ধান কাটা ও কৃষি সংস্কারে গণচীনের অভিজ্ঞতায় শেখা

|| আলতাফ পারভেজ ||

এক.
ধানকাটায় লোকবলের সংকট দেখা দিয়েছে এবার। তাই শহুরে মানুষদের ধান কাটতে যাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছে এমুহূর্তে। জেলাশহর থেকে অনেকে যাচ্ছেনও গ্রামের দিকে। আজকের মত সংক্রমণদুর্যোগে না হলেও বাংলাদেশের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পরপর। তখন লোকবল সংকট বা রোগ সংক্রমণ ছিল না। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দলে দলে গ্রামে গিয়েছিলেন বীজতলা তৈরি, কৃষিকাজে অংশ নেয়া, খাল খনন ও ধান কাটায় অংশ নিতে।

ওটা ছিল একটা নতুন দেশ গড়ার অবিস্মরণীয় এক অনুপ্রেরণা থেকে। ১৯৭২-৭৩-৭৪ এর সেসব ঘটনা হয়তো বিশ্বাসও করতে চাইবে না আজকের তরুণ-তরুণীরা। কৃষকের বাড়িতেই শহুরে স্বেচ্ছাসেবীরা থাকতো তখন। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত এবং স্বয়ংম্ভর দেখতে চেয়েছিল।

কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নয় অন্তত নয়টি কলেজও এরকম উদ্যোগে শামিল হয়। জাহাঙ্গীরনগরের ভূগোল বিভাগ এক পর্যায়ে ষাট একর জমিতে কৃষিকাজই শুরু করে। এসব নিয়ে আগে লিখেছি। ইতিহাসের সেই অসাধারণ মুহূর্তটি দ্রুত হারিয়ে যায় এবং তড়িঘড়ি করে ‘শিক্ষা’ ও ‘উন্নয়ন’-এর পুরানো উপনিবেশিক পথে হাটতে শুরু করে স্বাধীন দেশটি।
শহুরে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের এসব তৎপরতা তখন যে কেবল বাংলাদেশে হচ্ছিলো– তা নয়। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে এরকম উদ্যোগ-উদ্দীপনা ছিল। এটা ছিল যার যার দেশে কৃষিবিপ্লবের আকাঙ্খাজাত। এই প্রেরণাটি তখন তৈরি হয়েছিল বিশেষভাবে চীন বিপ্লবের কিছু অভিজ্ঞতা থেকেও। মাও নিজেও ভুট্টা ও ধান কাটতে তখন গ্রামে গিয়েছিলেন। আগের লেখায় এ বিষয়টি উল্লেখ ছিল না– কেন মাও এসবে নেমেছিলেন। এটা কী কেবল ধান বা ভুট্টা কাটার সংকীর্ণ কোন রাজনৈতিক প্রচারমূলক কাজ ছিল– নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু– যা আজও বাংলাদেশের মতো দেশে বিবেচনাযোগ্য এবং প্রাসঙ্গিক? অতি সংক্ষেপে দু’চারটি কথা।

দুই.
চীনে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে বিপ্লবী পরিবর্তন শুরু হয় ১৯৪৯-এ, সেটা আমরা জানি। ১৯৫৮-এর দিকে মাও কৃষি উৎপাদন বাড়ানোকে গুরুত্বপূর্ণ এক কর্মসূচি হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। এ জন্য দেশজুড়ে ছোট ছোট জমিকে যুথবদ্ধ করা এবং কৃষি যন্ত্রাংশ শেয়ার করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। এর আগেই ভূমি পুনর্বন্টনমূলক সংস্কার এবং কৃষি সমবায়ের কর্মসূচিগুলো চালু হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫৩-৫৭ সময়ে ভূমি সংস্কারের মাঝেই সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন বাড়ে ৩.৫ ভাগ। কিন্তু মাও আরো উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছিলেন উৎপাদন বাড়াতে। তিনি কৃষিতে উদ্বৃত্ত-অবস্থা তৈরি করে গ্রামকে দ্রুত শিল্পায়নের দিকে নিতে চাইছিলেন।

কিন্তু যৌথ চাষাবাদ সম্পর্কিত মাওয়ের নতুন নিরীক্ষাগুলো ছিল সামন্ততান্ত্রিক কৃষিভিত্তিক চীনের জন্য তখনও অভিনব এবং অতি উচ্চাভিলাসী। কৃষিতে বিনিয়োগযোগ্য পুঁজির অভাব এবং কৃষি যন্ত্রাংশ আধুনিকায়নেও পিছিয়ে তখন চীন। ফলে মাঠ পর্যায়ে দ্বিধা-সংশয়-প্রতিক্রিয়া ছিল মাওয়ের আহ্বানের বিপরীতে। কমিউনগুলো এমনভাবে বড় করে ফেলা হয়েছিল যা ব্যবস্থাপনা সংকটও তৈরি করে। এসবের বিরুদ্ধে মাওয়ের সেই বিখ্যাত উক্তি চালু হয় তখন: ‘প্রথা ভেঙ্গে চিন্তা করো– সাহস করে কাজে নামো’। এসময়ই আবাদ উৎসাহ করতে মাও গ্রামে যেতেন এবং কৃষি কাজে অংশ নিতেন।

তবে এর মাঝেই ১৯৫৮-৫৯-এর ঐ ‘মহা উলম্ফন’ধর্মী কর্মসূচি খারাপ ফল দেয়। দেশটিতে ব্যাপক খাদ্য সংকট তৈরি হয় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বিপুল মানুষ মারা যায়। এই সংকটের পেছনে ১৯৫৯-এর বন্যা এবং উৎপাদনকে বিবেচনায় না নিয়ে রাশিয়া, আলবেনিয়া ও পূর্ব জার্মানিতে খাদ্য রফতানিও বড় কারণ ছিল। কৃষি-শ্রমশক্তির একাংশকে শিল্পে পাঠানোও বিপর্যয় বয়ে আনে। সবমিলে এটা ছিল মাও ও তাঁর দলের জন্য একটা বড় আকারের কষ্টকর ও ক্ষয়ক্ষতিমূলক শিক্ষা এবং দ্রুতই সেসব নির্মম শিক্ষা নেয়া হয়। মাও নিজে এ বিষয়ে আত্ম-সমালোচনা করেন। তবে এরপর থেকে চীনের পার্টি জাতীয় নীতি-কৌশলে ‘কৃষিকে প্রথম’ স্থানে নিয়ে আসে। কৃষি উপকরণের আধুনিকায়নের ওপর জোর দেয়া হয়। পুরানো ভূমি সংস্কারের মৌলিক দিকগুলো রক্ষা করা হলেও যৌথ চাষাবাদ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়। স্বতন্ত্র উৎপাদক ও বেসরকারি বাজারকে উৎসাহ দেয়া শুরু হয়। প্রায় দুই দশক এরকম সংস্কার চলে কৃষিকে ঘিরে এবং কেবল এভাবেই দেশটি শিল্পায়নের ভিত তৈরি করে।

বলা যায়, ১৯৫৮-৫৯ এ মাওয়ের সেই বিতর্কিত নিরীক্ষা গণচীনের কৃষি-ভাবনায় প্রচন্ড আলোড়ন তুলেছিল এবং শেষ বিচারে সেটাই চীনের অর্থনৈতিক জীবনকে আমূল পাল্টে দেয়।

তিন.
মাও সেতুং-এর এ কাহিনী পড়ে অনেকেই হয়তো ভাববেন বিষয়টি চীনে সমাজতন্ত্র নির্মাণকালীন একটা গল্প মাত্র। তাদের জন্য হয়তো আরেকটি লেখা দরকার হবে– কীভাবে কৃষি পটভূমির দেশে পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের জন্যও ভূমি সংস্কার জরুরি এবং কীভাবে সেটা ম্যাজিক তৈরি করে। তারই দৃষ্টান্ত আজকের চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশ। এরকম দেশগুলোতে কৃষি বিপ্লবই শিল্পায়নের প্রয়োজনীয় ভিত তৈরি করেছিল। কৃষিখাতের সংস্কার ছাড়া শিল্পায়ন যে একটা মায়া-মরীচিকা তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ আজকের বাংলাদেশ।

কিন্তু আমরা তো কিছু শিখবো না! না মাও সেতুং থেকে, না এডাম স্মিথ থেকে। আমরা চীন হতে চাই– তবে ধান ও ভুট্টা ক্ষেতে না নেমেই। আজকের চীন তৈরি হওয়া শুরু মাওয়ের ঐ ভুট্টা ক্ষেতে নামার পরের এবং আগের কৃষি সংস্কার থেকে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামে ভূমি সংস্কার ঘটেছিল মার্কিন সমর্থক সরকার দ্বারাই। বিপরীতে বাংলাদেশে ভূমি সংস্কার বিষয়টাই এখন আর শোনা যায় না।

আজকে বাংলাদেশে কৃষির যে সংকট সেটা শুধু ধান কেটে সমাধান হবে না। তবে ধানকাটতে যাওয়ার দরকার আছে। ধানকাটার সময় এবং ধান কাটার আগে-পরে কৃষকের সঙ্গে শহুরে মানুষদের যেটা বলা দরকার– অনুপস্থিত ভূমি মালিকদের থেকে জমিটা আবাদীদের হাতে দিতে হবে। লাখ লাখ একর খাসজমি তথাকথিত শিল্পপতিদের না দিয়ে ভূমিহীন কৃষকদের দেয়া দরকার ছিল।

ভাইরাস-দুর্যোগ কী আমাদের কিছু শেখালো– জাতীয় নীতিনির্ধারণে কৃষি সবার আগে থাকা দরকার নয় কী? খাদ্য নিরাপত্তাই কী সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা ইস্যু নয়? ১৯৭২-৭৪ এর ঐ তরুণ-তরুণীরা কী ঠিক কথাই বলেন নি?
আলতাফ পারভেজ, দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক ও গবেষক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন