|| মীর আব্দুল আলীম ||
চাল নিয়ে কি চালাকি হচ্ছে? বাজারে চালের দাম বাড়ছেই, সরকার বলছে সংকট নেই। চাল উৎপাদন এবং রেকর্ড উদ্বৃত্তের আশা অথচ বাজারে দাম বাড়ছে, হচ্ছে আমদানিও। আমদানির পরও কমছে না চালের দাম। ঘটনাটা কি? চালের বাজার কি ফের পড়লো সিন্ডিকেটের খপ্পড়ে? চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিলগুলো দাম বাড়িয়ে দেয়ার প্রভাব পড়েছে বাজারে। আর মিল মালিকরা বলছেন, ধানের সরবরাহ কম।
বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট পাঁচ মাসে আগে আভাস দিয়েছিলো যে, এ বছরের শেষে প্রায় সাড়ে ৫৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে, অথচ বাজারে সব ধরণের চালের দামই বেড়ে যাচ্ছে কেন?
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা বিবিসির সূত্রে জানা যায় খাদ্য সচিব নাকি বলেছেন, প্রথম চালানের ৫০ হাজার টন চাল ইতোমধ্যেই দেশে এসেছে। এছাড়া জানুয়ারির মধ্যে আরও অন্তত দেড় লাখ টন চাল বাংলাদেশে আসবে। তবে এ আমদানির সাথে বাজারে চালের দামের নাকি কোন সম্পর্ক নেই। কারণ ধান বা চালের কোনা সংকটই নেই। যদিও প্রত্যাশার চেয়ে উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে এ বছর। তারপরও সেটি খুব একটা বেশি নয় বলেই কোনো সংকট তৈরি হয়নি। তাহলে বাজারে চালের দাম বাড়ল কেন? এবারও কী চাল নিয়ে আকামটা সিন্ডিকেটই করলো!
চালের দামের উর্ধ্বগতিতে ভয়াবহ সংকটে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য বলছে, গত এক বছরে শুধু মোটা চালের দামই বেড়েছে কেজি প্রতি ৪৮ শতাংশ। বাজারেও বেসরকারি হিসেবে মোটা চালের দাম বেড়েছে একবছরে কেজি প্রতি কমপক্ষে ১৫ টাকা, তিন মাসে বেড়েছে ৬ টাকা। দেশে দৈনিক চালের চাহিদা ৯৪ হাজার মেট্রিক টন। আর সরবরাহ আছে ৮০ হাজার মেট্রিক টনের মতো। চালের দাম কমানোর ব্যাপারে সরকার সচেষ্ট। সরকারের কঠোর পদক্ষেপেও বাজারে চালের দাম কমেনি বরং আরও বেড়েছে। সরকারী কোন পদক্ষেপেই সিন্ডিকেট মুক্ত হতে পারছে না চালের বাজার। এ অবস্থায় চালের অসাধু ব্যবসায়ী, মজুদদার ও সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মূল্য নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত সাতটি মনিটরিং মাঠে রয়েছে। এর পরও সিন্ডিকেট মিল মালিকদের কারসাজি বন্ধ হয়নি। দাম বাড়ার কোন কারণ না থাকলেও অস্থির হয়ে উঠছে চালের বাজার। এদিকে আমদানির প্রভাব নেই চালের বাজারে। দেশের বাজারে আমদানি করা চালের বিক্রি শুরু হলেও তার প্রভাব মিলছে না বাজার দরে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন আড়তগুলোতে চালের দাম না কমে বরং প্রতি বস্তায় ৫০ থেকে ৭০ টাকা বেড়েছে। আমদানি করা এসব চালের মান ভালো না হওয়ায় আড়তদাররা এই সুযোগ নিচ্ছে বলে জানান চালের খুচরা বিক্রেতারা। ফলে এখনো চড়াই রয়েছে চালের বাজার।
কয়েক দফা শুল্ক কমিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কয়েক লাখ টন চাল আমদানি করা হলেও বাজারে এর তেমন কোনোই প্রভাব নেই। এর ফলে অসাধু চাল ব্যবসায়ীরাই লাভবান হয়েছেন কিংবা হচ্ছেন। বিশ্ববাজারে চালের দাম বাড়েনি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চালের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। বিপুল পরিমাণ চাল সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আমদানি করা হয়েছে। আরও আমদানি করা হচ্ছে। দেশে চালের কোনো রকম সংকট নেই। তাহলে চালের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না কেন?
চালের দাম কমানোর জন্য সরকারের নানা রকম উদ্যোগ আমরা লক্ষ করেছি। এর অংশ হিসেবে চালের আমদানি শুল্ক কমানো। এতে প্রতি কেজি চালের আমদানি খরচ ছয় টাকা কমেছে। কিন্তু তাতেও খুচরা বাজারে চালের দাম না কমে উল্টো অনেক বেড়েছে। চাল নিয়ে এই অনৈতিক কারসাজিকে হালকাভাবে নেয়ার অবকাশ নেই।
স্বেচ্ছাচারি কিংবা অসাধু ব্যবসায়ীরা যা করছে তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। চালের দাম আরও বাড়তে পারে, এমন গুজবও ছড়িয়ে দেয়া হয়। তাতে চালের দাম বাড়তে থাকে। যারা চাল নিয়ে চালবাজি করছে সরকার তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?
অনেকটা রহস্যজনকভাবে চালের দাম বেড়েছে। ২৫ টাকার চাল লাফাতে লাফাতে কোথায় উঠেছে? সরকার তাতে বিব্রত তা আমরা বুঝি। চালের দাম কমানোর জন্য সরকার মরিয়া হয়ে ওঠে। এর অংশ হিসাবে চালের আমদানি শুল্ক কমানো হয়। ফলে প্রতি কেজি চালের আমদানি খরচ ছয় টাকা কমেছে। কিন্তু তাতেও চালের দাম না কমে উল্টো অনেক বেড়েছে। এভাবে চালের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। প্রশ্ন হলো ‘এখানো কারা চাল নিয়ে খেলছে? যারা খেলাটা খেলেছে তাদের চিহ্নিত করে নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন? আমাদের দেশের মানুষের দুর্ভাগ্য যে, সব সময় কিছু অসাধু মানুষ, গরিব মানুষকে নিয়ে খেলে। এ খেলা আগে বন্ধ করতে হবে।
বলা বাহুল্য, বর্তমানে দেশের কোথাও এত বেশি চালের সংকট নেই। তবু এক ধরনের সংকট তৈরির অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। চাল নিয়ে এই অনৈতিক কারসাজিকে ক্ষুদ্রভাবে নেয়ার অবকাশ নেই। তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে।
এভাবে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। পত্রিকার খবরে জানা যায়, আমাদের দেশেই নাকি চালের দাম সবচেয়ে বেশি। এ নিয়ে বিরোধীদলও রীতিমত রাজনীতি শুরু করে দিয়েছে। চালের মূল্য বেশির দেশগুলোর মধ্যে আমাদের পরের স্থানই নাকি দখল করে আছে পাকিস্তান, যা বাংলাদেশের চেয়ে ১০ টাকা কম। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে সস্তায় চাল বিক্রি করছে ভিয়েতনাম।
প্রশ্ন হচ্ছে, চালোর দাম এভাবে বাড়ছে কেন? এই দাম বাড়ার গতি কি স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক? সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, হাওরে বোরো ধানের আবাদ নষ্ট হয়েছে। এ কারণে চালের দাম বেড়েছে। সরকারের তরফ থেকে চালের দাম বাড়ার খবরকে অস্বীকার করা হয়নি। তবে আমরা মনে করি, যথেষ্ট পরিমাণ চাল মজুত থাকলে হাওরের দুর্যোগের প্রভাব মোকাবিলা করা সরকারের পক্ষে কঠিন হতো না। চালের পর্যাপ্ত মজুত না থাকার জন্য বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়কে। অনেকে মনে করছেন, খাদ্যমন্ত্রী তার দায়িত্ব পালনে যে ব্যর্থতা দেখিয়েছেন তাতে তার পদত্যাগ করা উচিত।
আসলে এদেশে ভোক্তাস্বার্থ বলে কিছু নেই। যদি থাকতো তাহলে চালের বাজারে এমন অরাজক তৈরি হতো না। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের এমনিতেই কোনো ছলের অভাব হয় না। চালের ক্ষেত্রেও নানা কারণ তারা সামনে এনেছে। এবার চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাজারে মোটা চালই এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিতে। সরু চালের কেজি ৬০ টাকা ছাড়িয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে মোটা চালের দাম রেকর্ড ভাঙায় নিম্ন আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মোটা চালের কেজি ৪০ টাকা এবং সরু চাল ৫৬ টাকায় উঠেছিল। এদেশে চালের দাম বাড়ে, ডালের দাম বাড়ে, বেগুন, তেল লবণ চিনির দাম বাড়ে। কারণে বাড়ে, আকারণে বাড়ে। চালের দাম বেড়ে আকাশ ছুঁয়েছে। টিসিবির তথ্যমতে, গত এক বছরে দেশের বাজারে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪২.১৯ শতাংশ। মোটা চালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সরু চালের দামও। চালের বাজার বলতে গেলে বেসামাল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মোটা চালের দাম বেশি রেড়েছে। সরু চালের দাম বাড়লে উচ্চবিত্তের তেমন সমস্যা হয় না, যত আপদ বিত্তহীনদের ওপর। এভাবে কেন বাড়লো চালের দাম? এর অনেক ব্যখ্যা আছে। যে যার মতো করে ব্যখ্যা দিচ্ছেন। চাহিদা অনুপাতে চালের জোগান যে কম সে কথা বলা যাচ্ছে না। বাজারে চাল আছে। কেউ কেউ মনে করছেন, চালের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির পেছনে কারসাজি রয়েছে। চাল সিন্ডেকেট চক্রের হাতেই চালের মজুত রয়েছে। এরাই অব্যাহতভাবে চালের দাম বাড়িয়ে চলেছে।
এদিকে দেশে চালের দামের এই অব্যাহত বাড়ার কারণ স্পষ্ট করতে পারেননি খাদ্যমন্ত্রী। তবে চাল মিল মালিক সমিতির দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, মিলারদের চালের মজুদ শেষ হয়ে যাওয়া এবং চাল বিতরণ দফায় দফায় বাড়ছে চালের মূল্য। চালের দাম সাধারণ মানুষের মধ্যে রাখার জন্য খোলাবাজার সরকারি উদ্যোগে চাল নিয়ে কর্মসূচি বন্ধ থাকার কারণে চালের বাজারে বিরাজ করছে অস্থিতিশীলতা। হাওর অঞ্চলের দুর্যোগকেও চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। অথচ চলের বাজারে এর প্রভাব পড়ার কোনোই কারণ নেই বলেই মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। বাজারে নতুন ধানও এসেছে। এ সময় চালের দাম নেমে আসে। এরপরও দাম কেন বাড়ছে?
আমরা মনে করি, চালের বাজার এবং চালবাজদের ব্যাপারে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। বিত্তহীনদের স্বার্থে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চালের দাম কমিয়ে আনার দিকে নজর দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অতি মুনাফাখোর লোভী ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। কেবল মুখে মুখে নয়, চালের বাজার কারসাজিতে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। ভাতনির্ভর দেশের মানুষ যদি চাহিদামতো চাল কিনতে না পারে তবে এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে? তাই সরকারের উচিত, যে কোন মূল্যে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। আমরা এ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান চাই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।