রুবাইয়াৎ ই সেলিম
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে একনায়করা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন সেসব যেন তাদের স্বৈরাশাসনেরই ছোট সংস্করণ।
মিশরের সামরিক জান্তা একনায়ক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি‘র কাছে, করোনাভাইরাস যুদ্ধের ময়দানে ভিষন এক শত্রু ছাড়া আর কিছুই নয়। কোভিড-১৯ রুখতে রাসায়নিকযুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত সৈনিকদের জীবাণুনাশক হাতে নামিয়ে দিলেন কায়রোর রাস্তায়, সেইদৃশ্য আবার ছড়িয়ে দিলেন নিজের ফেসবুক, টুইটারসহ অন্যান্য মাধ্যমেও।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদি ভ্লাদিমির পুতিন এই যুদ্ধে আবার এক ধাপ এগিয়ে। করোনাআক্রান্তদের দেখতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম পিপিই পরে নেমে গেলেন মস্কোতে। ইতালিতে পাঠিয়ে দিলেন চিকিৎসা সরঞ্জামভর্তি ১৫টি সামরিক বিমান, যাদের গায়ে লেখা ছিল, ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’।
তুরস্কে মুক্তসাংবাদিকতার টুটি চেপে ধরা প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান। কয়েকজন সমালোচনাকারী রিপোর্টারকে জেলে পুরে আর পঞ্চাশোর্ধ্ব সকলকে মোবাইলে ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আছে’ বলেই দায়িত্ব শেষ করেছেন।
করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলা করতে এই একনায়কেরা নির্ভর করছেন প্রোপাগান্ডা, দমনপীড়ন আর গায়ের জোরের মত পুরনো অস্ত্রগুলোর উপরেই। আর এসব লোকদেখানো কাজের মধ্যে দিয়ে ‘সবকিছু নিয়ন্ত্রনে আছে’ এমন লেবাস চড়াতেই যেন তাদের বেশী পছন্দ।
হ্যাঁ, আপাতত এই দুর্যোগ স্বৈরশাসকদের একটা সুযোগও করে দিয়েছে বৈকি। বাকি দেশগুলো যখন দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যস্ত, এই অবস্থায় নিজক্ষমতার জায়গাটা আরো পোক্ত করে নিলেও তাতে বাধা দেয়ার, এমনকি খেয়াল করারও যে কেউ নেই। আগে নিজে বাঁচি, তারপর না হয় বাপের নাম?
আর এই নিজে বাঁচার ধান্দায় অনেক গণতন্ত্রমনা দেশ ভাবছে, এমন সব নজরদারীর উপায়, যার বিরোধিতা তারা নিজেরাই করে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে হিউম্যানরাইটস ওয়াচের নির্বাহি পরিচালক কেনেথ রথ বলছেন, এই ভাইরাস বিশ্বরাজনীতিতে স্বৈরাচারী মনোভাব অনেকটাই বাড়িয়ে দেবে। তিনি বলেন,‘করোনাভাইরাস নতুন এক সন্ত্রাস। এটা অধিকার লঙ্ঘনের একটা নতুন অজুহাত। যেটা দুর্যোগ শেষ হওয়ার পরও তার প্রভাব রেখে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।’
কিন্তু একনায়কদের জন্যে এই দুর্যোগ দামোক্লেসের খাড়া হয়ে ঘাড়ের ওপরেও পড়তে পারে। মিশর, তুরস্ক, রাশিয়ার মতো দেশে সংক্রমন কেবল শুরু হয়েছে; যার মানে দুর্যোগের পুরো ধাক্কাটা হয়তো আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সামাল দিতে হতে পারে তাদেরকে। আর ইউরোপ বা আমেরিকায় করোনা যেভাবে আঘাত হেনেছে, সেই রকম কিছুকে সামাল দিতে হিমশিম খেতে পারেন আমাদের এই একনায়কেরা।
করোনাকে না কয়েদ করা যায়, না করা যায় বহিষ্কার। যেই অর্থনৈতিক পাটাতনে দাঁড়িয়ে আজ তারা ছড়ি ঘোরাচ্ছেন, করোনাজনিত লোকসানে নড়ে যেতে পারে তার ভিত। যারা আজ ত্রাতা-বিধাতার রূপ নিয়ে নিজ নিজ রাষ্ট্রের মানুষের ওপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, লাশের বহর তাদেরকেই বানিয়ে দিতে পারে জনতার বলির বকরা বা ‘এসকেপগোট’।
হ্যাঁ, এটা হয়তো সত্যি যে, একদম সঙ্গে সঙ্গেই এই ঘটনা ঘটবে না, দুর্যোগের এই মৌসুমে গণআন্দোলন হওয়াটাও অস্বাভাবিক, কিন্তু জনগনের বিশ্বাসের ভিত্তি নাড়িয়ে দিতে এই ধাক্কাটাই ধসের প্রথম নুড়িপাথর খসাতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কাউন্সিলের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক সিনিয়র ফেলো স্টিভেন এ. কুক বলছেন,‘এটা দুই রকমই হতে পারে। কিছু জায়গায় দেখা যাবে একনায়কতন্ত্র আরো জেঁকে বসেছে। আবার অন্য জায়গায় উল্টোটা’।
কিছু স্বৈরতান্ত্রিক দেশ আবার প্রশংসা পেয়েছে তাদের সময়োচিত ও কার্যকর পদক্ষেপের জন্যে। সংযুক্ত আরব আমিরাত করোনাভাইরাস পরীক্ষায় বিশ্বে প্রথম। সিঙ্গাপুরে করোনা সংক্রমিতদের ট্র্যাক করতে ব্যাবহার হচ্ছে তাদের নিজের মোবাইল, আর সেই ব্যবস্থা নিজেদের দেশে ব্যবহার করার কথা ভাবছে বেশ কিছু পশ্চিমারাষ্ট্রও।
আপনি বাঁচলে তারপর গণতন্ত্র – এই নীতি মানছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো গনতন্ত্রগুলোও।পুলিশের বিচারহীনশক্তির ব্যাবহার কাজে লাগানো, নির্বাচন পেছানো, কোর্ট-কাচারি বন্ধ, ব্যক্তিস্বাধীনতার লঙ্ঘন আর সীমান্ত বন্ধ—যেগুলো কিছুদিন আগেও ছিল স্বৈরাচারীর একান্ত নিজস্ব ব্যবহারের অস্ত্র, আজ তা বিশ্বজুড়ে।
বিপ্লব থামিয়ে দিচ্ছে করোনা। লেবানন, ইরাক, আলজেরিয়া, চিলির বিপ্লব আটকে গেছে এই ভাইরাসের প্রকোপে। আর সামাজিক দুরত্ব যদি বজায় রাখতে হয়, তবে আন্দোলন আবার গতি পাবে কিনা, তা নিয়েও আছে সন্দেহ।–নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে
![](https://i0.wp.com/sangbadsaradin.net/wp-content/uploads/2021/06/sarabel-TEMPLATE4-55.jpg?fit=300%2C158&ssl=1)