করোনাদিনে আমলানির্ভর রাষ্ট্র ও মানুষের মুক্তি

|| আদীল এ হোসেন ||

ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের যে কোন কার্যক্রম যে কেউ চ্যালেঞ্জ করতেই পারেন। তেমনিভাবে গণস্বাস্থ্যের করোনা টেস্ট কিটকেও চ্যালেঞ্জ করা যায়, করতেই পারেন যে কেউ, সেটাতে দোষের কিছু নাই। তবে বেসকরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল একাত্তর টিভির টক শো প্রমাণ করে গণস্বাস্থ্যের করোনা শনাক্ত করন কিট এর বিপক্ষে একটা সঙ্ঘবদ্ধ চক্র বেশ তৎপর।

তা নাহলে কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই ঔষুধ প্রশাসনের উপ পরিচালক আশরাফ, মোক্তাদির, ডা. স্বপ্নিল ও সাংবাদিক নাজমুল আশরাফকে নিয়ে ফারজানা রুপার সঞ্চালনায় একাত্তর জার্নালে কি করে বলা হলো গণস্বাস্থ্যের করোনা শনাক্তকরন কিট কাজ করবে না?

এই কিট তৈরির প্রক্রিয়ায় এরআগে গত ১২ই এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে লেখা চিঠিতে ১০জন করোনা রোগীর তিন সিসি করে রক্ত চেয়ে পাঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ধরণা দিয়ে ৮ থেকে ৯ দিন অপেক্ষা করেও রক্ত বা চিঠির জবাব না পেয়ে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানান গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। অবশেষে ২২শে এপ্রিল সেই চিঠির জবাব পায় গণস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খুঁজে পাচ্ছিলেন না সেই ফাইলটি যে ফাইলে গণস্বাস্থ্য সংস্থা রক্ত চেয়ে চিঠিটি ছিল। অবশেষে রক্ত চাইবার দীর্ঘ দশ দিন পর করোনা শনাক্তকরণ কিট পরীক্ষা করবার জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত পায় গণস্বাস্থ্য।

তারপরও গত ২৪শে এপ্রিল একাত্তর টিভিতে ঔষুধ প্রশাসনের উপ পরিচালক আশারাফের গণস্বাস্থ্য সংস্থার করোনা শনাক্তকরণ কিট নিয়ে করা উক্তি ছিল জনসাধারণের কাছে প্রতিষ্ঠানেগুলোর সর্বোচ্চ পর্যায়ের অসহযোগিতার ইঙ্গিত।

অবশেষে কিট তৈরির পর সেটি সরকারসংশ্লিষ্টদের কাছে হস্তান্তর করতে আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। আয়োজন করা হয় সংবাদ সম্মেলনের। সেই আয়োজনেও সরকারের কোন প্রতিনিধি উপস্থিত না হওয়ায় তা সরকারকে দিতে পারেনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।

উপরন্তু করোনার এই মহাসংকট সময়ে রাষ্ট্র-সরকার বাংলাদেশের সকল মানুষের মনের সেই আতংককেই প্রতিষ্ঠিত করল তুড়ি মেরে। জনগণের জানমাল রক্ষার চেয়ে বড় তাদের কাছে অহংবোধটাই বড় হয়ে দাঁড়ালো। জনগণের সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান যখন জনগণের বিপক্ষে দাঁড়ায় তখন জনগণের শেষ বা একমাত্র কাজটি কীইবা হওয়া উচিৎ?

করোনাদুর্যোগে ঘরবন্দি মানুষ যখন প্রতি পলে পলে মুক্তির দিন খুঁজছে, ঠিক সেইসময় জনগণের সেবায় নিয়োজিত কর্মচারীদের দায়িত্বজ্ঞানহীন দাম্ভিক আচরণের জবাবে মাুনষ বলেও ফেলছে – “কথায় হবে না ওদের টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে আসতে হবে”। এ হয়তো নিছক বলা নয়, এটা আসলে বর্তমান আমলানির্ভর রাষ্ট্র ও সরকারকের উদাসীনতায় পিষ্ট মানুষের ক্ষুব্ধ মনের প্রকাশও বটে। এমন কথার জবাবে কেবল এই কথায় বলা যায়- কাজটি একক সিদ্ধান্ত এবং পেশীশক্তির ওপর নির্ভর করে না। কাজটি যেহেতু সামগ্রিক, সে কারণেই সকলের অংশগ্রহণ দরকার।

একক সিদ্ধান্তে ছোটখাটো কোন প্রতিষ্ঠান হয়তো চালানো সম্ভব। কিন্তু কোন রাষ্ট্র বা দেশের রাজনীতি নির্মাণ সম্ভব নয়। সুতরাং সেই হঠকারি পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকাটাই জরুরী। বৃহত্তর জনসমষ্টির সমর্থন ছাড়া কোন কাজই সঠিকভাবে করা সম্ভব নয়। ঠিক তেমন কোন একক ব্যক্তির ওপর পুরো দেশের দায় দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। যার প্রমাণ আমরা পেয়েছি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে।

১৯৭০ এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে ইয়াহিয়া খান যেমন কঠিন শর্তসাপেক্ষে Legal Framework Order – LFO দেয়, ঠিক একইভাবে ২৩শে মার্চ ১৯৭২ এ সংবিধান প্রণয়ন করতে গিয়েও তেমনি বিধান The Bangladesh Constituent Assembly Members (Cessation of Membership) Order-1972 জারি করা হয়।

মজার বিষয় ২৮শে মার্চ ১৯৭০ তে করা পাকিস্তানী সামরিক শাসকের Legal Framework Order – LFO ও ২৩শে মার্চ ১৯৭২ এ সংবিধান রচনার প্রাক্কালের, বিধান The Bangladesh Constituent Assembly Members (Cessation of Membership) Order – 1972 এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কারণ জনগণ মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনেকটা দেবতার আসনে বসিয়ে, জবাবদিহি তো দূরের কথা ফিরেও দেখেনি আসলে তাদের ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে।

বরং ২৫শে মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এই সময়ে বাঙালি জাতির আত্মত্যাগ ও লড়াই কেবলই থেকে গেছে মানুষের স্মৃতিতে। এই চার দশকের বেশী সময়ে এই জনগোষ্ঠির আকাঙ্খাজাত রাষ্ট্রটির কোনও নিদর্শনই দেখতে পায়নি বাঙালি।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে একক ব্যক্তির শাসন ব্যবস্থাইতো চলছে। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের শাসন করায় বলার একটা জায়গা ছিল। ছিল সংগ্রাম প্রতিরোধের অবকাশ। দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে ধারাবাহিক প্রতিরোধ আর সংগ্রামশেষে আমরা পেয়েছি বটে একটি পতাকা, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড।

কিন্তু পাকিস্তানসময়ের সেই শোষণ-শাসন, নির্যাতন, বঞ্চনার মত একই পরিস্থিতির শিকারতো এখনো দেশের মানুষ। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি বা শাসনতন্ত্র বা সংবিধান ছিল না বলে তখন পাকিস্তান পরিচালনা করত, স্বৈরশাসক। কিন্তু এখনতো রয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার বিধিবিধাণ-সংবিধান। তাহলে সমস্যা কোথায়?

আসলে সবকিছু থাকলেও নেই রাষ্ট্র পরিচালকদের জন্য কোন জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার বালাই। থাকলেও থোড়াই কেয়ার করছেন শাসকরা। আর তা নেই বলেই ঔষুধ প্রশাসন বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, জনগণের কর্মচারী হয়েও নিজেদের কর্তা ভেবে কর্তৃত্ব করে। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে চাইলে প্রয়োজন, “জনগণের কাছে দায়বদ্ধ ও জবাবদিহিতার রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা”। আর কেবল রাষ্ট্র পরিচালনার আইন কানুন সংস্কার করেই এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব, নচেৎ নয়। মোদ্দা কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রকে মানুষের পক্ষের করতে হলে পাল্টাতে হবে এর পরিচালনার আইনকানুন। করোনার মত দুযর্োগও সেটাই প্রমাণ করে দিল মানুষের পক্ষের রাষ্ট্রের কোন বিকল্প নেই।

আদীল, ঢাকা – ২৬.০৪.২০২০

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন