চাবাহার বন্দর প্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ দিলো ইরান

আঞ্চলিক রাজনীতিতে অনেক মোড়-পরিবর্তন ঘটছে; শুরু হয়েছে সম্পর্কের ভাঙ্গাগড়া। ইরান তার চাবাহার বন্দর প্রকল্পের একাংশ থেকে ভারতকে বাদ দিয়ে দিল হঠাৎ।

|| আলতাফ পারভেজ ||

আঞ্চলিক রাজনীতিতে অনেক মোড়-পরিবর্তন ঘটছে; শুরু হয়েছে সম্পর্কের ভাঙ্গাগড়া। ইরান তার চাবাহার বন্দর প্রকল্পের একাংশ থেকে ভারতকে বাদ দিয়ে দিল হঠাৎ। ভারতের বিদেশনীতিতে ইরানের এই সিদ্ধান্ত বড় ধরনের এক হোচট হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও ঘটনার তাৎপর্য আরও বেশি কিছু।

ইরানের সিদ্ধান্তের গভীরতা ও ব্যাপ্তি বিপুল। এই সিদ্ধান্তের বড় প্রতিফলন ঘটবে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক উত্থান-পতনেও। চাবাহার প্রকল্পের সঙ্গে কাবুল বিশেষভাবে সম্পৃক্ত। ইরানের এই সিদ্ধান্তে স্পষ্টত চীন-পাকিস্তানের উল্লসিত হওয়ার কারণ ঘটেছে। পাকিস্তান-চীন অর্থনৈতিক করিডোর এবং পাকিস্তানে চীনের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের বিকল্প ভাবা হচ্ছিলো চাবাহারকে। ভারতের ভাষ্যকাররা সর্বশেষ এই ঘটনাকে বলছেন ‘এক বড় ক্ষতি’। সিদ্ধান্তটি ইরানের হলেও মনে হচ্ছে চীন-ভারত রেষারেষির গভীর যোগাযোগ আছে তাদের ঘোষণায়।

চাবাহার প্রকল্প ও ভারত

চাবাহার দক্ষিণ ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বন্দর। পাকিস্তানের গদার পোর্টের ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটারের মধ্যে এটি। গদার গভীর সমুদ্র বন্দরের উন্নয়নে চীন বিপুলভাবে যুক্ত। পাকিস্তানের বন্দরগুলোর ওপর আফগানিস্তানের নির্ভরশীলতা কমাতে এবং আফগানিস্তান ও ইরানে বাণিজ্য বাড়ানোর মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বাড়াতেই চাবাহার-বিনিয়োগ-উদ্যোগে শামিল হয় ভারত।

২০১৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইরান সফরসময়ে এই চুক্তি হয়। প্রকল্পের একাংশ ছিল চাবাহার থেকে জাহিদান পর্যন্ত প্রায় ছয় শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন বসানো। সেই রেললাইন ইরানের জাতীয় রেল যোগাযোগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা। বন্দরে দুটো নতুন টার্মিনাল নির্মাণ ছাড়াও ভারত বিশেষভাবে শামিল ছিল রেল প্রকল্পে। ইরান-ভারত-আফগানিস্তানের যৌথ প্রকল্প হলেও মূল বিনিয়োগ ভারতেরই করার কথা এখানে।

প্রায় ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প এটি। ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কন্সট্রাকশন লিমিটেড (ইরকন)-এর এই কাজ করার কথা। ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেডও চাবাহারে রয়েছে। এসব সংস্থাকে তাদের কাজ এখন অনেকখানি গুটিয়ে আনতে হবে। অথচ ইরানের এই বন্দরের উন্নয়নে ভারতের শামিল হতে পারা ছিল নয়াদিল্লীর ভূ-রাজনৈতিক বিস্তারের উল্লেখযোগ্য এক অগ্রগতি। এতে আফগানদের কাছে পাকিস্তানের গুরুত্ব ও নির্ভরতা কমতো।

রেলপ্রকল্পের শেষ মাথা জাহিদান আফগানিস্তানের সীমান্তসংলগ্ন। বন্দরহীন আফগানিস্তানের পাকিস্তান নির্ভরতা কমানো ছাড়াও ভারত সমুদ্রপথে মুম্বাই থেকে চাবাহার হয়ে কাবুল ও মধ্য এশিয়ায় পণ্য পাঠিয়েও লাভবান হতো এই প্রকল্প থেকে। এই রুটে মধ্য এশিয়ার দিকে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে খরচ ও সময় অর্ধেক কমে যেতে পারতো। দক্ষিণ ইরান এবং আফগানিস্তানে নয়াদিল্লীর যোগাযোগও অবাধ করে তুলতো এই বন্দর।

যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ

যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যে বহু বিদেশি কোম্পানির বিরুদ্ধে অবরোধ দিয়ে রাখলেও চাবাহারে ভারতের বিনিয়োগকে অবরোধের বাইরে রেখেছিল কৌতূহল উদ্দীপকভাবে। ব্যাখ্যা হিসেবে ওয়াশিংটন বলেছিল, আফগানিস্তানের স্বার্থে চাবাহারকে অবরোধের বাইরে রাখা হচ্ছে। আসলে এটা পাকিস্তানের গদার বন্দরকে গুরুত্বহীন করার আকাঙ্খা থেকেও হতে পারে বলে মনে করা হয়। এখন মনে হচ্ছে চাবাহারে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ভারতের কোন কাজে লাগছে না শেষপর্যন্ত।

গত ডিসেম্বরেও ইরান ও ভারতের কর্তাব্যক্তিরা চাবাহারের কাজ দ্রুতলয়ে সারতে একমত হয়েছিলেন। মাত্র ছয় মাসে পুরো পরিস্থিতি উল্টে যাওয়ার বড় কারণ বলা হচ্ছে চীন-ভারত বৈরিতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং চীন-ইরান আসন্ন ‘মহাচুক্তি’।

চীনের সঙ্গে ইরানের কয়েক শ’ বিলিয়ন ডলারের বিশাল আয়তনের এক চুক্তি হওয়ার কথাবার্তা রয়েছে শিগগিরই বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিনিয়োগের অংক বলা হচ্ছে ৪০০ বিলিয়ন ডলার। ভারতের মিডিয়ায় যখন যুক্তরাষ্ট্রের গুগলের ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হেডলাইন হয়ে যায়– তখন চীন-ইরান চুক্তির অংক আসলেই অনেক বড়। সেরকম মুহূর্তেই চাবাহারের ঘটনা ঘটলো। চীনের ঐ বিপুল বিনিয়োগের বিনিময়ে ইরান ২৫ বছর ধরে বেইজিংকে সস্তায় জ্বালানি তেল দিয়ে যাবে বলে কথা রয়েছে। এতে ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধও বেশ অকার্যকর হয়ে যাবে।

পাশাপাশি, ভারত সীমান্ত সংঘাতকে অর্থনৈতিক পরিসরে টেনে এনে টিকটকসহ চীনের অ্যাপ নিষিদ্ধ করা এবং ভারতে চীনের বিনিয়োগে বাধানিষেধ আরোপ করা মাত্র চাবাহারের ঘটনা তাৎপর্যবহ। এই ঘটনা ইরানের তরফ থেকেও বিস্ময়কর। যদিও তারা বলছে, নিজের অর্থেই এখন চাবাহার-জাহিদান রেললাইন বসানোর কাজ সারবে তারা। চুক্তি বাতিলের জন্য অর্থ দিতে দেরি হওয়ার জন্য ভারতকে দায়ী করেছে তারা। যদিও সিদ্ধান্তের নাটকীয়তা বলছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক পূর্বাপর ভেবেই।

যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার ভারতীয় সিদ্ধান্তে তেহরানের ক্ষোভের গভীরতাও আঁচ করা যায় সর্বশেষ সিদ্ধান্তে। ইরানের তরফ থেকে এমনও ইঙ্গিত রয়েছে চীনের সহায়তায় নির্মিত পাকিস্তানের গদার ও চাবাহার বন্দরের মাঝে যোগাযোগ-সংযুক্তিতেও আগ্রহী তারা। এরকম কিছু ঘটলে তা হবে ঐ সমুদ্রে এবং মধ্য এশিয়ায় চীন-পাকিস্তান-ইরানের পণ্য পরিবহন এবং সামুদ্রিক আধিপত্যে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।

লেখক: গবেষক ও রাজনৈতিক চিন্তক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন