খেলাপি ঋণের দুর্বৃত্ত সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রপরিচালকদের দায়

|| সাইফুল হোসেন ||

টাকা নিয়ে টাকা না দেওয়ার সংস্কৃতিটা এই বঙ্গে বেশ পুরনো। এই সংস্কৃতিতে যতটা না সাধারণ অসচ্ছল মানুষ তার চেয়েও ঢের বেশী অভ্যস্ত ‘অসাধারণ’ তথা বিত্তবানরাই। বিশেষ করে যারা কিনা রাষ্ট্রিক ও সামাজিক ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে কোন না কোনভাবে সংশ্লিষ্ট।
রাষ্ট্রিক ও সামাজিক ক্ষমতাকাঠামোয় ক্ষমতায়িত ‘অসাধারণ’ এসব মানুষের এমন দুর্বৃত্ত সংস্কৃতিই আজকের বুড়ো পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির অভিধানে ‘খেলাপি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

প্রায় প্রতিদিনই আমরা খবরের কাগজে পড়ি দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে এতো……….টাকা! এই ঋণ আদায়ে কঠোর হচ্ছে সরকার, এমন অনেক শিরোনামঋদ্ধ প্রতিবেদন। বিষয়টি নিয়ে সাধারণের মধ্যে রয়েছে সরকার ও রাষ্টবিরুদ্ধ সংক্ষুব্ধতা। রয়েছে নানা মাত্রার বিরোধিতাও। যেমনটা রয়েছে বিশ্ব পুঁজিবাদি অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংরক্ষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে।

অবাধ তথ্যপ্রবাহের এই যুগে মানুষের জানাশুনার পরিধি ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি। একজন কৃষক যেমন জানে ঢাকায় এক কেজি দুধ কত টাকায় বিক্রি হয়, মুগদা হাসপাতালে এক্সরে মেশিন কত টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে, তেমনি জানে আব্দুল হাই বাচ্চু নামের রাষ্ট্রিক ক্ষমতায় ক্ষমতায়িত এক ‘অসাধারণ’ মাুনষ জনঅর্থে পরিচালিত বেসিক ব্যাংকের কোষাগার থেকে নিয়ে গেছে কত লক্ষ কোটি টাকা! প্রতি বছর এ দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে ষাট হাজার কোটি টাকারও বেশী অর্থ। এসব কারা করছে তাও আজকে দেশের মানুষের অজানা থাকছে না।

সরকার ও রাষ্ট্রিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে দেশের অর্থনীতি যে প্রতিদিন লুন্ঠিত হচ্ছে এবং লুণ্ঠনের পথপদ্ধতিটা যে পাকিস্তানি লুটেরা শাসকদেরকেও হার মানিয়েছে সেটাও সাধারণেরা বোঝেন এবং এটাও জানেন, যেসব মানুষ টাকা লুট করছেন তারা এদেশেরই দেশপ্রেমিক (!) বাংলাদেশী।

একবার গ্রামের এক চা বিক্রেতার কাছে প্রসঙ্গক্রমে জানতে চেয়েছিলাম, খেলাপি ঋণ কি সে সম্পর্কে। তাঁর উত্তর ছিল খুবই সাবলীল। তিনি বলেছিলেন, কেন বড়লোকেরা ব্যাংক থেকে ঋণ নামে যে টাকা নেয় সেই টাকা। তিনি মনে করেন, বড়লোকেরা ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেয় সেই ঋণের টাকা তাঁদের কেউ ফেরত দেয়না, ফেরত দেয় তাঁরা যারা গরীব মানুষ, যারা খেটে খাওয়া মানুষ।

খেলাপি ঋণ সম্পর্কে সমাজের সবশ্রেনীর মানুষের মধ্যে এমন একটা আপাত উপরি ধারণা তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু একথা সত্যি যে খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কেই বেশীর ভাগ মানুষ জানেন না, এমনকি কোন কোন ব্যাংকারও সঠিকভাবে বিষয়টির অভিঘাত সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার সুযোগ করেন না কিংবা পান না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের ব্যাংকিংখাতে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়েছে তা এই খাতের মোট মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১১ শতাংশ।

অন্যদিকে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল-আইএমএফ বলছে খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৪ থেকে ২৬ শতাংশ।

আসলে কোনটা ঠিক, বাংলাদেশ ব্যাংক নাকি আইএমএফ, নাকি দুটোই ঠিক? এটা জানা বা বোঝা খুবই মুশকিল। এমন দ্বৈত পরিসংখ্যান জানতে পেরে আমরা বেশ ধন্ধে পড়ে যাই। সাধারণভাবে দেখলে একটি বিষয়ে তথ্য হবে একটা, দুটো হবারতো সুযোগ নেই। তাহলে একটা সঠিক হলে অন্যটা সঠিক নয়। প্রশ্ন হচ্ছে কোনটা সঠিক নয়?

প্রত্যেকটা ঋণের একটা মেয়াদ আছে। সেই মেয়াদ হতে পারে ৩ মাস, হতে পারে ৩ বছর এটা নির্ধারিত হয় ব্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। সাধারন নিয়ম হচ্ছে নির্ধারিত সব প্রক্রিয়ামেনে ঋণ নেওয়ার পর গ্রাহককে সেই ঋণ সুদসহ ফেরত দিতে হয়। যদি সেই ঋণ সময় মত শোধ করা না হয়, তা যেকোনো কারনে হোক, তাহলে একটা সময় পরে সেটা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়।

২০১৯ সালের ১৯শে এপ্রিল জারী করা সার্কুলার অনুযায়ী (যেটা ৩০শে জুন ২০১৯ থেকে কার্যকর) সব ধরণের চলতি ঋণ, ডিম্যান্ড লোণ, ফিক্সড টার্ম লোণ অথবা যেকোনো ধরণের ঋণের কিস্তি ৩ মাসের বেশি কিন্তু ৯ মাসের কম অনাদায়ী থাকলে তা সাব-স্টান্ডার্ড ঋণ, ৯ মাসের বেশি কিন্তু ১২ মাসের কম অনাদায়ী থাকলে তা সন্দেহসমৃদ্ধ বা ডাউটফুল, আর ১২ মাসের বেশি অনাদায়ী থাকলে ব্যাড ডেট বা মন্দ ঋণ হিসেবে গণ্য হবে। এও বলা হয়েছে যে, সাব স্টান্ডার্ড (এসএস) হলে সেই ঋণকে খেলাপি ঋণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিংখাতে বিতরণ করা ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

আইএমএফের মতে, ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব করেছে সেটা মুলত উপরের সার্কুলারের নিয়ম অনুযায়ী এবং যেটা অংশত সত্য। কেন অংশত সত্য সেই ব্যাখ্যায় যাওয়া যাক।

ব্যাংকের ঋণ অনেকদিন ধরে খেলাপি থাকলে একসময় ব্যাংক আইনের আশ্রয় নিয়ে টাকা আদায় করার চেষ্টা করে। যদি সেই চেষ্টা সফল হয় তাহলে ঋণ সমন্বয় হয়ে যায়। কিন্তু যখন ব্যর্থ হয় তখনই ঘটে বিপত্তি। বিফল হলে ব্যাংক চেষ্টা করে আদালতের আদেশ নিয়ে (যদিও এখন আদালতের আদেশ লাগার কথা নয়, যদি না খেলাপিগ্রাহক আদালতের শরণাপন্ন হয়ে স্টে-অর্ডার নিয়ে নেয়) ঋণ গ্রহীতার বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণ সমন্বয় করে।

কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায়, অনেক গ্রাহকের সম্পত্তি বিক্রি করতে গেলে যে দাম পাওয়া যায় তা থেকে ঋণের অর্ধেকও পরিশোধ হয় না। তাছাড়া বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রি করা বেশ ঝামেলাপূর্ণ একটি কাজ। সঠিক দাম পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে। ফলে ঋণ আংশিক সমন্বয় হয়। আর জমি বিক্রি না হলে আদায় হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। অন্যদিকে ঋণগ্রহিতারা নানাভাবে রাষ্ট্রিক ক্ষমতায় ক্ষমাতায়িত হয় বিধায় তাদের যে বড় রকমের কোন শাস্তি হয় বা হয়েছে তা আমরা দেখি না।

এমন সব কারণেই ব্যাংককে এই খেলাপি ঋণ বছরের পর বছর বহন করতে হয়। এক সময় ব্যাংক তার হিসাব পরিস্কার করার জন্য রাইট অফ বা অবলোপন করে এই ঋণ। ব্যাংকের খাতা পরিস্কার হয় কিন্তু ঋণ থাকে অনাদায়ী।

২০০২ সালে পাঁচ বছরের বেশি সময়ের অনাদায়ি মন্দ ঋণের ‘রাইট অফ’ বা ‘অবলোপন’ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক এভাবে কাগজে কলমে রাইট অফ করেছে ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ বাঙ্কের হিসাবের মধ্যে পড়ে শুধু শ্রেনিকৃত ঋণ অর্থাৎ সাব স্ট্যান্ডার্ড, ডাউটফুল ও ব্যাড লোণ। যা বাদ যায় তা হল:

১) খেলাপি কিন্তু আদালতের স্থগিতাদেশ বা স্টে অর্ডার নিয়ে অশ্রেনিকৃত ঋণ

২) যে সব ঋণ রাইট অফ বা অবলোপন করা হয়েছে সেগুলো এবং

৩) যে ঋণ অনেকদিন ধরে খেলাপি কিন্তু কিছু পরিমানে ডাউনপেমেন্ট দিয়ে পুন:তফশিল করা হয়েছে সেগুলো। তাছাড়া কিছু ঋণ আছে যেগুলো সংকেত দিচ্ছে যে, খুব তাড়াতাড়ি খেলাপিতে পরিনত হবে সেগুলোও বাদ যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে।

অনেক ব্যাংক আছে যারা আবার ইচ্ছে করে মুনাফা বা লাভ বেশি দেখিয়ে লক্ষ্য পুরন করবার জন্য উইন্ডো ড্রেসিং করে খেলাপি কম দেখান। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব দেখায় প্রকৃতপক্ষে সেটা একটা খন্ডিত চিত্র প্রকাশ করে মাত্র। আর সেজন্য আইএমএফ যে হিসাব করেছে, খেলাপি ঋণ তার চেয়েও বেশি হবার সম্ভাবনাই বেশী। কারণ তাঁরাও সম্ভবত অবলোপন করা ঋণ এবং অসুস্থ কিছু ঋণ যা আদায় হবার নয়, আবার খেলাপিও নয় খাতা কলমে সেইসব ঋণকে হিসাবের মধ্যে আনেনি।

কথা হচ্ছে, টেনেটুনে খেলাপি ঋণ কম দেখিয়ে বা সহজ শর্তে ঋণ পুনঃতফসিল করে খুব বেশি লাভ হয় কি?

কোন সরকারসময়ে উপরোক্ত পথপদ্ধতিতে খাতা কলমে খেলাপি ঋনের পরিমান কমে গেলে হয়ত জোর করে বলা যায় যে, সেই সরকার দেশের অনেক উপকার করেছেন, আর্থিক খাতের উন্নতি করেছেন। কিন্তু প্রকৃত অবস্থার কোন উন্নতি হয়না।

যারা স্বেচ্ছা খেলাপি তাঁরা অল্প টাকা দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করিয়ে আবার ঋণ নেওয়ার সুযোগ পেতে পারেন পুনরায় খেলাপি হবার জন্য, দেশের টাকা আর একধাপ লুট করার জন্য এবং বিভিন্ন আইনি জটিলতা এড়ানোর জন্য। দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে গেল বছর প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা নিয়মিতকরন করা হয়েছে।

এতে হয়ত দেশের অর্থনীতিতে আপাত একটা স্বস্তি এসেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু একটা সময় পরে যখন এর সিংহভাগ আবার খেলাপি হবে তখন এই খাতের চেহারা আরও খারাপ হয়ে পড়বে।

অন্যদিকে খুব কমসংখ্যক হলেও যারা যৌক্তিক কারনে খেলাপি হয়েছেন, তাঁদের জন্য ঋণ পুনঃতফশিল খুবই জরুরি। কারণ তাঁরা ঋণ খেলাপি হবার কারনে পথে বসেন, কোন ধরনের ব্যাংকিং সুবিধা পান না।

মোদ্দাকথা হচ্ছে দেশের অবকাঠামো তথা সড়ক সেতু, আকাশছোঁয়া সব দালান কোঠার অস্বাভাবিক বিস্তৃতিকে সরকারসংশ্লিষ্টরা ‘উন্নয়ন’ বলে দাবি করলেও সেটা প্রকৃত উন্নয়ন নয়।

দেশের প্রকৃত আর্থিক উন্নয়ণ নিশ্চিত করতে হলে যেটি সবচেয়ে জরুরি তা হচ্ছে, মানুষের আয় বৈষম্য কমানোর পাশাপাশি তাদের স্বা্স্থ্য, শিক্ষা, আবাসন ও খাবারের নিশ্চয়তার মত সাংবিধানিক ও মৌলিক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা। যেটি অপরিহার্যভাবেই রাষ্ট্র পরিচালকদের দায়িত্ব।

আর্থিক খাতের এমনতর প্রকৃত উন্নতি যেমন মধ্যম আয়ের দেশ হতে দরকার, তেমনি দরকার করোনার অভিঘাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলেও।

তাই খেলাপি ঋণের প্রকৃত হিসাব জনমানসে আনতে হবে। আর যে ঋণ কখনোই আদায় হবে না সেই ঋণকে জোর করে নিয়মনীতি পরিবর্তন করে নিয়মিত ঋণ হিসেবে দেখিয়েও কোন লাভ নেই।

ব্যাংকিং খাতকে এই ঋণ খেলাপি-ইচ্ছে-পুনঃতফসিলিকরন ও লুন্ঠনের চক্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি স্বেছাখেলাপি ও টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠোর আইনি ব্যবস্থা। এজন্য দরকার ব্যাংকিং আইনের আমুল সংস্কার। যা করতে হবে রাষ্ট্রের মালিক জনগনের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা তথা সরকারে যারা থাকেন তাদেরকেই।

এসব করতে না পারলে করোনাভাইরাস যেমন সারা পৃথিবীর মানুষকে সোজাসাপ্টা করার কাজে নেমেছে তেমনি অন্য কোন ভাইরাস দেশের আর্থিক খাতসহ অন্য সব খাতের অনিয়ম ঠিক করার কাজে নেমে পড়বে। যা হয়তো বিবেচিত হবে প্রকৃতির বিচার বলেই।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল
Email: hossain.shaiful@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন