কুরুচির ভাইরাস ‌'গেন্দা ফুল' ও একজন রতন কাহার

|| মোজাম্মেল হোসেন ||
করোনাক্রান্তিকালে ফেসবুক বিচরণে একটি সাংস্কৃতিক বিষয়ে একেবারে শিরেসংক্রান্তি ঘটে গেল। প্রথমে গেল ২৭শে মার্চ সোমবার সন্ধ্যায় অধ্যাপক গীতিয়ারা নাসরিনের পোস্টে দেখলাম সতর্ক করেছেন, ‘বড়লোকের বিটি লো’ গানের কথা ছিনতাই করে যে বিকৃত ‘গেন্দা ফুল’ মিউজিক ভিডিও তৈরি হয়েছে তার তালে যেন শিশুদের নাচতে না দেওয়া হয়। স্বপ্না চক্রবর্তীর গাওয়া রেকর্ডের গানটি ইউটিউবে আছে, সেটা বাজিয়েই যেন শিশুদের নাচতে দেওয়া হয়।
পরেরদিন মঙ্গলবার সকালে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বন্ধু হিলালউদ্দিন এ-সংক্রান্ত একটি খবর পোস্ট দিয়ে লিখেছেন, তিনি এই প্রথম মূল গানটির রচয়িতার নাম জানলেন।
আগ্রহ হওয়ায় করোনা থেকে সরে গিয়ে সার্চ দিয়ে ভিডিওটি দেখে-শুনে রাগে বেহ্মতালু জ্বলে গেল। কিছু লিখতেই পারছিলাম না।
সনি মিউজিকের ব্যানারে মিনিট তিনেকের এলবামের ক্রেডিট লাইনে লিরিক ও মিউজিক রচয়িতা হিসেবে র‍্যাপার বাদশার নাম। সহগায়িকা পায়েল দেব। নাচনেওয়ালি মডেল-অভিনেত্রী জ্যাকুলিন ফার্নান্ডেজ। হিন্দি ও ইংরেজিতে বিটের সঙ্গে র‍্যাপের আদলে কিছু ছন্দবদ্ধ অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দ আছে কিন্তু কোনো অর্থপূর্ণ লিরিক নাই। মূল উপজীব্য শাড়ি ও অন্য কস্টিউমে স্বল্পবসনা জ্যাকুলিনের নাচ।
র‍্যাপের নমুনা : “চ্যালে যব তু লাটাক মাটাক/ লুন্ডো কে দিল পাটাক পাটাক/…বাম তেরা গোটে খায়ে/ কমর পে তেরি বাটারফ্লাই/ বডি তেরি মাকখান জ্যায়সি/ খানে সে বস তু বাটার খায়ে…কাম অন বেবি কিক ইট কিক ইট/কাতুন তেরি টিকেট টিকেট” ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এর মধ্যে পাঞ্চিং লাইন হিসেবে বাংলা জনপ্রিয় লোকগীতি থেকে “বড়লোকের বিটি লো, লম্বা লম্বা চুল, এমন মাথা বিন্ধে দিব লাল গেন্দা ফুল” এই প্রথম চরণটি কোরাসে কয়েকবার ব্যবহার। এই অংশটুকুই সুরেলা ও সাঙ্গীতিক। পাঞ্জাবি র‍্যাপার কিভাবে বাংলা গানের লিরিসিস্ট হলেন? শুধু সুর-বাদ্যের কম্পোজিশন ছাড়া এই এলবামে বাংলা গানের কথা ঢোকানোর কোনো যুক্তিও নাই।
সনি মিউজিক ও বাদশার সবচেয়ে বড় অপরাধ গানটির রচয়িতা বিরভূমের দরিদ্র লোকশিল্পী রতন কাহারের স্বীকৃতি না দিয়ে তার গান চুরি করা। শিল্প-সংস্কৃতির জগতে সৃষ্টিশীল সহজ-সরল মানুষদের বঞ্চনার কাহিনী নতুন নয়।
কী দুঃখজনক যে রতন কাহারের কাছ থেকে গানটি লিখে এনে ১৯৭৬ সালে স্বপ্না চক্রবর্তী অশোক রেকর্ড কোম্পানির ব্যনারে রেকর্ড করে বাজারে ছাড়েন। খুব সম্ভবত ইপি রেকর্ডটিতে রতন কাহারের আরো একটি গান ছিল “বলি ও ননদী আর দু মুঠো চাল ফেলে দে হাড়িতে ঠাকুর জামাই এলো বাড়িতে।”
দু’টো গানই সেকালে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়। স্বপ্না গোল্ডেন ডিস্ক পুরস্কার পান কিন্তু সেই রেকর্ডেও রচয়িতার নাম দেওয়া হয়নি। লেখা হয় ‘বাংলা লোকগীতি’। কোম্পানি অনেক লাভ করলেও নাম ও চুক্তি না থাকায় রতন কাহার কিছু পাননি।
এতদিন পরে আবার বলিউডি বাদশা ওই গান ব্যবহার করে মিউজিক ভিডিওর নামে নারীর শরীর দেখিয়ে লাখ টাকা কামাবেন। রতন কাহারের খবর নাই। অথচ তিনি বেঁচে আছেন।
ভারতীয় মিডিয়ার খবরে জানা গেল, বিরভূমের গ্রামে তিনি জীবিকার জন্য বিড়ি বাঁধার কাজ করেন। একসময় রতন কাহার প্রচুর ঝুমুর ও ভাদু গান রচনা করেছেন। প্রখ্যাত অভিনেতা পাহাড়ী সান্যালের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে তিনি আকাশবাণীতেও গান গেয়েছেন।
এই লোকশিল্পীর বর্ণনা অনুসারে তিনি কোনো এক বড়লোক বাবুর দ্বারা প্রতারিত এক সাঁওতাল কুমারী মায়ের কাছে তার কন্যাকে দেখে গানটি রচনা করেন। ওই মা তার কাহিনী শিল্পীকে জানিয়ে নিজে বড় করে তোলা কন্যার রূপ সম্পর্কে বলেছে, ‘হইবেক লাই? ই বড়োলোকের বিটি আছে বটেক।’ লোকশিল্পী দেখেছিলেন বালিকার বিনুনিতে গাঁদা ফুল। আর মুম্বাইর বেনিয়া গায়ক দেখলেন জ্যাকুলিনের কোমরে প্রজাপতির উল্কি।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ভারতব্যাপী লকডাউনের মধ্যে ২৬শে মার্চ বাদশার গানটি ইউটিউবে ছাড়া হয়। নাম ‘গেন্দা ফুল’। বাংলা লোকগীতি ‘বড়লোকের বিটি লো’ ও একটি হিন্দি চলচ্চিত্রে এ আর রহমানের সুরে ‘সসুরাল গেন্দা ফুল’ গানের বদৌলতে এই নামকরণ পরিচিতির সহায়ক।
ঘরবন্দী মানুষ এখন নেটে থাকে বেশি। গানটি ভাইরাল হয়েছে এবং বাহবা দেওয়ারও লোকের অভাব হয়নি। আবার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় মিডিয়ায় বাদশাকে প্রবল আক্রমণ করা হয়েছে রচয়িতার নাম ও কপিরাইট প্রশ্নে অসততার জন্য। দীর্ঘদিনের বিস্মৃত লোকগায়ককে সাংবাদিকরা আবার সামনে নিয়ে আসেন। চাপে পড়ে বাদশা বলেছেন, তিনি রচয়িতার কথা জানতেন না, প্রচলিত লোকগীতি হিসেবে গানটি নিয়েছিলেন। তিনি রতন কাহারকে সাহায্য করবেন।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুর্বল অবস্থানে থাকা সৃজনশীল মানুষরা প্রায়শ তাদের সৃষ্টিকর্মের কপিরাইট রক্ষা করতে ও ন্যায্য ফলভোগ করতে পারেন না। অনেক রকম তস্করতার শিকার হন তাঁরা। পাশাপাশি এখন রুচির দুর্ভিক্ষ ও বিনোদন ক্ষেত্রে উৎকট বেসাতির কারণে চিরায়ত সাংস্কৃতিক সম্পদের মর্যাদা রক্ষাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
আইনি সময়সীমা পার হওয়ায় ২০০১ সালে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিসম্ভারের ওপর বিশ্বভারতীর কপিরাইট উঠে গেলে বিশেষভাবে তাঁর গানের বিশুদ্ধতা বা মূল বৈশিষ্ট্য রক্ষার প্রশ্নে একটা শংকা দেখা দিয়েছিল। আবার এ বিশ্বাসও ছিল যে, রবীন্দ্রনাথের গান তার নিজস্ব উৎকর্ষগুণেই রক্ষা পাবে। মূলত তা হচ্ছে।
কিন্তু, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, কখনো পরিবেশনায় নতুনত্বের নামে, কখনো দুর্বল ইম্প্রোভাইজেশনের মাধ্যমে, কখনো ফিউশন ও রিমিক্সের নামে গানের অঙ্গহানি ও বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে। সর্বশেষ পিলে চমকে দিয়েছে বছর দুয়েক ধরে রোদ্দুর রায় নামে এক ইউটিউবারের অশ্লীল শব্দ দিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের প্যারোডি। এবার বসন্ত উৎসবে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছেলে-মেয়ের এটা নিয়ে মাতামাতিকে মিডিয়া অস্বাভাবিক অশ্লীলতা বলে অভিহিত করেছে। এর জেরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেন। সংস্কৃতি-বিনোদন জগতে কুরুচির ভাইরাস ঠেকাতে হবে।#

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন