কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকানো মৃত্যুরা!

|| সাদিয়া জেরিন পিয়া ||

ছোট্ট দর্জি কারখানা রিয়াজ স্টোরের শুরুটা ১৯৬০ সালে। সেটা পাকিস্তান আমল। এরপর স্বাধীন দেশ, নিজেরাই মালিক। ১৯৭৩-এ রিয়াজ স্টোর হয়ে গেল মেসার্স রিয়াজ গার্মেন্টস। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি প্রতিষ্ঠানের মালিককে। ৭৮ সালে ১৩ মিলিয়ন ফ্রাংক মূল্যের ১০ হাজার পিস শার্ট রফতানি দিয়ে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানীর শুরু। তারপর?

৬০ দশকের সেই স্টোর থেকে হয়েছে শিল্প, শত শ্রমিক থেকে হয়েছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, তার সাথে পাল্লা দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ মেশিন। মালি্কশ্রেণী হাজার টাকা থেকে হাজার কোটি ডলারের মালিক হয়েছেন, দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এরাই বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সরকারি সুবিধা ও প্রণোদনা পেয়ে থাকেন, বিনিময়ে সরকারসংশ্লিষ্টদের দেন বড় বড় নজরাণা।

শুধু কি তাই, এরাই হচ্ছে দেশের আইন প্রণেতা, সরকারের অংশ হচ্ছেন; গড়ে তু্লছেন রাষ্ট্রের ভেতরে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণাধীন আরেক রাষ্ট্রব্যবস্থা। অথচ গত চার দশকে এসব মালিকদের কাজ করিয়ে শ্রমিকদের কাজের স্থায়ীত্ব বা মজুরি কিছুই নিশ্চিত হয়নি। শ্রমিকরা শয়ে-হাজারে আগুনে পুড়ে, পদদলিত হয়ে কিংবা বিল্ডিং ধসে মরছেন। বেঁচে থাকা শ্রমিকদের প্রতিনিয়ত দিন কাটে কাজ হারানোর ভয়ে, মজুরি না পাওয়ার আতংকে। শ্রমিকের এই ভয়-আতংক, নিয়ত বেঁচে থাকার লড়াইয়ে এখন যুক্ত হয়েছে করোনা ভাইরাস মহামারী।

যে মালিকরা শ্রমিকদের নূন্যতম জীবন-মরণের তোয়াক্কা করেনা, একমাসে চার চারবার শত মাইল হাঁটিয়ে, কোরবানীর গরু, ভেড়ার পালের মত করে ট্রাকে-ফেরিতে করে গ্রাম-শহরে টানা-হেঁচড়া করেছেন, সেই মালিকরাই এখন বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা চালাবেন! সাবানপানি/স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে, মুখে মাস্ক লাগিয়ে শ্রমিকরা কারখানায় ঢুকবেন, কারখানায় জীবানুনাশক ছিটানো হবে, এক মেশিন খালি রেখে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ চালাবেন। অসম্ভব জেনেও মেনে নিলাম গড়ে ১ মিনিট করে ৪ ঘন্টা ১০ মিনিট ব্যয় করে সকালবেলা ৫০০ শ্রমিকের করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে অটোমেশিন দিয়ে দূরত্ব রেখে শরীরের তাপমাত্রা মাপবেন!
ধরলাম, এই সবই ঠিক আছে কিন্তু কাপড়ের টুকরার হাত বদল ঠেকাবেন কিভাবে?

আমরা সবাই জানি, গার্মেন্টস শিল্পে কোন শ্রমিকই এককভাবে একটি পোশাক তৈরী করেনা। একখন্ড কাপড় নূন্যতম দশ হাত ঘুরে একটা পূর্ণাঙ্গ পোশাকে রূপান্তরিত হয়, কেউ কাঁধে করে কাপড়ের গাঁইট গোডাউনে তোলেন, কেউ সেখান থেকে নেন কাটিং ফ্লোরে, কেউ কাটেন, কেউ বহন করে সুয়িং ফ্লোরে আনেন, কেউ সেলাই করেন হাতা, কেউ কলার, কেউ লাগান বোতাম, কেউ করেন কোয়ালিটি, কেউ ইস্ত্রী-ভাঁজ, কেউ প্যাকিং। তারপর আরো দশ হাত ঘুরে সে পোশাক পৌঁছায় সর্বশেষ গন্তব্যে।

তাহলে প্রতি পর্যায়ে কি কাপড়ের টুকরাগুলো সাবানপানিতে/জীবানুনাশকে ধুয়ে জীবানুমুক্ত করে নেবেন মানুষের হাতের মতো করে? কারন কোন শ্রমিকের শরীরে যদি জীবানু থেকেও থাকে তা তো টের পাওয়া যাবে ৭/১৫/২০ দিন পর।

বর্তমানে বাংলাদেশে সাড়ে ৪ হাজার গার্মেন্টসে প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক কাজ করছেন যার মধ্যে ২২ লক্ষ নারী। এই শ্রমিকরা শহর বা শিল্প এলাকায় এসে বসবাস সব রকমের নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত বস্তি এলাকায়। ১০ বাই ১৪ ফুটের একটা ঘরে থাকে পুরো পরিবার। খাবার পানি, গোসল, টয়লেট, রান্নার জন্য ধরতে হয় লাইন। এরপর রান্না, সন্তান-সংসার সামলিয়ে সকাল ৮টায় কারখানায় ঢোকা, দুপুরে এক ঘন্টার খাবার বিরতিতে বাসায় ফেরা, আবার ২টায় হাঁপাতে হাঁপাতে কারখানায়। ফেরার সময় বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা, কিংবা শিপমেন্টের উপর নির্ভর করে সারারাত।

এই জীবন ব্যবস্থায় রেখে এরপরও কোন জাদুবলে তাদের নিরাপদ রাখবেন আপনারা! একটা স্বাধীন! দেশের এতগুলো টগবগে জীবন আপনাদেরকে যারা ইজারা দিয়েছে, তাদেরকে এই জাতি নিশ্চয় মনে রাখবে। অদূর ভবিষ্যতে তার ফায়সালা হবেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন