করোনাকাল, সাংবাদিকতা ও উল্টো আয়না

|| আহমেদ মুশফিকা নাজনীন ||

বাংলাদেশ টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ ভিডিও সাংবাদিক রোজিনা আক্তার যেদিন মারা গেলো সেদিন খবরটা ওর টিভিতে দেখালো প্রায় ৩০ সেকেন্ড। থমকে গেলাম। কষ্টও পেলাম খুব। ১৬ বছর এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পরেও একটা দেড় বা ২ মিনিটের প্যাকেজ করা হলো না তাকে নিয়ে ।

অথচ বেঁচে থাকতে কত মানুষের ছবি তুলেছে সে। রিপোর্টিংয়ে থাকতে কতজনকে নিয়ে প্রোফাইল প্যাকেজও করেছে ও । অথচ ওর কপালে জুটলো না নিউজে আর একটু বেশী ডিউরেশন!

কি কপাল আমাদের! গণমাধ্যমে নিজেরা কাজ করলেও আমরাই দেইনা বা দিতে পারিনা আমাদের প্রাপ্য সম্মান। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া প্রায় সব জায়গায় একই রকম অবস্থা।

রোজিনা নাজনীন

আমরা আসলে এমনই। সারাক্ষণ কূট চাল, কাদাছোঁড়াছুড়ি, নিজ স্বার্থ লাভ, ক্ষমতার মোহ আর লোভে পরে আমরা ছোট করি, হেয় করি একে অন্যকে। আমরা নিজেরাই চেষ্টা চালাই অন্যের চাকরি চলে যেতে। লেজুরবৃত্তি আর তেলবাজি যারা করে তাদের নিয়ে দলপাকাতে ব্যস্ত থাকি। আমরা আমাদেরই সম্মান দেইনা। আর তাই দু:খজনক হলেও সত্যি নিজেরাও সম্মানিত হইনা।

আমাদের অবহেলার চোখে দেখার সুযোগ নেয় তখন অফিস, সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার। কজন প্রভাবশালীদের সাথে সখ্য আছে, চাইলেই তাদের ফোন করা যায় এই আত্মতৃপ্তিতে ভুগেই কেটে যায় অনেকের জীবন।

প্রশ্ন জাগে মনে, যে মানুষটা ১৬ বছর তার শ্রম ভালবাসা দায়িত্ববোধ দিয়ে গেল তার কাজের জায়গাতে, সেখানে কি একটু বড় সংবাদ হতে পারতো না তাকে নিয়ে ? কি এমন ক্ষতি হতো তাতে ? নিউজের ডিউরেশনে অন্য নিউজ বাদ যেতো ? যাক না। না হয় অন্য একটা নিউজ ড্রপই হতো। পরিবারের মানুষগুলো তো একটু সান্তনা পেত যেখানে কাজ করেছে সেখানে তার মূল্য ছিলো অনেক।

আসলেই কি সমাজে সাংবাদিক, ভিডিও এডিটর, ভিডিও সাংবাদকিসহ যারা সংবাদের সামনে ও পেছনে কাজ করেন কারও কি কোন মূল্য আছে রাষ্ট্রে ?

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সংবাদ জোগাড়ে কি অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় এ পেশার মানুষদের। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাজ করতে হয় তাদের। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই। সবার আগে সংবাদ পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর সে। অথচ এই অনিয়মের ফলে একসময় সে যখন অসুস্থ হয়ে যায় তখন আর তার মূল্য নেই। এক নিমিষে তার জায়গা হয়ে যায় দখল। দলাদলি, নীচুতা, পারম্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব তখন সাংবাদিকদের আরও বিপন্ন করে তোলে।

এমনও হয় কোনো কোনো সংবাদকর্মী আগেরদিন কাজ করে পরদিন সকালে অফিসে এসে শোনেন তার চাকরি নেই। বিষন্ন চিন্তিত মুখে সে তখন দিশেহারা। দিন দিন দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় ডিআরইউ আর প্রেসক্লাবের বোবা চত্তর।

চলছে করোনা কাল। এ দু:সময়ে সব সংবাদ পৌঁছে দিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা ছুটছেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। তাদের নেই তেমন কোনো সুরক্ষা। সম্বল, সস্তার একটা মাস্ক আর গ্লাভস। কেউ কেউ হয়তো পিপিই পান। তবে বেশীরভাগেরই কপালেই তা জোটে না। শোনা যায়, এর মাঝে কোনো কোনো অফিস হুমকি দেয়, প্রতিদিন না এলে বেতন কাটা যাবে। কোনো কোনো হাউজে আবার প্রশাসনের কাছে ভালো হতে গিয়ে অনেক সংবাদকর্মী নালিশ দেয় সহকর্মীদের বিপক্ষে। উস্কে দেয়, পরামর্শ দেয় বেতন কাটার।

বেতন আর চাকরি হারানোর ভয়ে অসহায় সংবাদকর্মী তখন পায়ে হেঁটে হেঁটে অফিস করেন। জীবন আগে না চাকরি আগে সে তর্ক তখন চাপা পরে রয়। পরিবারের কথা ভেবে সবার আগে তখন তার চাকরি বাঁচানো দরকার মনে হয়। মনে পরে অফিসে আসার আগে ছোট ছেলেটার গলা জড়িয়ে ধরে বলা সেই কথা, ‘বাবা বাইরে যেওনা, করোনা আছে।’ চোখ মোছে সে। হাঁটতে থাকে দ্রুত।

দলে দলে কারখানা শ্রমিকদের চাকরি বাঁচাতে ঢাকায় আসার খবর টিভিতে, পত্রিকায় দেয় হয়তো সেই সাংবাদিকই । অথচ নিজের ভেতরের কষ্টকর খবরটা আর জানানো হয়না কাউকে। বুঝতে দেননা কাউকে নিজের কোনো যন্ত্রণা। বুঝাতে পারেননা দুঃসময়ে যখন সহকর্মীদের পাশে থাকার কথা তখন অনেক সহকর্মীই হয়ে যায় অচেনা, স্বার্থপর। একদিকে অফিস পলিটিক্স, অন্যদিকে করোনা সংক্রমন থেকে বাঁচাতে বউ বাচ্চাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে নিজে রয়ে যান ঝুঁকির মধ্যে।

কিন্তু এ মৃত্যুঝুঁকিতে কি পাশে থাকে সরকার, রাষ্ট্র বা তার অফিস ? বিভিন্ন পেশায় ডাক্তার, পুলিশ, ব্যাংকার, সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন জরুরী সেবার মানুষদের জন্য রয়েছে নানা প্রণোদনা ও ঝুঁকি ভাতা । ১০দিন কাজ করলেই একমাসের বেতন পাবেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। সাধুবাদ তাদের। তারা পেরেছেন আদায় করতে।

সংবাদকর্মীদের জন্য কি আছে ? কিসসু নেই। দিনরাত কাজ করলেও তাদের বেশীরভাগেরই পকেট থাকে ফাঁকা। কোন রকমে দিন চলে যায় তাদের। তারা যেন রাষ্ট্রের কেউ না। তাদের জন্য রাষ্ট্রের কোনো মায়া মমতাও যেন থাকতে নেই। সাংবাদিকতা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হলেও এদেশের সাংবাদিকরা যেন আলাদা কোনো গ্রহের। এদের টাকা লাগে না, খাওয়া লাগে না, পেনশন ভাতা লাগে না, প্রভিডেন্ট ফান্ড লাগে না, ইন্সুরেন্স লাগে না, কিছুই লাগে না। তারা মরলেই কি আর বাঁচলেই কি। অনেক সস্তা যেন সাংবাদিকের জীবন।

জেলা উপজেলার সাংবাদিকদের অবস্থা তো আরও খারাপ। তাদের ঢাল তলোয়ার কিছু নেই। যে যতটুকু সুরক্ষা করতে পারছেন তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে সংবাদ পাঠান সারাদেশের। তারপরেও নানা কথা শুনতে হয় তাদের। কে আছে এদের পাশে ?

সস্প্রতি করোনা সংক্রমনে মারা গেলেন সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকন। আক্রান্ত হয়েছেন তার পরিবার। কাজ করতে যেয়ে আক্রান্ত হয়েছেন বা হচ্ছেন আরও বেশকিছু সাংবাদিক। কোনো প্রণোদনার ঘোষণা আছে কি তাদের জন্য ? নেই। প্রথম আলোর এক কর্মী লিখেছেন যে কোনো দুর্যোগে তাদের পাশে থাকে প্রথম আলো। ভালো লাগলো পড়ে। কিন্তু সবাই তো এরকম সুবিধা পায়না। তাদের কি হবে ?

এক এক করে বাড়তে থাকবে হয়তো মৃত্যুর মিছিল। বাড়বে করোনায় আক্রান্ত সাংবাদিকের সংখ্যা।

পত্রিকায়, টিভিতে, ফেসবুকে সাদা কালো ছবি হয়ে, দু:খো দু:খো ইমো পেয়ে কি পেট ভরবে একজন সাংবাদিক বা তার পরিবারের ?

যিনি মারা গেলেন তার পরিবার তো পরে গেল আরও গভীর খাদে। সে খাদ থেকে উঠে বাঁচবেন কিভাবে তারা ? ২০ বছর কাজ করার পরেও পেনশন প্রভিডেন্ট ফান্ড না থাকায় তার পরিবারকে তো শুরু করতে হবে শুন্য থেকে।

কেন? কেন একজন সাংবাদিকের জীবন থাকবে সবসময় অনিশ্চয়তায় ভরা ?

সাংবাদিকতাতো সৃজনশীল পেশা। এই পেশার নেশায় পরে কেটে যায় এক জীবন। যারা নেশার মধ্যে থেকেও নিজ স্বার্থ কূট চাল চালিয়ে জীবন কাটান তারা পারেন হয়তো অনেক কিছু করতে। তবে বেশীরভাগ সাংবাদিকই তা পারেন না। আর তাদের সংখ্যাই বেশী এ পেশায়। তাই এখনই উচিত নিজেদের অধিকারে সোচ্চার হওয়া। নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সর্ম্পকের উন্নয়ন করা। একে অন্যের প্রতি সহমর্মী হয়ে সহায়তার হাত বাড়ানো।

গেল ৩রা মে সবসময়ের মতই অনেকটা অনাদরে কেটে গেল আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম ডে। এ দিবসে জোরালো দাবী ওঠা দরকার ছিল করোনা যোদ্ধা হিসেবে সব জরুরী ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশার মানুষরা যে পরিমান প্রণোদনা/ঝুঁকি ভাতা পাবে সংবাদকর্মীরাও সেই একই প্রণোদনা বা ঝুঁকি ভাতা পাওয়ার অধিকার রাখে। রাষ্ট্রের কাছে সব প্রাণের মুল্য কি একই রকম হওয়া উচিত নয় ?#

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন, সংবাদকর্মী, একুশে টেলিভিশন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন