|| রুবাইয়াৎ-ই-সেলিম ||
কোভিড-১৯ অতিমারির কারনে অনেক রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনকেই বদলাতে হচ্ছে তাদের কাজের ধারা। মাঠে নেমে বা রাস্তা অবরোধ করে দাবি আদায়ের চিরাচরিত পন্থা কোয়ারেন্টাইনের কারনে আজ অকেজো। প্রশাসনিক জবরদস্তিতেই হোক কিংবা জনসাধারনের নিরাপত্তার জন্যেই হোক—রাস্তায় নামছেনা কেউই। কিন্তু তাই বলে আন্দোলন যে থেমে আছে, তা কিন্তু নয়।
সামাজিক বা জনদূরত্বের মেনে চলার এইসময়ে আন্দোলনকারীদেরকেও হতে হচ্ছে আগের থেকে অনেক বেশী কৌশলী আর খুঁজে বের করতে হচ্ছে অন্যরকম সব পথপদ্ধতি। তবে শান্তিপুর্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই আন্দোলনকে জিইয়ে রেখেছেন তারা। ইসরায়েলে বিরোধীদলীয় আন্দোলনকারীরা পাবলিক চত্বরে অবস্থান নেন, নিজেদের মধ্যে ৬ ফিট দূরত্ব বজায় রেখে।
পোল্যান্ডে নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা আয়োজন করেন “মার্চ”এর, যেই মিছিলের অংশ নেয়ারাও ছিলেন নিজেদের গাড়ির ভেতরেই।
করোনার এই সময়ে কর্তৃত্ববাদী শাসন শোষন ব্যবস্থা আর তার নানবিধ আইনকানুনবিরুদ্ধ আন্দোলন পরিচালনায় বড় রকমের একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে। আর সেটি হচ্ছে এসব আন্দোলনগুলো এখন শারীরিক উপস্থিতি ও মাঠকেন্দ্রিক থেকে অনেকটাই এখন নেটকেন্দ্রিক।
হংকং এ এ্যাক্টিভিস্টরা তাদের গণতন্ত্রমনা বার্তার বাহক হিসেবে বেছে নিয়েছেন জনপ্রিয় অনলাইন গেম ‘এনিম্যালক্রসিং‘-কে।জার্মানি ও ইন্দোনেশিয়াতে বিরোধীদলীয় নেতারা তাদের অবস্থান জানাতে অনলাইনেই চালিয়ে যাচ্ছেন তাতের রাজনৈতিক কার্যক্রম।যেখানে তারা তুলে ধরছেন তাদের বক্তব্য, শুনছে হাজারো, এমন কি লক্ষাধিক মানুষও।
নিপীড়কের হাতেই সব তাস
অনলাইন এ্যাক্টিভিজমের এমন উত্থানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেশকিছু জটিলতাও। এরিকাচেনোওয়েথ, জেয়নেপতুফেকসিসহ আরো অনেক সামাজিক আন্দোলন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব প্রথমদিকে– বিশেষ করে আরব বসন্তের আন্দোলনগুলোতে–ভালো হলেও সেসবের অনেকটাই ছিল কোন না কোনভাবে শাসকনিয়ন্ত্রিত।
শুধু তাই নয়, আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে অনলাইন এ্যাক্টিভিজমেরও কিছু খামতিতো রয়েছেই। বেশীর ভাগ সময়ে এসব আন্দোলন দমনে স্বৈর বা কর্তৃত্ববাদী শাসকরা তাদের ইন্টারনেট সেবাদাতাদের রাখে কঠোর নিয়ন্ত্রনে। এতে করে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চলা তথ্যের ওপর নজরদারি এবং অনেক ক্ষেত্রে খবরদারি করে তারা, যেমনটা আমরা দেখি চীনের ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল‘-এ। আবার এ্যাক্টিভিস্টদের ইন্টারনেট এক্সেস আটকানোর নজিরও রয়েছে প্রচুর।
যেখানে আবার ইন্টারনেট সরাসরি আটকে দেয়া হচ্ছে না, সেখানে সার্ভেইলেন্স চালাতে দেখা যাচ্ছে দমনপীড়নপ্রিয় সরকার ব্যবস্থার দেশগুলোতে। কমখরচে এবং কম লোকবল ব্যবহারেই তারা পেয়ে যাচ্ছে এ্যক্টিভিস্টদের অনলাইন কার্যকলাপের সামগ্রিক চিত্র, নজরদারির বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া সত্বেও। প্রায়শই এসব তথ্য ব্যাবহার করা হচ্ছে সেইসব এ্যাক্টিভিস্টদেরকে গতিবিধির ওপর নজর রাখতে।
রাষ্ট্রযন্ত্রও এসব এক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে ফেকনিউজ বা প্রোপাগান্ডা ছড়াতেও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাবহার করছে সমানতালে। এমন প্রেক্ষিতে গেল এপ্রিলের শুরুর দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার তাদের সাইট থেকে দশহাজারেরও বেশি ফেইক এ্যাকাউন্ট বাতিল করে। যার মধ্যে নয় হাজার এ্যাকাউন্ট ছিল সার্বিয়ায় চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে দমানোর জন্যে দেশটির ক্ষমতাসীন দলের তৈরি।
এভাবে নেটে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া, সত্য খবর জানানো থেকে আক্ষরিক অর্থেই হাজারগুনে সহজ। টুইটারের এই ফেক এ্যাকাউন্ট বাতিলের সময় তিন হাজারেরও বেশি এ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে, যা তৈরি করেছে হন্ডুরাস সরকারের মাত্র একজন কর্মী। মানুষ সরকারী ভাষ্য বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, এসব গুজব ও ভুলভাল তথ্য এ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করানোয় যথেষ্ট কাজে দিচ্ছে। আর এটি চালিয়ে যেতে সবসময়েই সচেষ্ট থাকছে কর্তৃত্ববাদি রাষ্ট্রগুলো।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর সুবিধা হলেও এর নেতিবাচক প্রভাব সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর ওপর। বিশেষ করে যে সব আন্দোলনের নেতৃত্বে নেই কোন শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো।
হ্যাঁ, অনেক মানুষই হয়তো কোন অনলাইনভিত্তিক আন্দোলন কর্মসূচিতে নেবে, কিংবা অনলাইন আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাঠের আন্দোলনে অংশ নেবে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে আন্দোলনকারী ও যাদের স্বার্থে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হচ্ছে এই দুই গোষ্ঠির পারস্পরিক আস্থার জায়গাটি অনলাইন এ্যাক্টিভিজমে গড়ে তোলা দুঃসাধ্য। তাই এক্ষেত্রে সব থেকে বেশী দরকার শক্তিশালী সাংগঠনিক অবকাঠামো। কেননা এটি ছাড়া কোন আন্দোলন দমনপীড়ন সহ্য করতে পারে না, এবং সে আন্দোলন ব্যর্থ হওয়াটাই সম্ভাব্য।
সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো কি পারবে পেরে উঠতে?
করোনাসময়ে অনলাইননির্ভরতার এমন প্রেক্ষিতে দমনপীড়নপ্রিয় শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলনরত অনেকের জন্যেই অনলাইনভিত্তিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হয়। তারপরও কোভিড-১৯ এর কারণে সামাজিক ও জনদূরত্বের বেড়াজালে আটকে পড়া আন্দোলনগুলো এই ‘বাঁকা উঠোনে নাচতে‘ কেমন কৌশল নিচ্ছে তা দেখা যাক।
অনেক আন্দোলনে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাবহার হচ্ছে ছোট আকারে সংগঠিত হয়ে কাজ করার জন্য। দুস্থদের খাদ্য ও অন্য সহায়তা দেওয়ার কাজে ইতালি থেকে শুরু করে ইউক্রেন পর্যন্ত বিভিন্ন ছোট ছোট আন্দোলনের কর্মীরা ব্যবহার করছে ডিজিটাল মাধ্যম। টুইটার দিয়ে লাখ লাখ মানুষ ডেকে আন্দোলন করে দু’দিন পর দম ফুরিয়ে যাওয়ার চাইতে এই রকম ছোট আকারের নেটওয়ার্কগুলো দীর্ঘস্থায়ী আস্থা তৈরিতে বেশি ভালো কাজ করবে আশা করা যায়।
এ্যাক্টিভিস্টরা সরকারী নজরদারি আর খবরদারী এড়াতেও বেশ পটু হয়ে উঠেছেন। প্যারাডাইম ইনিশিয়েটিভ, ট্যাক্টিকাল টেকনোলজি, কালেক্টিভ এবং মোবিলাইজেশন ল্যাব-এর মতো সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে এ্যাক্টিভিস্টদের অনলাইন নিরাপত্তার গুরুত্বপুর্ন বিভিন্ন দিক এবং কর্তৃত্ববাদী শাসকের হাত থেকে বাঁচার পথপদ্ধতি শিখিয়ে যাচ্ছে।
চীনে এ্যাক্টিভিস্টরা সরকারী খবরদারী আর নজরবন্দী অবস্থার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন নিষিদ্ধ শব্দের বিকল্প ব্যাবহার করে, যার উদাহরন দেখা যায় সরকারের করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারার ব্যর্থতা বিষয়ে ড. আইফেন এর সমালোচনার নিষিদ্ধ প্রবন্ধটি ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে।
এছাড়াও সরকারী গুজবযন্ত্র মোকাবিলা করতে এ্যাক্টিভিস্ট ও সুশীলসমাজ একজোট হয়ে কাজ করছে। বলকানে আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট-চেকিং (সত্যানুসন্ধান) দিবসে সুশীল সমাজের গ্রুপগুলো তাদের এলাকায় গুজব ছড়ানো প্রতিহত করতে উদ্যোগ নিয়েছে। মেক্সিকোতে ৫০টি মিডিয়া এবং পাবলিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ কোভিড-১৯ এর ব্যাপারে সঠিক তথ্য জানাতে তৈরী করেছে একটি যৌথ টুইটার ক্যাম্পেইন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ইউনাইটেড স্টেটস ইন্সটিটিউট অব পিস (ইউএসআইপি) এর শান্তিপুর্ন কার্যক্রম ল্যাটিন আমেরিকার এক্টিভিস্টদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে। ইন্সটিটিউটের সাম্প্রতিক কার্যক্রমের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সরকারী গুজব ঠেকানোর কলাকৌশল তৈরি করছে সেখানকার নাগরিক সমাজের কর্মীরা।
অনলাইননির্ভর আন্দোলন কৌশলের চ্যালেঞ্জটা হয়তো থেকেই যাবে। কিন্তু নির্যাতক শাসকগোষ্ঠী যেভাবে এইসব ডিজিটাল পথপদ্ধতির সুবিধা নিচ্ছে, তাতে করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনগুলোকেও তাদের কাজে কৌশলী হয়ে সুবিধা তৈরি করে নিতে হবে ইন্টারনেটের মাঠে। হতে পারে, কোভিড-১৯ এর বিশ্ববাস্তবতাতেই পরিবর্তনের শুরুটা হবে।
সংবাদসূত্র: ইউনাইটেড স্টেটস ইন্সটিটিউট অব পিস