|| চৌধুরী জহিরুল ইসলাম ||
লেখাটির শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘বেহায়ার বিদায়’। কিন্তু স্ত্রী কাজে যাবার মুহূর্তে নীচতলায় দরজা আটকানোর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি সূর্য উঁকি দিচ্ছে একটি নতুন দিনের জন্য। তাই শিরোনাম বদলে দিলাম। আর লেখাটির ধরণও পাল্টে গেলো। শত্রুতাকে ভুলে একটি নতুন দিনের প্রত্যয়ে আমিও নিজেকে সিক্ত করলাম। যা ঘটে গেছে, তা অতীতের অভিজ্ঞতা কিংবা ক্ষত হয়েই টিকে থাক।
অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেলো। টেলিভিশনের পর্দায়, রেডিও কিংবা অনলাইনের সংবাদে সে সব দেখছি, শুনছি অথবা পড়ছি। লেখার সময় পাই না একেবারে। অনুভূতিও অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। লেখার সময় না পাওয়ার কারণ এই করোনার আবহে নতুন ব্যবসায় মন দিয়েছি।
বাংলাদেশে যেমন আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘাতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়, এখানেও অনেকটা তেমন। তার উপর রিপাবলিকান পার্টির আদর্শহীনতার সুযোগে ট্রাম্পের নেতৃত্বে বর্ণবাদী সংখ্যালঘিষ্ঠরা কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। আমাদের দেশে অনেকটা বিএনপির ঘাড়ে জামাতি বোঝার মত!
মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ৬ই জানুয়ারি আমেরিকার ইতিহাসে যে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হলো, তার মূলে কিন্তু এই দলবাজী। ডেমোক্রেট-রিপাবলিকান শত্রুতা! জনগণ দেখেছে- ক্যাপিটল হীলে রিপাবলিকান হ্যা বললে, ডেমোক্রেট না, আবার পাল্টাপাল্টি!
নাইন এলিভেন (২০০১)-এর পর এসব দেখতে দেখতে সাধারণ মানুষ ত্যক্ত বিরক্ত! তার উপর অনৈতিক ইরাক, আফগান যুদ্ধ! আমেরিকার নৈতিক অবস্থানকে এমনিতে তলানিতে নামিয়ে দিয়েছিল। এরই বহিপ্রকাশ ঘটেছে ৬ই জানুয়ারির অক্রমণে!
আমেরিকার মসনদে কে এলো, কে গেলো, তা নিয়ে আমাদের কিছু আসে যায় কি-না? যায়। ঠিক একবছর আগে আজকের এই দিনে আমেরিকায় প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। আজ সে সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২ কোটি ৪০ লাখ। আর মারা গেছে ৪ লাখ।
এই মারণঘাতি ভাইরাসকে যিনি শুরু থেকে অস্বীকার করেছেন তিনি ডনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বিজ্ঞানকে অস্বীকার করেছেন। মানুষের জীবনকে তাচ্ছিল্য করেছেন। যে সব পরিবার তাদের স্বজন হারিয়েছে, তাদের সমবেদনা দেখানোরও প্রয়োজন মনে করেননি এই প্রেসিডেন্ট!
‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায়’! শত জাতি, ভাষা-সংস্কৃতির আমেরিকায় বিভেদের বিষকে যিনি ক্ষণে ক্ষণে উস্কে দিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ইতিহাসের আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনেছেন বর্ণবাদকে। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার বদলে শুরু থেকেই প্রশ্রয় দিয়েছেন বিভক্তিকে!
সর্বশেষ গণতন্ত্রের কবর রচনা করতে চেয়েছিলেন নির্বাচন ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে। গত ৬ই জানুয়ারি একদল অনুসারিকে ক্যাপিটল হিলে আক্রমণে উৎসাহিত করেছিলেন। জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করে অন্তত ৬২টি মামলা করে সবগুলোতে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। তাই তিনি বেহায়া।
দেড় শ’ বছর আগে আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন- গণতন্ত্র নিঃশেষ হয়নি। গতকাল বাইডেনও তার অভিষেকের বক্তৃতায় আবার বললেন- নিঃশেষ হয়নি। সেদিনও জাতি ছিল বিভক্ত। গৃহযুদ্ধের পর্ব শেষ করে আমেরিকা সবে উঠে দাঁড়িয়েছিল।
বাইডেন ভালো বক্তা নন। ক্লিনটন, ওবামা, ট্রাম্পের মত কথার ফুলঝুরি থাকে না তার বক্তৃতায়। তবে যে কথা তার মুখ থেকে বের হয়, সেটা হৃদয় নিংড়ানো। গত ৪৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে বাইডেন সে প্রমান রেখেছেন।
আজকের জার্মান জাতি এবং তাদের সুশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দেখে কে বিশ্বাস করবে যে, মাত্র ৮০ বছর আগে সেই দেশে হিটলারের মত দানবের জন্ম হয়েছিল। তেমনি আমেরিকার ইতিহাসে যে ডনাল্ড ট্রাম্পের মত একটি বেহায়া আবির্ভূত হবে তাও কি কারো জানা ছিল?
মানুষ বেহায়া হয়, কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রপতি যে এমন বেহায়া হবে তা জানা ছিল না। অবশ্য পাড় ব্যবসায়ীকে কখনো বেহায়া হতে দেখা যায়। বলা হয়- civility is the key to civilization. কিন্তু ডনাল্ড ট্রাম্প কোন ধরনের সিভিলিটি দেখিয়ে বিদায় নিলেন?
চার বছর আগে এমন এক রাষ্ট্রপতিকে আমরা পেয়েছিলাম যার মধ্যে আমেরিকান নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ছিটেফোঁটাও দেখিনি। মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থা ও রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেও তিনি পুরো চার বছর কাটিয়ে গেলেন! দুই-দুইবার তাকে অভিসংশন করার পরও তার ‘হায়া’ হয়নি!
কারণ তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী। রাজনীতি আর ব্যবসার যখন সম্মেলন ঘটে, তখনই রাজনীতি পথ হারায়। নির্বাচনে তিনিই বিজয়ী, এই দাবি করেও মার্কিন জনগণের কাছ থেকে চাঁদা তুলেছিলেন! এই টাকার পরিমান- ২০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার!
নির্বাচনে হেরেও তার বোকা অনুসারিদের কাছ থেকে চাঁদা তুলেছেন। এই টাকা তিনি আবার ফিরে আসা পর্যন্ত ব্যয় করার সুযোগ পাবেন। ট্রাম্প একজন স্মার্ট ব্যবসায়ী। ব্যাংকের কাছে দেউলিয়া থেকেই তিনি সারা জীবন রাজার হালে কাটিয়েছেন।
সর্বশেষ চমকে যে টাকা তিনি তুলে নিলেন- তাতে ৬৬ একরের ফ্লোরিডার ‘মার-এ-লগো প্রাসাদে তার চার পুরুষ কিছু না করেই রাজার হালে জীবন কাটাতে পারবে! ট্রাম্পকে তাই আর যে যেভাবে দেখুক, আমি একজন ব্যবসায়ী ছাড়া আর কিছু দেখি না।
রাশিয়ার সহযোগিতায় ক্ষমতায় আসা এবং থাকা, কোনো কিছুতেই তিনি নীতি নৈতিকতার তোয়াক্কা করেননি। ক্যাপিটল হীলে কট্টর বর্ণবাদীদের লেলিয়ে দিয়ে আমেরিকার মান ইজ্জত ধূলোয় মিশিয়ে দিলেন, তাতে তার কী আসে যায়!
আমেরিকায় আজ নতুন দিনের সূর্য উদিত হলো। জো বাইডেনের নেতৃত্বে ইতিহাসে এই প্রথম একজন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট পেল আমেরিকা। শুধু নারী নয়, তিনি আফ্রিকান এবং ইন্ডিয়ান বংশোদভূত। লেখাটি যখন শেষ করলাম- তখন ভোরের সূর্য ডানা মেলতে শুরু করেছে। আমারও কাজে যাবার সময় হলো।
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসি