|| মোজাম্মেল হোসেন||
[এশিয়া-আফ্রিকার অনেক গরিব দেশের তুলনায় আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভালো হলেও করোনাঝড় এই ব্যবস্থার ভেতরের ভাঙাচোরা দেউলিয়া চেহারা ও ফাঁক-ফোকড়গুলো একেবারে উদোম করে দিল।]
আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার কাঠামো ও অর্জনের কিছু দিক আন্তর্জাতিক প্রশংসা পেয়েছে। একটি হলো ইউনিয়ন তথা তৃণমূল পর্যন্ত সরকারি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণের ক্লিনিক, সেন্টারের বিস্তৃতি। কিন্তু এটা অনেকটা শূন্যগর্ভ। কাঠামোর তুলনায় লোকবল ও ওষুধ-সরঞ্জামের প্রকট অভাব। এর কারণ বাজেট কম ও স্থবির আমলাতন্ত্র।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্তরে প্রশংসনীয় বিস্তৃতি আছে কিন্তু মান মারাত্মক খারাপ।
স্বাস্থ্যের দ্বিতীয় প্রশংসার জায়গা শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু কমিয়ে আনা ও ইমিউনাইজেশনে (শিশুদের টীকা কার্যক্রম) সাফল্য। এতে আমরা উপমহাদেশে শীর্ষে এবং এমডিজি চ্যাম্পিয়ন। এই কার্যক্রমে জাতিসংঘ ও বৈদেশিক সাহায্যের বড় ভূমিকা থাকলেও আমাদের পরিকাঠামো বেশ কার্যকর।
তবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের জন্য সহজলভ্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নেই। তারা সরকারি হাসপাতালে ভিড় করে ও নামমাত্র চিকিৎসা পায়। পরিচিতি ও যোগাযোগ থাকলে অল্পকিছু লোক সরকারি হাসপাতালে ভালো সেবা পায়। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর মেডিক্যাল কলেজ ও অন্য সরকারি হাসপাতালের সক্ষমতা আছে কিন্তু সবাইকে দেওয়ার মতো তা পর্যাপ্ত নয়। আনুপাতিক হিসেবে সম্পদ ও ডাক্তার-নার্সের চেয়ে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ক্রয় করে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তা পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যসেবার বেসরকারি খাতটাই এখন বড় হয়ে উঠেছে। কিছু কিছু রোগের জন্য মধ্যবিত্তরা ভারতে বা থাইল্যান্ডে যায়। দেশে গুটিকয়েক ব্যয়বহুল বিশ্বমানের হাসপাতালও হয়েছে। সরকারি উচ্চপদস্থ ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা কিনতে অহরহ সিংগাপুর, লন্ডন বা নিউইয়র্কে যায়। অর্থাৎ নগ্ন শ্রেণীবৈষম্য ভিত্তিতে জটিল একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাংলাদেশে আছে। সুস্পষ্ট জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সকলের জন্য সহজলভ্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা গড়তে আমাদের রাষ্ট্র ও কোনো সরকার চেষ্টা নেয়নি।
এর পরও এশিয়া-আফ্রিকার অনেক গরিব দেশের তুলনায় আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভালো চলনসই। তবে করোনাঝড় তথা বর্তমান বৈশ্বিক মহামারি এই ব্যবস্থার ভেতরের ভাঙাচোরা দেউলিয়া চেহারা ও ফাঁক-ফোকড়গুলো একেবারে উদোম করে দিল। সংকটকালে তার প্রকৃত দুর্বলতাগুলো প্রকটভাবে প্রকাশ পেলো। জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের অবহেলা প্রকট হলো। বিস্তারিত আলোচনা এই পরিসরে সম্ভব নয়; এখন মহামারি মোকাবেলার জরুরি পরিস্থিতিতে তা উচিতও নয়; উপস্থিত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে কিছু করণীয় উল্লেখ করা যাক:
(১) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষ। তাঁর পারফর্মেন্স জনমনে অনাস্থা তৈরি করছে। জরুরি অবস্থা মোকাবেলার দক্ষতা সবার থাকে না। ‘যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা’ (war cabinet) ধারণাটা মাথায় নিয়ে অন্তত এই মন্ত্রণালয়টির দায়িত্ব একজন অভিজ্ঞ দক্ষ পারদর্শী ব্যক্তিকে দিতে হবে। এটা প্রধানমন্ত্রীর এক্তিয়ার।
(২) করোণা সংক্রমণের শুরুতেই এমন বিপত্তি হয় যে মানুষ সর্দি-জ্বর-হাঁপানির মতো সাধারণ অসুখবিসুখের চিকিৎসা পাচ্ছে না। গুরুতর ক্ষেত্রেও ক্যান্সারের চিকিৎসা বা ডায়ালিসিসের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। রোগী একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। তখনই স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের বসে সমাধান বের করা উচিত ছিল, যা হয়নি। এখনও খুবই আংশিক সমাধান হয়েছে। এখন সংক্রমণ বাড়ছে। দেরিতে কাজ শুরু হলেও করোনা রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতালগুলোকে দ্রুত পুরো প্রস্তুত করতে হবে। অন্যদিকে সাধারণ হাসপাতালের স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে হবে। শীঘ্রই আসছে ডেঙ্গুর সময়। করোনার রোগী অধিকাংশ বাসায় থাকতে পারবে কিন্তু ডেঙ্গু রোগীর প্ল্যাটিলেট কাউন্ট দেখা ও রক্ত দেওয়া হাসপাতালেই হবে।
(৩) সরকারি নেতারা বলছেন, পিপিই ও এন-৯৫ মাস্ক যথেষ্ট আছে। ডাক্তার-নার্সরা বলছেন পাচ্ছেন না। এই বৈপরীত্যে হতাশা বাড়ছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার আনুপাতিক হারও বেশি, যা সমূহ বিপজ্জনক। আমেরিকা-বৃটেনের সরকার স্বীকার করছে যে পিপিই ও মাস্কের অভাব আছে। এত বড় মহামারিতে এটা স্বাভাবিক। আমাদের সরকারের উচিত জনগণের কাছে স্বচ্ছ থাকা, পিপিই-মাস্ক সংগ্রহে আপ্রাণ চেষ্টা করা ও সেগুলো বিতিরণ ব্যবস্থাপনায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বা সমন্বয়হীনতা থাকলে তার দ্রুত সমাধান করা। সবাই যদি আত্মহত্যা না করতে চাই তাহলে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দিতে হবে সর্বাগ্রে। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পরিবর্তে সিভিল সার্জন ও স্বাস্থ্য বিভাগকে গুরুত্ব বেশি দিতে হবে।
(৪) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর দীর্ঘদিন ধরে প্রচন্ড দুর্নীতিগ্রস্থ ; অস্বচ্ছভাবে, সমন্বয়হীনভাবে, শুধু লুটের জন্য কেনাকাটার ফল ভোগ করছি এখন আমরা। দামী সরঞ্জাম কেনা হয়েছে কিন্তু বসানো হয়নি, অকেজো, অচল প্রভৃতি অভিযোগ অনেক। আইসিইউ, ভেন্টিলেটর কম থাকা বড় অভিযোগ নয়, সেটা স্বাভাবিক কিন্তু যা আছে তা সব সচল নয় এবং জনবল নাই– এটাই পরিতাপের। এখন দ্রুত চালু করা ও জনবল প্রশিক্ষণের প্রশ্ন।
(৫) কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক দলাদলি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ পেশাগত ও সেবাখাতগুলোকে পঙ্গু করে ফেলেছে। ডাক্তারদের বিধিবদ্ধ শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনকে (বিএমএ) পাশ কাটিয়ে ড্যাব (বিএনপি) ও স্বাচিপকে (আ-লীগ) বড় করে তোলায় পেশাদারদের ঐক্য ও সমন্বয় দুটোই নস্যাৎ হয়ে গেছে। এখন টিভিতে আর্সানাল ভাইয়ের মুখ বার বার দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতায় বিএনপি থাকলে জাহিদ ভাইকে এভাবে দেখা যেতো। ফলে পুরো ডাক্তার সমাজকে ঐকতানে সক্রিয় পাবেন না। পারলেই পরস্পর দোষারোপ করবে। বর্তমান মহাদুর্যোগে দরকার পেশাদারি ঐক্য। তাঁরা কি সাড়া দিতে পারবেন?
(৬) বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবসা যেমন একান্ত মুনাফাভিত্তিক গড়ে উঠেছে এবং গোটা সমাজেই পেশার নৈতিকতা দুর্বল তাতে বেসরকারি হাসপাতালগুলো হাত গুটিয়ে বসে গেছে তা বিচিত্র নয়। সরকারি নেতৃত্বে সরকারি-বেসরকারি পুরো পরিকাঠামো কতটা প্রয়োজনানুসারে সক্রিয় করা যায় তার উপর সাফল্য নির্ভর করছে।
(৭) সরকারকে বা কাউকে দোষারোপ করার এটা সময় নয়। রাজনীতি, দলাদলি, টু-পাইস কামানোর ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে সকলে এক হয়ে জীবন বাঁচানোর লড়াই। করোনা চিকিৎসার জন্য সরকারের নির্ধারিত কয়েকটি হাসপাতালের প্রধান দুটি উত্তরার কুয়েত মৈত্রী ও কুর্মিটোলারই যে অপ্রস্তুত নাজুক অবস্থার খবর মিডিয়ায় এসেছে তাতে বুকে কাঁপন ধরে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে সংক্রমিত দেশগুলো থেকে আসা প্রবাসীদের কোয়ারান্টাইনে রাখতে না পারা থেকে নানা ক্ষেত্রে যে আমরা অপ্রস্তুত এটাই আমাদের জাতীয় সক্ষমতার মান। এখন যুদ্ধক্ষেত্রেই সর্বশক্তি একত্র করে এই সক্ষমতা বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে যেন আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে না পড়ে এবং সংক্রমণ কম থাকে।
করোনা মহামারি থিতিয়ে গেলে যারা বেঁচে থাকবেন তাঁরা, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, যেন দেশে একটি গণমুখি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগুয়ান হন। সেটা জনস্বার্থের রাজনৈতিক লড়াইয়ের অংশ হবে।।
লেখক: মোজাম্মেল হোসেন, সাংবাদিক