন দিলীপ বড়ুয়া। সে সময় তিনি অবৈধ রাসায়নিক ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো এবং এসব স্থানান্তরের কথা বললেও বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
তখন মহাজোট সরকারের সাবেক এই শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু গুরুত্বের সঙ্গে নিলে হয়তো এতদিনে পুরনো ঢাকার কেমিকেল গোডাউন সরানো সহজ হতো। আসলে দোষাদোষীর বাংলাদেশ। সবাই সবার দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে রেহাই পায়। দিলিপ বড়ুয়া যেমন আমির হোসেন আমুর উপর দোষ চাপিয়ে বেশ বাহবা নিয়েছেন।
আসলে সবাই বড় বড় কথা বলেন কাজ করেন না। সব কাজেই শেষ পর্যন্ত কেন জানিনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই সরব হতে হয়। হতে হয় উদ্যোগী । তাহলেই সেটা হয়। দেশকে মাদকমুক্ত করতে তাঁকেই হুঙ্কার দিকে হয়। ভেজালের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকেই কথা বলতে হয়। তাহলে অন্যরা কি করেন?



আমরা সোচ্চার নই, প্রশাসন কঠোর নয় বলেই বারবার মর্মান্তিক ঘটনা দেশবাসীকে দেখতে হচ্ছে। ঢাকাকে বাসযোগ্য ও নিরাপদ করতে সোশ্যাল করপোরেট রেসপনসিবিলিটি যেভাবে গড়ে ওঠার কথা, তা সেভাবে হয়নি। আর যারা স্টেকহোল্ডার আছেন, তারাও সরকারকে বাধ্য করতে পারেননি। ভবন মালিকদেরও দায় আছে। তারা বেশি ভাড়া পাওয়ার জন্য গোডাউন (রাসায়নিকের জন্য) ভাড়া দেয় এবং ব্যাপারটি লুকিয়ে রাখে। রাসায়নিকের মজুতের সনদ দেওয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সিটি করপোরেশনকেও আরও কঠোর হওয়া উচিত।
প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই কি সব উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে? নিমতলীর ভয়াবহ ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ে সরকার চাপের মুখে পড়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে তখন পুরনো ঢাকায় ৮শ’র বেশী বেশি অবৈধ রাসায়নিক গুদাম এবং কারখানা চিহ্নিত করে সেগুলো কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি এবং পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়।
পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনকারী আবু নাসের খান বলছিলেন, পুরনো ঢাকায় যত্রতত্র রাসায়নিক দ্রব্যের কয়েক হাজার গুদাম, কারখানা বা দোকানের বেশির ভাগের নিবন্ধন বা লাইসেন্সসহ কোনো কাগজপত্র নেই। এসব ব্যবসায়ী এবং তাদের সহায়তাকারী স্থানীয় লোকজনের ভোটব্যাংক রয়েছে এবং তাদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কর্তৃপক্ষ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয় না বলে তিনি মনে করেন। তারা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিভাবেও শক্তিশালী এবং এই এলাকার ভোটব্যাংক হিসাবে নানাদিকে প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে রসায়নিক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যায় না।



এছাড়া ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বা পরিবেশ অধিদফতর তারাও সেভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা এসব ব্যবসার লাইসেন্স দেয় বা তদারকি করে, তারাও সেটা সঠিকভাবে করেনি। এরাও দায়ী।
২০১০ সালে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর এ ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে নগর পরিকল্পনাবিদ, নগর বিশেষজ্ঞ, স্থপতিসহ সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে পুরনো ঢাকাকে আধুনিকভাবে ঢেলে সাজানোর জন্য ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্টের উদ্যোগ নেয় রাজউক।
প্রাথমিকভাবে বকশীবাজার, চাঁদনীঘাট, চকবাজার, মৌলভীবাজার, পুরাতন জেলখানা এলাকা, ইসলামবাগ, রহমতগঞ্জ ও বাবুবাজার এলাকায় তা বাস্তবায়নের চিন্তা করে। মাঠ পর্যায়ে জরিপ চালানোর পর ২০১৬ সালে পাইলট প্রকল্প হিসেবে বংশালের দুটি এলাকাকে রিডেভেলপমেন্ট করার সিদ্ধান্ত হয়। শুরু হয় ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে মতবিনিময়।
রাজউক এলাকাবাসীকে রিডেভেলপমেন্টের বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করে। অনেকে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানান। কেউ কেউ দ্বিমত করেন। পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের মতামত চায় রাজউক। ২০১৭ সালের ১৪ই অক্টোবর রাজউক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল মেয়র সাঈদ খোকনের
সঙ্গে মতবিনিময় করে প্রকল্পের যৌক্তিকতা তুলে ধরে। মেয়রও এ উদ্যোগের প্রশংসা করেন।
তবে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে সভা করে এলাকাবাসীর মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পরে আরমানিটোলায় পুরনো ঢাকার বাসিন্দা, স্থানীয় পাঁচটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও রাজউকের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সভা হয়। সভায় কিছু বাসিন্দা রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের বিষয়ে রাজউকের ওপর আস্থাহীনতার কথা জানান। কেউ কেউ যেভাবে আছেন, সেভাবেই থাকতে চান।



এলাকাবাসীর বেশিরভাগ মতামত রাজউকের বিরুদ্ধে গেলে স্থগিত হয়ে যায় রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের কার্যক্রম। এ জন্য দায়টা কিন্তু স্থানীয়দেরও আছে। স্থানীয়দের মধ্যে অর্থ আর সম্পদেও লোভ কাজ করে। তাঁদের বোঝানো না গেলে বাধ্য করতে হবে। মানুষের জীবন বলে কথা। শহরকে নিরাপদ করতে হলে যা যা দরকার তাই করা উচিৎ।
চকবাজারের আগুনের পর একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যায়নি। দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায়নি।
ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট করলে রাস্তাও প্রশস্ত হতো, আগুন নেভানোর পানিও পাওয়া যেত। অ্যাম্বুলেন্সও দাঁড়াতে পারত। মুষ্টিমেয় কিছু লোকের কারণে এটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। অথচ রিডেভেলপমেন্ট ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতেই হবে। আমরা আর কোন অস্বাভাবিক মৃত্যু চাই না। সরকার আমাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।